ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

৩১ দিন পর সোমালীয় জলদস্যুদের কবল থেকে ছাড়া পেল ২৩ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ

মুক্তিপণে মুক্ত জাহাজ

মোয়াজ্জেমুল হক/নয়ন চক্রবর্ত্তী

প্রকাশিত: ০০:০২, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তিপণে মুক্ত জাহাজ

জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুক্তিপণেই মুক্তি এলো। কাঁড়ি কাঁড়ি ডলারভর্তি প্যাকেট সাগরে নিক্ষিপ্ত হলো। উল্লসিত জলদস্যু দল সেই প্যাকেট দ্রুত কুড়িয়ে নিল। তার পরই এলো কাক্সিক্ষত মুক্তির ঘোষণা। সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার ৩১ দিন পর নানা নাটকীয় ঘটনা শেষে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিক অবশেষে মুক্তির স্বাদ পেলেন। জাহাজের ক্যাপ্টেনসহ সব নাবিক সুস্থ রয়েছেন।

শনিবার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ৩টার দিকে (সোমালীয় সময় শনিবার রাত ১২টা) মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ হাতে পাওয়ার পর সোমালি জলদস্যুদের পক্ষে ‘নাউ ইউ আর ফ্রি’ ঘোষণা দিয়ে তারা জাহাজ থেকে নেমে অপেক্ষমাণ স্পিডবোটযোগে তীরের দিকে চলে যায়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে। সোমালীয়  উপকূল অতিক্রম করার পর জাহাজটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্পেন ও ইতালীয় নৌ বাহিনী পাহারা দিয়ে ভারত মহাসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অতিক্রমে সহায়তা করেছে। জাহাজটির আগামী ১৯ বা ২০ এপ্রিল দুবাই পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

সেখানে পণ্য খালাসের পর নাবিকদের পুনরায় জাহাজে থাকা অথবা দেশে ফিরে আসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মালিক পক্ষ- চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেড। জাহাজটি মুক্তি লাভের ঘোষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরসহ সব মহলে স্বস্তি এসেছে। নাবিকদের ভাগ্যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যাতে না ঘটে সে লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও জাহাজ মালিক পক্ষ। যে কারণে কোনো ধরনের সামরিক অভিযান চালানোর পক্ষে সায় দেওয়া হয়নি। 
জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানানো হয়েছে, জাহাজ ও ২৩ নাবিকের মুক্তির বিপরীতে ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ (প্রকাশ করা যাবে না এমন চুক্তি) সম্পন্ন হয়। যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কেনিয়া এবং সোমালিয়ার আইন মেনে  চুক্তিতে কমপক্ষে ৭ পক্ষ স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী একটি টেক্সিফ্লাইট (ছোট আকৃতির উড়োজাহাজ) যোগে বিশেষ কায়দায় মোড়ানো এয়ার টাইট ও ওয়াটার প্রুফ প্যাকেটে ভর্তি ডলার তিন দফায় স্পিডবোটে অপেক্ষমান জলদস্যুদের জন্য সাগরে নিক্ষেপ করা হয়।

সে এক বিরল দৃশ্য। পরে জলদস্যুরা এসব ডলারভর্তি প্যাকেট তুলে নিয়ে পুনরায় জাহাজে যায়। এরপর গুনে গুনে চুক্তি অনুযায়ী ডলার পেয়ে যাওয়ার পর তারা উল্লাস প্রকাশ করে জাহাজটিকে মুক্তির ঘোষণা দিয়ে অপেক্ষমাণ একটি বোটে নেমে যায়। এ সময় জলদস্যুর সংখ্যা ৬৫ ছিল বলে জানা গেছে। এর আগে শনিবার বিকেলের দিকে ছোট আকৃতির বিমান এমভি আবদুল্লাহর অবস্থান এলাকায় চক্কর দেয়। এ সময় ক্যাপ্টেনসহ সকল নাবিককে জাহাজের ডেকে দাঁড় করানো হয়।

