ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘সিঙ্গল ডিজিট’ নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা

কিছু বেসরকারী ব্যাংক সুদের হার কমায়নি

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৩ জুলাই ২০১৮

কিছু বেসরকারী ব্যাংক সুদের হার কমায়নি

রহিম শেখ ॥ অধিকাংশ ব্যাংকই আমানতের সুদ হার কমিয়েছে। কিন্তু ঋণের সুদের হার কমায়নি অধিকাংশ বেসরকারী ব্যাংক। এতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও ব্যাংক মালিকদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেছে কিছু ব্যাংক। ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে কমাতে গিয়ে কোন কোন ব্যাংক শুধু কৃষি ঋণে ৯ শতাংশ সুদ হার নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ঋণের বিপরীতে রয়ে গেছে নানা ধরনের কমিশন, ফি, চার্জ। এসব কারণে ঋণের ঘোষিত সুদ ৯ শতাংশ হলেও বাস্তবে এই হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ হবে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি, মসলা, রফতানি ঋণ, নারী উদ্যোক্তা খাতে ঋণের সুদের হার ৪ থেকে ৯ শতাংশ। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক এখন এসব খাতের ঋণের গড় সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে দেখাচ্ছে। যা সুদের হার কমাতে গিয়ে দেখা গেছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের তারল্য সঙ্কট (নগদ টাকার সঙ্কট) উত্তরণ করে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য সম্প্রতি সরকারের কাছ থেকে চার ধরনের সুবিধা নিয়েছেন বেসরকারী ব্যাংকের মালিকরা। এসব সুবিধা দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী পৃথক দুই অনুষ্ঠানে বলেছিলেন আপনাদের অনেক সুবিধা দিয়েছি, এবার ব্যাংক ঋণের সুদহার কমান। তখন ব্যাংক মালিকরা কথাও দিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে গত ১ জুলাই থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বেসরকারী ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি)। কিন্তু গত এক সপ্তাহ পার হলেও অনেক ব্যাংকই ভোক্তা ঋণের ওপর সুদ হার কমায়নি। যদিও ঘোষণা ছিল সব ঋণের ক্ষেত্রেই সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু কোন কোন ব্যাংক মেয়াদী ঋণ, চলতি মূলধন ঋণ, গৃহঋণ, ব্যবসায় বিনিয়োগে নতুন যে সুদ হার নির্ধারণ করেছে তা সর্বনিম্ন সাড়ে ১০ শতাংশ। ভোক্তাঋণের সুদহার ১৩ শতাংশ। কোন ব্যাংকই পুরোপুরি সব খাতের জন্য সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হার নির্ধারণ করেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, ঋণ ও আমানতের সুদহার ৯ ও ৬ শতাংশ করার সিদ্ধান্তটি সর্বসম্মতভাবেই নেয়া হয়েছে। সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রেই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে, হতেই হবে। জানা যায়, সরকারী খাতের সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক আমানত ও ঋণের সুদের হার কমিয়েছে। এর মধ্যে জনতা ও সোনালী ব্যাংক প্রায় সব ধরনের সুদের ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে এনেছে। আমানতের সুদের হারও তারা কমিয়ে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত রেখেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই হার ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি, এশিয়া, ব্র্যাক, ওয়ান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ইস্টার্ন, প্রাইমসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমায়নি। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক সুদের নতুন হার ৩ জুলাই থেকে কার্যকর করেছে। তারা কৃষিঋণ ছাড়া সব ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের ওপরে রেখেছে। এই হার আগে থেকেই ৯ শতাংশ রয়েছে। তারা মেয়াদী শিল্প ঋণের সুদের হার ভাল গ্রাহকদের জন্য সাড়ে ৯ থেকে ১২ শতাংশ এবং অন্য গ্রাহকদের জন্য ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, চলতি মূলধন বড় শিল্পে ৯ থেকে ১২ শতাংশ, মাঝারি শিল্পে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র শিল্পে সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করেছে। ব্যাংক