ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৪ আষাঢ় ১৪৩১

ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

কর্মপন্থা ছাড়া পরিত্যক্ত পণ্য কেনার ঘোষণা

​​​​​​​স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২১:৫০, ২৪ মে ২০২৪

কর্মপন্থা ছাড়া পরিত্যক্ত পণ্য কেনার ঘোষণা

.

আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার বংশ বিস্তার নিয়ন্ত্রণে অগ্রিম কিছু পদক্ষেপ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এরই অংশ হিসেবে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পণ্য, চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা, টায়ার প্রভৃতি কেনার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কর্মপন্থা পুরোপুরি না গুছিয়ে এনে তড়িঘড়ি করে ঘোষণা করায় অঙ্কুরেই বিনাশ হতে চলেছে এই উদ্যোগ।

মাঠ পর্যায়ে ঘুরে দেখা যায়, কার্যক্রম পরিচালনায় যে তহবিল দরকার তা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছায়নি। নিজ পকেটের টাকা খরচ করে তা কেনার আগ্রহ হারিয়েছেন কাউন্সিলররা। আবার দিনের নির্দিষ্ট সময় কাউন্সিলর অফিস বন্ধ থাকায় কেনাকাটাও বন্ধ থাকে। মানুষ পরিত্যক্ত পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ফিরে যান। আর গুটিকয়েক যারা বিক্রি করতে যান তাদের অধিকাংশই টোকাই। সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই।

নাগরিকদের অভিযোগ, ডিএনসিসির ঘোষণা অনুযায়ী পরিত্যক্ত পণ্য বিক্রি করতে নিয়ে গেলে আগ্রহ দেখান না কাউন্সিলর অফিসের লোকজন। আবার কয়েকটি ওয়ার্ডে পণ্য কিনলেও টাকা দেওয়া হয় না। তহবিলে বরাদ্দ নেই জানিয়ে নাম-ঠিকানা মোবাইল নম্বর লিখে রাখে। নিয়ে প্রতিটি মহল্লায় অসন্তোষ। ফলে ডিএনসিসির উদ্যোগ শুরুর আগেই মুখ থুবড়ে পড়ছে।

তবে ডিএনসিসির ঊর্ধ্বতনদের দাবি, ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে একযোগে পরিত্যক্ত পণ্য কেনা হচ্ছে। আপাতত কাউন্সিলর নিজ পকেট থেকেই টাকা দিচ্ছেন। শীঘ্রই ডিএনসিসি থেকে অর্থছাড় করা হবে। তখন আঞ্চলিক কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কেনাকাটা চালিয়ে যাবে কাউন্সিলর অফিস। অর্থছাড় করার আগে কেন পরিত্যক্ত পণ্য কেনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, এমন প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হিসেবে ওই উদ্যোগ নেওয়া হয়। আপাতত আঞ্চলিক কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এসব পণ্য কিনতে কাউন্সিলরদের বলা হয়েছে। অর্থছাড় করা হলে যিনি যত টাকার পণ্য কিনেছেন, তাদের টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, ‘পরিত্যক্ত পণ্য কেনার পাশাপাশি ডিএনসিসির সব ওয়ার্ডে একযোগে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এজন্য প্রত্যেক কাউন্সিলরকে প্রতি মাসে আলাদা করে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। কাউন্সিলররা নিজ নিজ এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, মসজিদের ঈমাম, স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে মতবিনিময় সভা শোভাযাত্রার আয়োজন করবেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিফলেট বিতরণ করবেন। যাতে চলতি বছর আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি।ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী চিপসের প্যাকেট বা সমজাতীয় প্যাকেট প্রতি পিস এক টাকা, আইসক্রিম, ডিসপোজেবল কাপ এক টাকা, ডাবের খোসা দুই টাকা, কনডেন্স মিল্কের কৌটা দুই টাকা, মাটি, প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন তিন টাকা, অন্য পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি প্রতি কেজি ১০ টাকা, পরিত্যক্ত টায়ার প্রতি পিস ৫০ টাকা, পরিত্যক্ত পলিথিন প্রতি কেজি ১০ টাকা, পরিত্যক্ত স্যানিটারি ওয়্যার কমোড, বেসিন প্রতি পিস ১০০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে।

এই মূল্যতালিকা ডিএনসিসির প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এই মূল্যতালিকা অনুযায়ী পণ্য কিনছে কাউন্সিলর অফিস। পরে এসব পণ্য সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের বর্জ্য পরিদর্শক আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে নিয়ে ফেলছেন।