নাবিকরা ইতিবাচক হাত নাড়ায়। ২৩ জনের অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর বিমানটি ফিরে যায়। এরপর শুরু হয় সাগরে ডলারের প্যাকেট নিক্ষেপ কার্যক্রম। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও চিত্রে দেখা যায় বিমান থেকে ডলারের প্যাকেট ছোড়ার দৃশ্য। তিন দফায় বিমান থেকে ডলারভর্তি প্যাকেট নিক্ষেপ করতে দেখা যায়। দুটি স্পিডবোটযোগে অপেক্ষমাণ জলদস্যুরা এসব প্যাকেট সাগরের বুক থেকে সংগ্রহ করে।

এ দৃশ্য জাহাজের সব নাবিক যেমন প্রত্যক্ষ করেছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে বিশে^র নানা মহলও দেখেছে। জানা গেছে, সোমালি জলদস্যুরা ২০০৯ সাল থেকে জাহাজ ছিনিয়ে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় এবং পরে রফা করে ডলার আদায় করে আসছে। সম্পূর্ণ বেআইনি এ জাতীয় ঘটনা পরবর্তী সময় বিভিন্ন পক্ষ যুক্ত হয়ে আইনিভাবে চুক্তি সম্পাদন করে মুক্ত করছে জাহাজ ও নাবিকদের। এটিই এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। একটি বেআইনি তৎপরতাকে আইনে রূপ দিয়ে জাহাজ এবং নাবিকদের মুক্তির পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। 
এদিকে, সোমালিয়াসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে, মুক্তিপণ হিসেবে ৫ মিলিয়ন ডলার (৫০ লাখ ডলার, বাংলাদেশী টাকায় ৫৫ কোটি টাকার সমান) প্রদান করা হয়েছে। যদিও জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি স্বীকার করলেও তা কত ছিল জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অপরদিকে, নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, মুক্তিপণের অর্থ প্রদানের বিষয়টি সরকারের জানা নেই।

শিপিং সেক্টরের সূত্রগুলো জানিয়েছে, জলদস্যুরা শুরু থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পক্ষ নিযে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পর গত শনিবার ভোরে ছিনতাই নাটকের অবসান ঘটে। 
কেএসআরএমের সিইও মেহেরুল করিম সরাসরি সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেননি কত  মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। তিনি বলেছেন কীভাবে কী করা হয়েছে তা বলা যাবে না। প্রকাশ না করতে চাপ রয়েছে।  তা প্রকাশ করা যাবে না। সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী মুক্তিপণের বিষয়টি প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে শিপিং সেক্টরের দায়িত্বশীল সুত্রগুলো জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিমা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে সবকিছু সম্পাদন করেছে।

