ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবিতে ‘লাল যাত্রা’

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৬ মার্চ ২০২৪

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবিতে ‘লাল যাত্রা’

কালরাত্রির শহীদদের স্মরণে ঢাবির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর থেকে বের হয় নাট্যদল প্রাচ্যনাটের লাল যাত্রা

বসন্ত বিকেলে একরাশ বিষণ্ণতা ভর করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে। দৃশ্যায়িত হলো নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র হায়েনাদের আক্রমণের বিভীষিকাময় অধ্যায়টি। বাঙালির ওপর চালানো পাকিদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ভয়বহতার সূত্র ধরে শোনা গেল করুণ আর্তনাদ। উঠে এলো একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতের ঘটনাপ্রবাহ। সোমবার সেই কালরাত্রির নৃশংসতার ধারাভাষ্য হয়ে উঠল নাট্যদল প্রাচ্যনাটের ‘লাল যাত্রা’ শীর্ষক আয়োজনটি। আর এ আয়োজনের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি নিবেদিত হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি।

অভিনয়, সংগীত ও পদযাত্রায় সজ্জিত পরিবেশনায় স্মরণ করা হলো ওই রাতে প্রাণ হারানো সকলকে। ইম্প্রোভাইজেশন নির্ভর সে পরিবেশনার মাঝে উচ্চারিত হলো ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি। দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাশাপাশি পাকবাহিনীর সংঘটিত ওই গণহত্যার বিচার চাওয়া হলো। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনে ইসরাইলিদের সংঘটিত গণহত্যারও বিচার দাবি করা হয়। ‘দীর্ঘ কালরাত্রির প্রাক্কালে লাখো শহীদের লাল রক্তের পথ ধরে স্বাধীন আমরা হেঁটে চলি ঐক্যের বন্ধনে’ প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত হয় ১৩তম আয়োজনটি।   
ভয়াল কালরাত স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর থেকে ফুলার রোডসংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তন চত্বর পর্যন্ত এগিয়ে চলে ‘লাল যাত্রা’ শীর্ষক পদযাত্রা। প্রাচ্যনাটের সবান্ধব এ যাত্রার পুরোটা সময় সকলের কণ্ঠে গীত হয় ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ শিরোনামের গানটি। স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে পৌঁছার পর প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। লাল যাত্রার মূল ভাবনায় ছিলেন রাহুল আনন্দ।
পাকবাহিনীর নিষ্ঠুরতার ধারাভাষ্যময় পরিবেশনায় স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরও যেন কেঁদে উঠেছিল সেদিনের কথা স্মরণে। শুরুতে বেজে ওঠে রাহুল আনন্দের ফুঁ দেওয়া ট্রাম্পেটের করুণ সুর। সেই শব্দধ্বনির সমান্তরালে কালো পোশাক পরিহিত শিল্পীরা চারপাশ ঘিরে গড়ে তোলে বৃত্ত। এরপর ড্রাম, ঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের উচ্চকিত শব্দতরঙ্গে সৃষ্টি হয় অপারেশন সার্চলাইটের আবহ। বৃত্তবন্দি নিরীহ মানুষের প্রতীকী শিল্পীদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি। তাদের আর্তনাদের মাঝে ধীর পদক্ষেপে রক্তের প্রতীকী লাল রং ছিটিয়ে দিতে থাকেন একজন।

ওই রক্ত¯্রােতের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন সকলে।  এরপর যন্ত্রণাকাতর নিরস্ত্র সেই জনতাকে মুড়ে দেওয়া সাদা কাপড়ে। ওই কাপড়ে রক্তরূপী লাল রঙে লেখা হয় ‘১৯৭১, ২৫ মার্চ, গণহত্যা’। এভাবে গণহত্যার আবহে মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ে সবাই। এক নিমিষে জীবিতরা পরিণত হয় মৃত ব্যক্তিতে। এরপর শহীদদের শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গোলাপের লাল পাপড়ি।

এ সময় প্রাচ্যনাটের মুখ্য সম্পাদক কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমনের ধারাভাষ্যে উচ্চারিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, সংবাদ অফিসসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর চালানো সে রাতের নিষ্ঠুরতার কথা। তিনি বলে যান, ওই দিন রাত ১১টা ১৫ মিনিটে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তখন পাকবাহিনী ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যাবে বাঙালি। কিন্তু  সে ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।

প্রাচ্যনাটের পক্ষ থেকে আমরা সে রাতের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানাই। একই সঙ্গে বর্তমানে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনে সংঘটিত গণহত্যারও বিচার দাবি করছি।  পদযাত্রায় মায়ের চরিত্রটি রূপায়ন করেন ¯œাতা শাহরি।
স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে পৌঁছে শেষ হয় ‘লাল যাত্রা’। এখানে প্রাচ্যনাটের কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্য থেকে মেধা ও  শ্রমের মূল্যায়নের ভিত্তিতে লাল স্যালুট জানানো হয় স্বাতী ভদ্রকে। তাকে সম্মানসূচ মেডেল পরিয়ে দেন প্রাচ্যনাটের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আজাদ আবুল কালাম। আর সম্মানার অর্থমূল্য প্রদান করেন তৌফিকুল ইসলাম ইমন।
লাল যাত্রার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে রাহুল আনন্দ বলেন,  মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে যারা দেশের জন্য আত্মবিসর্জন দিয়েছেনÑ সেই সকল শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এই ‘লাল যাত্রা’। অন্যদিকে এ আয়োজনের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর সকল গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। নাটকের দল হিসেবে আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে থিয়েট্রিকাল পারফরমেন্স। ২০১১ সাল থেকে এটি প্রাচ্যনাটের নিয়মিত আয়োজন হলেও এতে সব দলের নাট্যকর্মীসহ শিল্পের বিভিন্ন শাখার ব্যক্তিরা  স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন। 
গণহত্যা দিবসে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজন ॥ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে সোমবার দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে শিল্পকলা একাডেমি। সেমিনার, সংলাপ, আর্ট ক্যাম্প, গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার প্রযোজনার পোস্টার ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।
দুপুরে একাডেমির নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে ‘গণহত্যার বিশ্ব-রাজনীতি ও বাংলাদেশ গণহত্যা : ভুলে থাকা সাংস্কৃতিক দায়’ শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবুল হক, লেখক ও গবেষক চঞ্চল আশরাফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজ সালেকীন, নাট্যকার মাতিয়া বানু শুকু, চলচ্চিত্র পরিচালক নূরুল আলম আতিক,  লেখক ও গবেষক জাফর আহমদ রাশেদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সিনিয়র সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নজরুল কবির,  অভিনেত্রী জ্যোতিকা  জ্যোতি প্রমুখ। 
সন্ধ্যায় জাতীয় চিত্রশালার ১নং গ্যালারিতে প্রখ্যাত, বিশিষ্ট ও প্রতিশ্রুতিশীল চারুশিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। রাতে জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

×