ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

গ্যালিলিওতে উজ্জীবিত নাটকপাড়া

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১১ অক্টোবর ২০১৮

গ্যালিলিওতে উজ্জীবিত নাটকপাড়া

সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এই সত্য আবিষ্কার করাও ছিল পাপ। তথাকথিত রাষ্ট্রনীতির বিপরীতে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও তার এই আবিষ্কারকে উপস্থাপন করতে পারেননি। প্রচলিত বিশ্বাস ভঙ্গে যদি ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে যায় সেই ভয়ে চার্চ এই আবিষ্কারকে অস্বীকার করে। খড়গ এসে পড়ে তারই মাথার ওপর। ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বীকার করাতে বাধ্য করে এতদিন যা বলেছেন সবই ভুল। পরিণতি বন্দীদশা। তবে বন্দী অবস্থায় রাত জেগে লিখেছেন এবং তা কপি করে রেখেছেন গ্লোবের ভেতর। এরপর তার ছাত্র আন্দে সার্তির হাতে পাচার করে দেন দেশের বাইরে। তিনি যা বিশ্বাস করতেন বা আবিষ্কার করেছেন, ‘ডিসকোর্সি’ নামের লেখায় তাই তিনি বর্ণনা করেছেন। তার এই কাহিনী নিয়েই নাটক লেখেন বার্টোল্ড ব্রেশট। নাটকের নাম দ্য গ্যালিলিও গ্যালিলি। নাটকটি অনুবাদ করেছেন আবদুস সেলিম। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এ নাটকটি প্রথম প্রযোজনা করেছিল ১৯৮৮ সালে। খ্যাতিমান নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা আতাউর রহমান তখন নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এবার ২০ বছর পর নাগরিকের প্রযোজনায়ই মহিলা সমিতির নবনির্মিত নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে গত শুক্রবার মঞ্চায়িত হয় নাটকটি। এবার নির্দেশনায় ছিলেন পান্থ শাহরিয়ার। আড়াই ঘণ্টা ব্যাপ্তির নাটকটি এবার কমিয়ে আনা হয়েছে দেড় ঘণ্টায়। মঞ্চের বলিষ্ঠ অভিনেতা, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, কাওসার চৌধুরী প্রমুখ নাটকটিতে অভিনয় করেন। নতুন করে নাটকটি প্রযোজনায় যে ইতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হয়েছে তা হলো দর্শকের উপচে পড়া ভিড়। টিকেটের জন্য হাহাকার। দর্শকদের নানা আকুতি মিনতি যেন দাঁড়ানোর টিকিট দেয়া হয়। সত্যি ভাল শিল্পের গ্রহণ যোগ্যতা কমে যায়নি। গল্প এবং অভিনয় যদি শিল্পমান বজায় রাখতে পারে তবে দর্শকের কমতি হয় না। বেঁচে থাকে শিল্প। বছর দুই আগে ঈদের ছুটির মধ্যে সৈয়দ জামিল আহমেদের রিজওয়ান নাটকটি সাড়া ফেলেছিল নাট্যাঙ্গনে। অনেকেই টিকেট না পেয়ে ভারাক্রান্ত মনে ফিরে গিয়েছিল সেদিন। আজ অনেক কথা হয়ত ওঠে মঞ্চপাড়ায়। দর্শকরা নাটক দেখতে চায় না। কথাটা একেবারে সত্যি নয়। এমনকি চলচ্চিত্রের বেলায়ও ঠিক একই দৃশ্য দেখা যায় মাঝে মাঝে। অর্থাৎ ভাল প্রযোজনা সে যে ফরমেটেই হোক না কেন তার দর্শক চাহিদা থাকবেই। মনোমুগ্ধকর এই প্রযোজনায় আলী যাকের যেভাবে চরিত্রায়ন করেছেন, তা নতুন শিল্পীদের আবারও উজ্জীবিত করবে। নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করে তিনি যা উপহার দিলেন ওই নীলিমা ইব্রাহিম মঞ্চে এ যেন চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো।এ কেবল কিংবদন্তি নাট্যাভিনেতার দ্বারাই সম্ভব। কাহিনীর পরিবর্তন অর্থাৎ চার্চের বন্দী জীবনে প্রবেশের পূর্বাপর নিজেকে পরিবর্তন অর্থাৎ চরিত্রায়নে ছিল যথাযথ উপস্থাপন। একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে নিজের ভেতর ধারণা করা আর তার বহির্প্রকাশ ঘটানো যেন আলী যাকের দ্বারাই সম্ভব। অন্যদিকে পোপের ভূমিকায় ছিলেন আরেক বলিষ্ঠ অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। অভিনেতা হিসেবেই যিনি মানুষের হৃদয় কেড়েছেন। সকলের কাছে নন্দিত হয়েছেন। যে বাকের ভাইকে শাস্তি প্রদানে সারা বাংলায় মানুষ মিছিল বের করেছিলেন তার সঠিক দৃশ্যায়ন হয়েছে এই নাটকে। ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে এক মানবিক পোপ থেকে যে স্বৈরাচারী পোপের রূপান্তর তার শতভাগ সফলভাবে তিনি দর্শকদের দিতে পেরেছেন। এ অভিনয় শুধু অভিনয়ই নয়, নাট্যজগতের উদাহরণ। আমাদের তরুণ শিল্পীদের পাথেয়। মঞ্চনাটকের অবস্থান বিগত এক দশক হতে কিছুটা উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাট্যকলা বিভাগ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষতজনেরা সেখানে পাঠদান করছেন। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে উন্নত কারিগরি সহযোগিতা। আলোক প্রক্ষেপণে যুক্ত হয়েছে নানামাত্রিকতা। গবেষণা হচ্ছে নাটক নিয়ে। নতুন নতুন তরুণ নাট্য লেখক ভাল ভাল নাটক লিখছেন সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত তরুণেরা যুক্ত হচ্ছে অভিনয় ও নির্দেশনায়। সর্বোপরি মঞ্চ শিল্প উন্নতমাত্রা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে। এ অবস্থায় এই গ্যালিলিও নাটকটি কলাকুশলীদের নতুনভাবে প্রাণের সঞ্চার করে দিয়েছে। আবারও বলছি ভাল প্রযোজনা বা শিল্পের দর্শকপ্রিয়তা কখনও হারায় না। তাই ১৬ কোটি মানুষের দেশে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা খুবই সহজ। চাই শুধু একনিষ্ঠতা আর পরিশ্রম, জয়তু গ্যালিলিও।
×