মুক্তিপণ হিসেবে ডলারও তারা প্রদান করেছে। বিমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাহাজটি নিয়ে যেহেতু চুক্তি রয়েছে সেহেতু তারাই বিষয়টি সম্পাদন করেছে বিভিন্ন পক্ষের সহযোগিতা নিয়ে। 
কত মুক্তিপণে ছাড় ॥ এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিককে মুক্ত করতে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ প্রদান করতে হয়েছে। এই অর্থ জাহাজটির বিমা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি বিমা প্রতিষ্ঠান এই অর্থ পরিশোধ করেছে। কিন্তু মুক্তিপণের অর্থ কী পরিমাণ তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। সোমালীয়ভিত্তিক বিভিন্ন অনলাইন নিউজ এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিপণের অর্থ ৫০ লাখ ডলার বলে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, জলদস্যুদের একজন আবদি রশিদ ইউসুফ বলেছে, ‘দুই রাত আগেই ডলার আনা হয়েছে। আমরা যাচাই করে দেখেছি, ডলারগুলো আসল না জাল। আসল নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা ডলারগুলো কয়েকটি দলের মধ্যে ভাগ করে সরকারি বাহিনীকে এড়িয়ে জাহাজ ত্যাগ করি।’ সকল নাবিকসহ জাহাজটিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানায় আবদি রশিদ ইউসুফ। 
সময় লেগেছে ৩১ দিন ॥ এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিককে মুক্ত করতে সময় লেগেছে ৩১ দিন। এর আগে একই মালিক পক্ষের অপর জাহাজ এমভি জাহান মণি সোমালীয় জলদস্যুরা ছিনতাই করেছিল ২০১০ সালে। 
এটিকে মুক্ত করতে সময় লাগে ৯৯ দিন। অভিজ্ঞতা কম থাকায় জাহান মণি উদ্ধারের সময় লাগে বেশি। কিন্তু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর এমভি আবদুল্লাহকে স্বল্প সময়ে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে মালিক পক্ষ। উল্লেখ্য, এমভি আবদুল্লাহর আগে মুক্তিপণ ছাড়াই বুলগেরীয় জাহাজ এমভি রুয়েনকে ও ভারতীয় নৌবাহিনী কমান্ডো অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে গত ১৬ মার্চ। টানা ৯০ দিন জিম্মিদশায় ছিল এ জাহাজটি। এরও আগে ইসরাইলের একটি জাহাজ ছিনতাই করেও সফল হয়নি সোমালীয় জলদস্যুরা। 
একদিনের মাথায় আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী এ জাহাজটি উদ্ধার করে। সোমালীয় উপকূলে জলদস্যু তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। এরপর দস্যুতা কমে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ান আর্থ ফিউচার ফাউন্ডেশনের ওশান্স বিয়ন্ড পাইরেসি প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১১ সালে ৩১টি জাহাজ মুক্তিপণ দিয়ে সোমালীয় জলদস্যু কবল মুক্ত করা হয়। প্রতিটি জাহাজ ছাড়া পেতে গড় সময় লেগেছে ১৭৮ দিন। এ ছাড়া ২০১২ সালে মুক্তিপণ দিয়ে ৮টি জাহাজ ছাড়িয়ে আনতে সময় লেগে যায় ৩১৬ দিন। 
এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিককে মুক্ত করতে অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেএসআরএমের ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত। তিনি জানিয়েছেন, দস্যুদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি সমঝোতার প্রক্রিয়াটি গুছিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করায় আবদুুল্লাহকে দ্রুত উদ্ধার করে আনা সম্ভব হয়েছে। 
মুক্তিপণ নিয়ে তীরে ওঠার পর ৮ জলদস্যু গ্রেপ্তার ॥ সোমালিয়াভিত্তিক ‘গারোই’ অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিপণ নিয়ে সোমালিয়ার উপকূল থেকে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে মুক্তি দেওয়ার পর দস্যুরা তীরের দিকে চলে যায়। তীরে ওঠার পর ৮ জলদস্যুকে সে দেশের পান্টল্যান্ড পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ওই অনলাইনে সোমালিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডে পদস্ত পুলিশ কর্মকর্তার বরাদ দিয়ে এ খবর প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এদের কাছ থেকে মুক্তিপণের কোনো অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে কি না তা জানানো হয়নি। 
