দুই হাজার একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে শাহীন রেজার নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘খণ্ডিত মেঘের মুখ’। শাহীন বাংলাদেশের আশির প্রজন্মের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি। বাংলা কবিতার নিয়মিত পাঠক নামটির সঙ্গে সুপরিচিত।
সমসাময়িক লেখক হিসেবে আমি তার কবিতার সঙ্গে পরিচিত সুদীর্ঘকাল। রবীন্দ্রনাথ থেকে আজকের রিডকু অনিমিখ (১ম দশকের নবীন কবি) পর্যন্ত বাংলা লিরিকের যে বিচিত্র প্রকাশ ও অর্জন তারই অনিরুদ্ধ অংশীদার আমাদের শাহীন রেজা।
এই লেখক তার পূর্বতন কাব্যগ্রন্থসমূহেই পরিচ্ছন্ন ভাবসংহতি ও কল্পনাসচ্ছলতার পরিচয় রেখেছিলেন। বর্তমান কাব্যগ্রন্থটি গীতিকবিতার পরিণত রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। ষাটের দ্বারপ্রান্তে এসে একজন কবি, যিনি দীর্ঘকাল কবিতাযাপন করেছেন, কতটা শিল্পসাবলীলতা অর্জন করতে সক্ষম তারই গাঢ় স্বাক্ষর বহন করছে এই ‘খ-িত মেঘের মুখ’। পাঠকের সুবিধার জন্য আমি এখানে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি তুলে দিচ্ছি-
১. ইচ্ছেরা প্রগাঢ় হলে ঘ্রাণহীন জবাও হয়ে উঠতে পারে / কামিনীর বোন / আর রাত্রির চোয়াল খুলে নেমে আসতে পারে আদমসুরাত (সর্ম্পক-সেতু)
২. উড়ে যাচ্ছে চিল, গোধূলি এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে / সন্ধ্যার দিকে।/ মাছকুড়ানি মেয়ে ফিরে যাচ্ছে বাড়ি, আঁচলে তার বলেশ্বর এবং কয়েকটি ধূসর মরা মাছ। (পাশাপাশি)
৩. হামাগুঁড়ি দেয়া ভোর একদিন দুপুর ছুঁলে / তবেই কাঁপবে রোদ; শালপাতা / দুপুরের বুনো
বুকে ঘুঘুদের ওম / নিশ্চিত এরই নাম স্বাধীনতা- / তুমি বলবে,/ তুমি বলবে-/ আমিও সেই
সাথে এবং কবিতারা। ( স্বাধীনতা)
৪. বাতাস দোলাবে কিছু কৃষ্ণচূড়া আর বালিহাঁস / পদ্মায় পাল তোলা বজরায় তখন সুরের
মাতম / গীতাঞ্জলি হাতে মৃণালিনী যেন এক / আলোর পোট্রেট। (শিলাইদহে মেঘ)
৫. আহ্ দিয়াশলাই ছাড়া উনুন জ্বলবে কি করে!/ সবগুলো কাঠি উজাড় করে সে-তো আমাদের /
হৃদয়গুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। (উনুন)
ছোট কবিতার অতি সীমিত পরিসরেও বড় ভাবনা ও মন ছুঁয়ে যাওয়া অনুভব ধরা পড়তে পারে। সে রকম একটা রচনা ‘সাপলুডু’। পড়–ন গোটা কবিতাটিই-
‘পকেটে জ্যান্ত সাপ অথচ খেলছে সাপলুডু, / আস্ত সকাল কেটে তুলে দিচ্ছে নাস্তার প্লেটেÑ/ খিড়কি খুলে গিলে নিচ্ছে রোদের কাটলেট;/ জিহ্বায় লুট হচ্ছে স্বাদ আর / নুনজলের বনেদি চুম্বনে গাঢ় বাৎসায়ন। / হেমলক-শ্লেটে তবু খাবি খাচ্ছে খড়িমাটি ভোর / কলমি চোখের নীড়ে ছায়ার ফড়িং।’ (সাপলুডু)
অভিনব কল্পনার প্রকাশ লেখাটিকে ভিন্ন স্বাদ দিয়েছে। আবার অন্য কবিতায় দেখতে পাই-দুপুরের সম্পূর্ণ আলাদা, যথার্থই কাব্যশোভন এক ছবি-
‘দেয়ালে আটকে গেছে আস্ত দুপুর / রোদের নরুন আঁটা মেয়ে পালিয়েছে আধখানা ভুট্টার ক্ষেতে।’
বিষয়-বৈচিত্র্য কবিতাকে একঘেয়েমি থেকে বাঁচায়। শাহীন রেজা এ বিষয়ে সতর্ক। এই বইয়ে নানা রকম থিম নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। মাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘চাঁদের ময়ূর’ নিয়েও। ‘মাকড়সা’ নিয়ে কবিতা আছে, আছে ‘পাঞ্জাবি’ শিরোনামেও। দেশ বাস্তবতা ও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্বন্ধেও এই কবি সচেতন। তারই প্রতিভাস ‘জর্জ ফ্লয়েড, বন্ধু আমার’ নামের কবিতাটি, যদিও খুব বেশি মার্কস একে আমি দেব না। অবশ্য এই লেখার প্রথম অংশটা অসাধারণ। এ ছাড়া ‘যদি না দাঁড়াও’, ‘সুতা’, ‘ঘ্রাণের অক্টোপাস’ প্রভৃতি কবিতা বার বার পড়ার মতো। এসব লেখায় মনোভাব ও কবিকল্পনার সুন্দর বহির্প্রকাশ ঘটেছে। আর এই ধরনের কবিতাগুলোই সত্যিকারভাবে ধারণ করে শাহীন রেজার কবিচারিত্র। এরপর শাহীন কী করবেন ? আমার তো মনে হয় ছোট ছোট কবিতার নিবিড়-গভীর ভুবনে নিজেকে আরও বেশি লিপ্ত করা ছাড়া তার আর উপায় নেই।
বন্ধু শাহীন রেজার জন্মদিন ২৯ মে। জন্ম সালটা গোপন করে গেলাম। কারণ, বয়সের সঙ্গে তার চেহারা চিত্রের মিল খুঁজতে গিয়ে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন। বন্ধুর জন্মদিনে তার সবশেষ কবিতার বইয়ের ব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তার প্রতি রইল এক আকাশ শুভকামনা।
খণ্ডিত মেঘের মুখ, শাহীন রেজা, প্রকাশক : শিকড় প্রকাশনী, প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু, মূল্য : ২০০ টাকা।