ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়ারজান ॥ কুঁড়েঘর থেকে শিরোপামঞ্চে

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০১:২৭, ৫ এপ্রিল ২০২৪

ইয়ারজান ॥ কুঁড়েঘর থেকে শিরোপামঞ্চে

কুঁড়েঘর থেকে শিরোপামঞ্চে

দেশের সর্ব উত্তরের পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের প্রান্তিক একটি গ্রামের নাম খোপড়াবান্দি। সারা দেশের মানুষজন এই গ্রামের নাম কোনোদিন হয়তো শোনেননি। আজ সেই গ্রামের নাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ এই গ্রামেই আন্তর্জাতিক সাফ ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক ইয়ারজানের অসহায় বাবা মায়ের বসতভিটা।

ইয়ারজানের সাফল্যে আজ তার বাবা মায়ের কুঁড়েঘর বাসস্থানটি রূপান্তরিত হচ্ছে সেমি পাকা বাড়িতে। ইয়ারজানের এই বাড়িতে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জহুরুল ইসলাম ও র‌্যাব ১৩ রংপুর কমান্ডার আরাফাত ইসলাম ছুটে গিয়েছেন। দিয়ে এসেছেন অসংখ্য উপহার। 
গ্রামাঞ্চলের এক সংগ্রামী জননী রেণু বেগম। সমাজের অন্যদের মতো বিয়ে হয়েছিল তার। কিন্তু সংসার জীবনের শুরু থেকেই চলছে তার সংগ্রাম। দিনমজুরের কাজ করে আগলে রেখেছেন অসুস্থ স্বামী ও সন্তানদের। তবে দীর্ঘ সংগ্রাম জীবনের অবসান হতে চলছে এবার রেণু বেগমের। এতদিনের লালিত স্বপ্ন এবার বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। মেয়ে ইয়ারজান বেগম হাসি ফোটাবে তার গরিব অসহায় পরিবারে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ইয়ারজান বেগম। স¤পদ বলতে নেই কোনো জমিজমা, আছে শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে এক টুকরো ভিটেমাটি।
চলতি বছরের গত ১-১০ মার্চ পর্যন্ত নেপালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অনূর্ধ্ব-১৬ (নারী) আন্তর্জাতিক সাফ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৪। এতে চারটি দল বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও স্বাগতিক নেপাল অংশগ্রহণ করেছিল। ১০ মার্চ,  নেপালের ললিতপুরে ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারত। নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ গোলে ড্র হলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। পেনাল্টি স্পট থেকে গোলবার পর্যন্ত বল যাওয়ার পথটুকুতে প্রার্থনায় ছিল বাংলাদেশ গোলরক্ষকের গাভজোড়া। সেটি বিফলে যেতে দেননি ইয়ারজান।

গোলরক্ষক ইয়ারজানের নৈপুণ্যে ভারতকে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা জিতে আনন্দে কাঁদল ইয়ারজান, আর শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতল বাংলার কিশোরীরা। এমন অনবদ্য পারফর্ম করার পর টুর্নামেন্টসেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার গোল্ডেন গাভস উঠে ইয়ারজানের হাতেই। সেই  গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে ইয়ারজান বেগম এখন  দেশব্যাপী আলোচনার মধ্যমণি।
টুর্নামেন্ট শেষে নেপাল হতে দেশে ফিরে এই গোলরক্ষক এখন অবস্থান করছেন তার গ্রামের বাড়িতে। নানা বিপত্তির দেয়াল পেরিয়ে আসতে হয়েছে ইয়ারজান বেগমকে। সেই বাস্তবতাই ইয়ারজান ও তার অসহায় বাবা ও মাকে অপরাজিতার খাতায় নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছেন। 
ফুটবলার ইয়ারজানের পরিবারের অসহায়ত্বের বাস্তব গল্পটার ভিন্নতা রয়েছে। ইয়ারজানের জন্ম অতিদরিদ্র এক পরিবারে। তার বাবা আবদুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। মা রেণু বেগম অন্যের বাড়ি এবং ফসলি জমিতে কামলার কাজ করেন। তার ছোট এক বোন আছে। মায়ের আয়েই চলে চারজনের সংসার। এক সময় দুবেলা ঠিকমতো খাবার জুটত না ইয়ারজানের। 
১১ মার্চ নেপাল থেকে ফিরে এতদিন ঢাকাতেই ছিলেন ইয়ারজান। গত ৩০ মার্চ দুপুরে ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন ইয়ারজান। মেয়েকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা রেণু বেগমসহ পরিবারের সদস্যরা। সন্তানকে জড়িয়ে ধরে চুমু খান মা রেণু। পরে ইয়ারজান তার মা-বাবা, দাদা-দাদি ও তার ফুটবল কোচের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন। নিজ এলাকায় ফিরে স্থানীয়সহ স্বজনদের এমন ভালোবাসায় মুগ্ধ ইয়ারজান।
ইয়ারজান বেগম, অনুসরণ করেন স্বদেশী গোলরক্ষক রুপনা চাকমাকে, যিনি সাফজয়ী সিনিয়র দলের গোলরক্ষক ছিলেন। লাল-সবুজদের উদীয়মান তারকার আরও একটি ভালোলাগা আছে। বিশ্বজয়ী আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে বেশ পছন্দ ইয়ারজানের। শিরোপার মোহময় সময় এখনো ঘোর লাগিয়ে রেখেছে ইয়ারজানকে। বললেন, অনেক ভালো লেগেছে যে আমরা চ্যা¤িপয়ন হয়ে দেশে ফিরতে পেরেছি। জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছি, এজন্য ভালো লাগতেছে। আগামীর লক্ষ্যও ঠিক করে ফেলেছেন উদীয়মান গোলরক্ষক,পরের স্বপ্ন জাতীয় দলের হয়ে খেলা। দেশবাসীর জন্য আরও কিছু করতে চান ষোলো না পেরোনো গোলকিপার।
 ইয়ারজান বলেন, সাফ বিজয়ের পর বাড়িতে এসেছি। এসে দারুণ আনন্দিত হয়েছি। জীবনেও ভাবিনি আমার বাড়িতে এত মানুষ আসবে। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমার কোচ টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমানকে। ফুটবলে আরও ভালো করতে চাই, স্বপ্ন দেখি জাতীয় দলে খেলবো। এর আগে গেল ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যা¤িপয়নশিপে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে চ্যা¤িপয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। তবে ইয়ারজানদের হাত ধরে বাংলাদেশ সেই ভারতকেই হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ দলের শিরোপা জিতে নিয়েছেন। 
নিজের ক্যারিয়ারের শুরুর বিষয়ে বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণি থেকে ফুটবল খেলা শুরু করি। এই আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার বাবার। তিনিই আমাকে সবসময় সমর্থন দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এখনো দিচ্ছেন। আমি কখনই কল্পনা করিনি আমার বাসায় এতো লোক এসে আমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাবে। আমি সবার ভালোবাসা পেয়ে আনন্দিত। সবাই আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। আমি ক্লাব লিগে খেলার জন্য সিরাজ ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। আপাতত সেখানে খেলব।

×