মে দুপুর ১১টা। ভাটারার কুড়িল মিয়াবাড়ি রোড। রোডের -১৮৫/ নম্বর হোল্ডিংয়ে ডিএনসিসির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়। সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় এক হাজার বর্গফুট আয়তনের কার্যালয়ের সামনে ছোট একটি ব্যানারে পরিত্যক্ত পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙানো রয়েছে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত স্থানীয় কাউকে পরিত্যক্ত পণ্য নিয়ে কার্যালয়ে ঢুকতে দেখা যায়নি। ভেতরে এক কোণে কয়েকটি বস্তার ভেতর চায়ের কাপ, চিপসের প্যাক, পলিথিন স্তূপ করে রাখা।

ওয়ার্ড সচিব নুরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘মেয়রের ঘোষণার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার টাকার পরিত্যক্ত পণ্য কেনা শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার পণ্য কিনেছি। মহল্লার টোকাইরাই তা বিক্রি করছে।

তবে মে যোগাযোগ করা হলে ভিন্ন কথা বলেছেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ইসহাক মিয়া। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত তার ওয়ার্ডে এক লাখ টাকার বেশি পরিত্যক্ত পণ্য কেনা হয়েছে। এখনো সিটি করপোরেশন থেকে এক টাকাও পাননি। সব নিজের পকেটের টাকা দিয়েই কিনছেন।

এই দুই ভিন্ন বক্তব্যে থেকে সহজেই অনুমেয় যে, এটি সরকারি অর্থ লুটপাটের নতুন একটি উদ্যোগ হতে যাচ্ছে। এতে শুধু সরকারি অর্থেরই অপচয় হবে, বাস্তবে কোনো কাজ হবে না। তাই এসব বর্জ ক্রয়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ড থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহে নুতন একটি মডেল অনেকটাই সফলতার মুখ দেখেছে।

এতে প্রতি মাসে করপোরেশনের ১০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ করে রিসাইকেল করা সম্ভব হচ্ছে। 

মহাখালী সাততলা বস্তি এলাকায় চার বছর ধরে ভাঙাড়ির দোকান চালান আতাহার হোসেন। তিনি জানান, তার দোকানে বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল নিয়ে আসে টোকাইরা। এর মধ্যে প্লাস্টিকের বোতল ৮০ টাকা কেজি, রিসাইকেল করা যায় এমন পলিথিন ৩০ টাকা কেজি, কাগজ ৩০ টাকা কেজি দরে কেনেন। এর বাইরে লোহা, স্টিলের ভাঙা অংশও কেনেন। তবে আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, মাটি, সিরামিক, মেলামাইনের কোনো পাত্র কেনেন না বলে জানান তিনি।

উত্তরার ফায়দাবাদ, কোটবাড়ী, মৌশাইর চালাবন এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড। গত ২২ এপ্রিল থেকে ওয়ার্ডে পরিত্যক্ত পণ্য কিনছেন কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈম। তবে এখন পর্যন্ত বিক্রেতাদের কাউকে টাকা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

ফায়দাবাদ এলাকার বাসিন্দা হাসান জামান বলেন, ‘ডিএনসিসি মেয়রের ওই ঘোষণার পর এলাকার অনেক টোকাই, গৃহকর্মী, পরিত্যক্ত পলিথিন, প্লাস্টিক সংগ্রহ করছেন। অনেক চায়ের দোকানি নিজ দোকানের ব্যবহৃত চায়ের কাপ, পলিথিনও বস্তায় ভরে কাউন্সিলর অফিসে দিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের কাউকে টাকা দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিসুল ইসলাম নাঈম বলেন, ‘ডিএনসিসি থেকে অর্থছাড় না করায় কাউকে টাকা দিতে পারছি না। তবে যারা যারা কাউন্সিলর অফিসে পরিত্যক্ত পণ্য জমা দিচ্ছেন, দিন-তারিখ দিয়ে তাদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর তালিকা করে রাখা হচ্ছে। করপোরেশন থেকে টাকা পেলে সবাইকে ডেকে নিয়ে টাকা বিতরণ করা হবে।

অর্থছাড় না করে কেন ব্যবহৃত পরিত্যক্ত পণ্য কেনা হচ্ছে তা জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘মেয়রের ঘোষণার পর পরই অর্থছাড় করতে দাপ্তরিক কাজ শুরু করেছি। তবে দাপ্তরিক বিভিন্ন কারণে টাকা এখন পর্যন্ত ছাড় হয়নি। আর টাকাটা কাউন্সিলরের হাতে সরাসরি যাবে না। টাকা সংশ্লিষ্ট আঞ্চলের দপ্তরে যাবে।

×