এদিকে, এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ ক্রুর মুক্তির ঘোষণায়  উল্লসিত হয়ে পড়েন। তারা মোবাইল ফোনে দেশে নিজ নিজ আত্মীয়স্বজন এবং মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। দেশে স্বজনরাও এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর আপ্লুত হয়েছেন। জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করায় কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের ডিএমডি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, এমভি আবদুল্লাহ ইতোপূর্বে গোল্ডেন হক নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক ক্যারিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৭৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ১৬ মিটার। গত বছর এসআর শিপিং এ জাহাজটি ক্রয় করে। এরপর থেকে জাহাজটি আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করে আসছে। এ সংস্থার আরও ২৩টি জাহাজ রয়েছে। 
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি গত ১২ মার্চ দুপুরে ভারত মহাসাগরে সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জাহাজের ২৩ নাবিককে জিম্মি করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় সে দেশের গারাকাট বন্দরের গদভজিরান এলাকায়। জাহাজটি আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাফুতু বন্দর থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের আলহামরিয়া বন্দরের দিকে যাওয়ার পথে সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে পড়ে। 
জাহাজের নাবিকদের মধ্যে রয়েছেন ক্যাপ্টেন মো. আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহারুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকনুদ্দীন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রেশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মো. শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশারফ হোসেন সাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নূর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
জলদস্যু প্রধানের চিঠি ॥ মুক্তিপণের অর্থ হাতে পাওয়ার পর জলদস্যু গ্রুপের প্রধানের পক্ষে এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদকে একটি চিঠি হস্তান্তর করা হয়। সোমালিয় ভাষায় লেখা ওই চিঠির অর্থ হচ্ছে, ‘তোমাদেরকে মুক্তি প্রদান করা হলো। তোমরা এখন নিরাপদ। 
নতুন করে জলদস্যুদের কবলে পড়তে হবে না। তোমরা এখন তোমাদের গন্তব্যে ফিরে যেতে পার। যাওয়ার পথে কেউ পুনরায় কোনো ঘটনা ঘটাতে চাইলে তাদের এই চিঠি দেখাবা। চিঠি দেখলে তারা ছেড়ে দেবে।’ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষ। 
কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ যা বলেছে ॥ এদিকে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি লাভের ঘটনা নিয়ে রবিবার দুপুরে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ পক্ষ প্রেস ব্রিফিং করে। ব্রিফিংয়ে সংস্থার সিও মেহেরুল করিম, ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত বক্তব্য রাখেন। চট্টগ্রামের বারিক বিল্ডিং এলাকায় জাহাজটির মালিক পক্ষ কবির গ্রুপের কার্যালয়ে আয়োজিত  প্রেস কেএসআরএমের সিইও মেহেরুল করিম বলেন, ১৩ বছর আগে আমাদের এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল জাহান মণিতে। তখন আমাদের জ্ঞানের অভাব ছিল, যার ফলে জাহাজটা উদ্ধার করতে সময় বেশি লাগে। 
জাহান মণির ওই অভিজ্ঞতার আলোকে এমভি আবদুল্লাহর ব্যাপারে আমরা প্রথম থেকে যেটা যেভাবে করা দরকার, সেভাবে এগিয়েছি। জাহাজটা দস্যুরা জিম্মি করার পর সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যায়। 
যে মুহূর্তে জাহাজটা দস্যুরা তাদের দখলে নিয়েছে, সেই থেকে আজ পর্যন্ত (রবিবার) পজিশন এমনকি জাহাজটা কোথায় আছে, কিভাবে আছে তা আমরা জানতে পেরেছি ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে। জলদস্যুদের একজন কমান্ডার আছে, তার এক সহযোগী ইংরেজি বলতে পারে। সেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। প্রথম দিনই আমরা মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে চলে এসেছে যে, তাদের মধ্য থেকে কে যোগাযোগ করবে, তার নাম কি।