এশিয়া শিল্প ঋণের সুদের হার সাড়ে ১০ থেকে ১২ শতাংশ এবং চলতি মূলধনে ১০ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করেছে। অন্যান্য ঋণে সুদের হার আরও বেশি রেখেছে। ব্র্যাক ব্যাংক ৩ জুলাই থেকে আমানতের নতুন হার কার্যকর করেছে। তারা আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ সুদ দেবে ৮ শতাংশ। সুদের হারও কমিয়ে আনবে, তবে এখনও ঘোষণা দেয়া হয়নি। ইস্টার্ন ব্যাংক ২ জুলাই থেকে আমানতের সুদের হার কমিয়ে সর্বনি¤œ ২ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু ঋণের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দেয়নি। আইএফআইসি ব্যাংক গত ২৮ জুন ঋণ ও আমানতের নতুন সুদহার নির্ধারণ করে ১ জুলাই থেকে কার্যকর করেছে। তারা কৃষিঋণ ও রফতানি ঋণ ছাড়া বাকি সব ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের ওপরে রেখেছে। এর মধ্যে মেয়াদী ঋণ, চলতি মূলধন, বাণিজ্য ঋণ, গৃহঋণের সুদের হার সাড়ে ১০ থেকে ১১ শতাংশ রেখেছে। ভোক্তাঋণের ১৩ শতাংশ ও ক্রেডিট কার্ডের সুদহার ২৪ শতাংশ রেখেছে। প্রাইম ব্যাংক ৫ জুলাই থেকে নতুন সুদহার কার্যকর করেছে। তারা আমানতের সুদহার সর্বনি¤œ ২ থেকে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ করেছে। ঋণের মধ্যে কৃষি, মসলা, রফতানি খাতে সুদহার ৬ থেকে ৯ শতাংশ, যা আগের অবস্থানেই রয়েছে। ওয়ান ব্যাংক ১ জুলাই থেকে আমানতের সুদহার কমিয়ে সাড়ে ৩ থেকে ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। ঋণের সুদহার এখনও ঘোষণা করেনি। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ঋণের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ চলছে। ধীরে ধীরে কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে সুদের হার সামান্য হারে কমানো হলেও ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো যেসব ফি, কমিশন বা চার্জ আরোপ করে রেখেছে, সেগুলো কমানোর বিষয়ে কোন কথা হচ্ছে না। এগুলোর কারণে ঋণের সুদের হার গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক ভেদে ঋণ নিতে গেলে ১ থেকে দেড় শতাংশ হারে ঋণ প্রসেসিং ফি দিতে হয়। এতে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিলে প্রসেসিং ফি দিতে হয় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। ব্যাংকিং খাতে সাম্প্রতিক সময়ে জালিয়াতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো জামানত রেজিস্ট্রেশন করে নিচ্ছে। এর বিপরীতে কোন কোন ব্যাংক ১ শতাংশ ফি নিচ্ছে। আবার ঋণের বিপরীতে কোন কোন ব্যাংক সার্ভিসিং ফি নিচ্ছে ১ শতাংশ। ক্ষুদ্র বা ভোক্তা ঋণের বিপরীতে তদারকি এজেন্সি কমিশন নিচ্ছে ১ থেকে ২ শতাংশ। কোন ঋণ আগাম পরিশোধ করে দিলে ক্লোজিং চার্জ নিচ্ছে ১ শতাংশ হারে। এছাড়া হিসাব খোলা, হিসাব পরিচালনা, কাগজপত্র তৈরি, গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ- সবক্ষেত্রে ফি রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোন ঋণের সুদকে এক বছরের আগে মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করা যাবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই বিধি ব্যাংকগুলো মানছে না। ব্যাংকগুলো বলছে, তিন মাস পর পর সুদ হিসাব করে তা মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করে সুদকেও মূলধন হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো এখন ঋণের গড় সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে দেখাতে ব্যস্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে কৃষি, মসলা, রফতানি ঋণ, নারী উদ্যোক্তা খাতে ঋণের সুদের হার ৪ থেকে ৯ শতাংশ। এসব খাতে কম থাকার কারণে অন্যান্য খাতে বেশি থাকলেও গড়ে ঋণের সুদের হার কম দেখানো সম্ভব হচ্ছে। ব্যাংকগুলো এখন এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গড় সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য শিল্প ও সেবা খাতে ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। একই সঙ্গে ভোক্তাঋণের সুদের হারও কমাতে হবে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আর শিল্প ঋণের কারণে শিল্প স্থাপন বাড়বে। ব্যাংকগুলো এখন গড় হিসাব করে সুদের হার কম দেখাচ্ছে। বাস্তবে সুদের হার কম নয়।
×