হাতে ভাজা মুড়ি
মোটামুটি পশু উৎসর্গ করার রীতি অনেক ধর্মেই আছে। আমাদের দেশের পটভূমিতে গ্রামীণ সমাজে তাই ঈদ উপলক্ষে গরু বা খাসির মাংসের বহু রকম স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় সব পদের চল হয়েছে দেশের সব অঞ্চলেই। কোরবানির ঈদের পরের দিন সকালে ঝাল ঝাল করে মাংস, কলিজা মিলিয়ে রান্না করা হয়। চুলা থেকে নামানো মাংসের মাখা ঝোলে চুবিয়ে নীলফামারী সহ রংপুর বিভাগের আট জেলায় খাওয়া দেশী মুড়ি বা চালের আটার ধবধবে নরম রুটি। পবিত্র রমজান মাসে মুড়ির যেমন চাহিদা থাকে তেমনি এই কোরবানীর ঈদেও মুড়ির চাহিদা অনেক বেশী। কারন মুড়ি ছিটিয়েও খাওয়া হয় ঝাল ভুনা মাংস। ঈদের দ্বিতীয় দিন এমন খাওয়ার প্রচলন দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্য বহন করে আসছে গ্রামবাংলায়। ঈদের মাংসের নানা বিশেষ পদের যেন শেষ নেই।
পবিত্র রমজান মাসের মতো পবিত্র কোরবানীর ঈদের একদিনে মংস মুড়ির ভোজে মুড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। আর এ কারনে মুড়ির গ্রামগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠে। চারদিকে মুড়ি ভাজার ঝনঝন আর শনশন শব্দ। নারিকেলের খিল আর পাট সোলা দিয়ে মাটির পাতিলে চাল নাড়ছেন। আবার কেউ মাটির চুলায় জ্বাল দিচ্ছে। এভাবে বাড়িতে বাড়িতে মুড়ি ভাজতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন।হাতে ভাজা মুড়ি কার না পছন্দ? ভেজালের ভিড়ে হাতে ভাজা মুড়ির বেশ চাহিদা রয়েছে।হাতে ভাজা মুড়ির গ্রাম হিসেবে পরিচিত নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের হিন্দুপাড়া। শহর থেকে গ্রামে মুড়ির চাহিদা এখন অনেক। বিশেষ করে ঝাল মসলারমুড়ি বিক্রেতাও বেড়েছে। তবে হাতে ভাজা মুড়ি স্বাস্থ্যসম্মত ও খেতে সুস্বাদু। অপরদিকে, মেশিনে তৈরি মুড়ির দাম তুলনামূলক কম ও আকারে বড়।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে হাতে ভাজা মুড়ি স¤পর্কে জানতে চাইলে মিহির কুমার সাহা (৫৪) নামে একজন জানান, সপ্তাহে ৮-১০ মণ মুড়ি বিক্রি করেন। বিশেষ বিশেষ দিনে বা উৎসবে মুড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। যেমন রমজান মাসে ও কোরবানীর ঈদে।
পারিবারিক পেশা হিসেবে ছেলেবেলা থেকেই মুড়ি তৈরি করছেন নরেন সাহা (৬২)। বর্তমানে ছেলে ও ছেলের বউ তাঁকে এই কাজে সহায়তা করেন। আলাপকালে নরেন সাহা জানান, মেশিনে তৈরি মুড়িতে ইউরিয়া থাকে বলে সেগুলো দেখতে ভালো হয়। হাতে ভাজা মুড়িতে শুধু লবণ ও পানি ব্যবহার করা হয়। মেশিনে তৈরি প্যাকেটজাত মুড়ির দাম তুলনামূলক কম। তবে গ্রামাঞ্চল বা শহরে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা রয়েছে বেশ। কোরবানীর ঈদে মুড়ির চাহিদা অনেক। তাই এখন থেকে মুড়ি তৈরী করে প্যাকেট করা হচ্ছে। তিনি জানান বর্তমানে ধান, কাঠ, বালি, মাটির হাঁড়ির দাম বেড়েছে। হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা মেটাতে এর দামও বেশী পড়ে। নরেন সাহার ছেলে সুবল সাহা (৩২) জানান, ৪০ কেজি ধান কিনতে হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। চাল সিদ্ধ করতে, শুকাতে, প্রস্তুত করতে খরচ হয় আরও ২০০ টাকা। ৪০ কেজি মোটা চাল থেকে প্রায় ২৪ কেজি মুড়ি তৈরি করা হয়। সব মিলিয়ে এক কেজি মুড়ি তৈরি করতে খরচ হয় ৭২-৭৫ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ১০০ টাকা দরে খুচরা বিক্রি হয়। পাইকারি বিক্রি হয় ৯০ টাকা কেজি দরে।
মুড়ি অনেকেরই পছন্দের খাবার। খালি পেটে সাদা মুড়ি খেলে গ্যাসের সমস্যার উপশম হয় বলেও অনেকে বলে থাকে। বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদরা বলেন, রাসায়নিক ছাড়া ভাজা হলে মুড়ি নিরাপদ খাবার।মুড়ি বিশুদ্ধ ও মজার একটি খাবার, এতে সন্দেহ নেই। তবে হোয়াইট রাইস থেকে তৈরি বলে পুষ্টিগুণ কিছুটা কম থাকে। হাতে ভাজা মুড়ি হলো নিরাপদ। তবে কেউ যদি মুড়ি সাদা করার উদ্দেশ্যে কোনো ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করে, সেই মুড়ি খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে।
কারখানায় মুড়ি তৈরি করা হয় সাধারণত পলিশ করা চাল থেকে। আবরণ তুলে ফেলা হয় বলে সাধারণ মানের চালের চেয়ে পুষ্টিগুণ এই চালে কিছুটা কম। মুড়ির মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণে চর্বি, কার্বোহাইড্রেট, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, হজমে উপকারী ফাইবারসহ বিভিন্ন পুষ্টিগুণ রয়েছে। ক্যালরি তো আছেই।চাল প্রক্রিয়াজাত করে ফুলিয়ে মুড়ি তৈরি করা হয়। এ খাবারটি সহজে পেট ভরিয়ে দেয়। এটি দ্রুত হজমও হয়। মুড়ি ঘরোয়াভাবে হাতে এবং কারখানায় যান্ত্রিকভাবে এই দুই পদ্ধতিতেই বানানো যায়।