আর আমাদের মধ্য থেকে কে যোগাযোগ রাখবে। প্রতিদিনই তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছিল। কথার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাহাজের নাবিকরা কেমন আছে, কত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজ মুক্ত করা সম্ভব হবে এবং তারা জাহাজটি কবে ছেড়ে দেবে। এসব বিষয় অবগত হওয়া। 
তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে জড়িত। প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শিপিংয়ের ‘রুলস অ্যান্ড ল’ মেনে চলতে হয়। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে। আবদুল্লাহ ছিনতাই হওয়ার প্রথমদিন থেকেই আমরা যোগাযোগ শুরু করেছি। প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে কথা হতো। আমরা এসব একজন আরেকজনের সঙ্গে শেয়ার করতাম। ৩০ দিন আমরা যোগাযোগ করেছি।

শেষ দুই দিন আগে দস্যুদের কাছে আমাদের যে রিকোয়েরমেন্ট ছিল তা হলো- আমরা প্রতিটা নাবিকদের ভিডিও চাই। আমরা ভিডিও নিয়েছিলাম। এসব ভিডিও আমাকে পাঠিয়েছিল। ওটা হওয়ার পর আমাদের উদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রতিটা কাজ আমরা লিগ্যালি করেছি। কোনোটার ক্ষেত্রে আমরা আমেরিকার নিয়ম মানতে হয়েছে। কোনোটার ক্ষেত্রে আমাদের ইউকে’র নিয়ম মানতে হয়েছে। সোমালিয়ার নিয়মও মানতে হয়েছে। 
আমাদের কোনো অবস্থায় রুলসের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সর্বশেষ শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে প্রথম মেসেজ আসে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয় জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। ৬৫ জন দস্যু ছিল। তারা ৯টি বোটে করে চলে যায়। যারা ছিল জাহাজে তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাহাজ মালিক পক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমরা ক্রুদের জন্য যা যা করা দরকার সব করব। ২০ তারিখ দুবাই পৌঁছাবে জাহাজ। 

অনেকে জানতে চাইছেন বিকল্প ক্রু সেট আপ করেছি কিনা! স্পষ্টভাবে বলতে চাই, কোনো ক্রু সেটআপ করিনি। বিকল্প ক্রুও রেডি করা হয়নি। কারণ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা কিভাবে ফিরবেন এখনো সে সিদ্ধান্ত হয়নি। তাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে বাকি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। 
২০১০ সালে এমভি জাহান মণি গ্রিসের পথে পণ্য নিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তির পর নাবিকরা জাহাজ নিয়ে কাতারে যায়। কিন্তু পণ্য ইউরোপে খালাসের কথা ছিল। তাই বিকল্প নাবিকদের যেতে হয়। এমভি আবদুল্লাহর পণ্য দুবাইতেই খালাস হবে। সেখান থেকে জাহাজেরও দেশে ফেরার কথা। এখন নাবিকরাই ঠিক করবেন তারা কিভাবে দেশে ফিরবেন। আমরা তাদের সঙ্গে আগে কথা বলব। ওরা সেটেল হোক।

ওদের মতামত  নেব। জাহান মণি ১শ’ দিন পরে উদ্ধার হয়েছিল, তখন ক্রুদের ভিসা দুবাই, ওমান কিংবা সিঙ্গাপুরে পাইনি। লম্বা সময় হয়ে যাবে বলে ফুল সেট আপ ক্রু আগে থেকে রেডি করে রিপ্লেস করেছি। আবদুল্লাহ ক্ষেত্রে বিষয় হলো জাহাজটি দুবাই যাচ্ছে, সেখান থেকে আমাদের প্রচেষ্টা আছে। জাহাজটি কার্গো নিয়ে চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হবে। 
জাহাজটির টেকনিক্যাল কন্ডিশনও দেখতে হবে সেখানে। নাবিকদের কাছে অপশন থাকবে তারা কি জাহাজে আসবেন নাকি ফ্লাই করে আসবেন। 
মুক্তিপণ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এ যোগাযোগের ক্ষেত্রে নমিনেটেড ইনচার্জ। ইন্টারন্যাশনালি ও লোকালি। এটা খুবই গোপনীয়। ওদের সঙ্গে আমার একটি কমিটমেন্ট আছে। আমাকে আপনারা যতই চেষ্টা করেন আমি কিছুই শেয়ার করতে পারব না। এ ব্যাপারে আমি ক্ষমা চাইছি। কারণ আমি এটা সাইন করেছি। আমরা আমেরিকা, ইউকে, সোমালিয়া এমনকি চূড়ান্তভাবে কেনিয়ার নিয়ম মেনেছি। এ বিষয়ে কোনো কথা আমি শেয়ার করতে পারব না। 
এর আগে সংস্থার ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, শনিবার দিবাগত রাতে দস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে চলে যায়। আমরা এতদিন সরাসরি বেশ কিছু কারণে সামনে আসিনি। দস্যুরা যদি মালিক পক্ষের পরিচয় পায়, তা হলে তারা মালিক পক্ষকে  টার্গেট করে আরও ইস্যু হাসিলের চেষ্টা করতে পারে। এখন যেহেতু দস্যুমুক্ত হলো এ বিষয়ে এখন কথা বলতে সাংবাদিকদের সামনে এসেছি। নববর্ষ এসেছে, নাবিকদের মুক্ত করা গেছে এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। 
গত ১২ মার্চ অস্ত্রের মুখে জলদস্যুরা জাহাজটি আটক করে এবং নাবিকদের জিম্মি করে। এরপর থেকে আমরা নাবিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। এরপর থেকে আমরা কাজ শুরু করি, কত দ্রুত তাদের মুক্ত করা যায়। নেগোসিয়েশন শেষে তারা মুক্ত হয়েছে। 
ভোরে দস্যুরা জাহাজ ছেড়ে চলে যায়। জাহাজ ও জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করতে সহযোগিতা করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কবির গ্রুপের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শাহরিয়ার হাসান রাহাত।
অনেকে আর্মস গার্র্ড নিয়ে কথা বলেছেনÑ এ বিষয়ে বলতে চাই, আমরা হাইরিস্ক এরিয়ার দ্বিগুণ বাইরে ছিলাম। ৬শ’ নটিক্যাল মাইলের দিকে যাচ্ছিল জাহাজটি। যে অঞ্চলে ছিনতাই হয় জাহাজটি সেখানে তখন যুদ্ধজাহাজ কম ছিল কারণ হুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিল জাহাজগুলো। 
এমভি আবদুল্লাহকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর কাছাকাছি থাকা কয়েকটি বিদেশী যুদ্ধজাহাজ ‘ফোর্সফুলি টেকওভার’ করবে কিনা জানতে চায় তিনি বলেন, আমরা এবং সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে যাব না জানানোর পর তারা আর এগোয়নি। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা কিছু বিষয় আলাপ করতে পারব না। কারণ আমরা দস্যুতাকে উৎসাহ দিতে পারব না। আমাদের বাধ্যবাধকতা আছে। 
এদিকে বাংলাদেশ সময় শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে মুক্তি পায় এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিক; এরপর রবিবার দুপুর পৌনে ২টায় নিজের ফেসবুক আইডি থেকে প্রথম পোস্ট দেন জাহাজটির চিফ অফিসার আতিকউল্লাহ খান। মুক্তির পর নিজেদের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের কয়েকটি ছবি পোস্ট করে তিনি লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টার জন্য এসআর শিপিংকে ধন্যবাদ। বন্ধু, পরিবার ও সকল শুভাকাক্সক্ষীর প্রতি কৃতজ্ঞতা যারা পুরো যাত্রায় আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন। ধন্যবাদ ইইউএনএভিএফওআর অপারেশন আটলান্টা। ধন্যবাদ বাংলাদেশ। লাভ ইউ অ্যান্ড মিসিং ইউ বাংলাদেশ।’
জাহাজে নাবিকদের ঈদ উদ্যাপন ॥ সোমালিয়ায় গত বুধবার ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতর। দিনটি উদ্যাপনের জন্য নাবিকরা জলদস্যুদের অনুমতি চায়। অনুমতি পাওয়ার পর নতুন পোশাক পরে নাবিকরা জাহাজে ঈদের নামাজ আদায় করেন। পরে সেমাই রান্না করে সকলে খান। এ সময় জলদস্যুদের সশস্ত্র কড়া পাহারা ছিল। ঈদের নামাজ শেষে নাবিকদের সুযোগ দেওয়া হয় মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার।

মুক্তি তাদের আসন্ন বিষয়টি আগেভাগেই নাবিকরা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তাদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ কাজ করছিল। যা তারা বিভিন্নভাবে স্বজনদের কাছে প্রকাশও করে। 
কবে ফিরছেন নাবিকরা ॥ সোমালিয়া জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক কবে দেশে ফিরছেন তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে জাহাজটি দেশে ফিরিয়ে এনে প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিক পক্ষ। সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নাবিকরা আগেভাগে দুবাই থেকে সরাসরি বিমানযোগে দেশে ফিরতে পারেন। অথবা পণ্য খালাসের পর জাহাজযোগে আসতে পারেন। 
ফেরার অধীর আগ্রহে স্বজনরা ॥ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনরা। নাবিকদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের। বাকিরা ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার। জাহাজটির চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের স্বজনদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার তাদের ঈদ হয়নি। 
হয়েছে গত রবিবার নাবিকদের মুক্তি লাভের খবর পাওয়ার পর। আতিকুল্লাহ খানের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। তার পক্ষে বরাবরই তার শ^শুর ও শাশুড়ি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে আসছিলেন। রবিবারও তারা তাদের ঈদ আনন্দের কথা জানিয়েছেন।

×