ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় প্রকল্প পরিচালকের চিঠি

তিন জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে টহল জোরদারের নির্দেশ

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৮ জুন ২০২২

তিন জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে টহল জোরদারের নির্দেশ

শংকর কুমার দে ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উপরিভাগ ও উভয় প্রান্তের নিরাপত্তায় কঠোর হচ্ছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এই চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠি পাঠানো হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট ও সেফটি টিমের প্রধান সমন্বয়ক নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোঃ আব্দুল কাদেরের কাছে। চিঠিতে জরুরী ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর উপরিভাগ ও উভয় প্রান্তে টহল জোরদার করার জন্য বলা হয়েছে। পদ্মা সেতু সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়ার প্রথম দিনেই এই সেতু ঘিরে দেখা গেছে মানুষের ঢল। সেতু ঘিরে দেখা গেছে তুমুল উচ্ছ্বাস। একই সঙ্গে দেখা গেছে নিয়ম ভাঙ্গারও হিড়িক। নিয়ম না থাকলেও সেতুতে গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলা, টিকটক ভিডিও করতে দেখা গেছে অনেককেই। পদ্মা সেতুর ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি টিভি) ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সেতুর রেলিংয়ের নাট খোলাসহ একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো হয়েছে, যা অনভিপ্রেত, অনাক্সিক্ষত ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য ভয়াবহ বিপদজনক। পুলিশ সদর দফতর ও সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু খুলে দেয়ার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে সেতুর নিরাপত্তা রক্ষায় কঠোর হতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন ও জেলার পুলিশ সুপারগণ। জরুরী ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর উপরিভাগ এবং উভয় প্রান্তে টহল জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলামের সই করা চিঠিতে বলা হয়, শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর রবিবার সকাল থেকে তা যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। সেতুর উপরিভাগ ও সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মালামাল রয়েছে। সেতুর ওপর যানবাহন থেকে নামা নিষিদ্ধ থাকলেও সাধারণ যাত্রীরা সেতুর উপরিভাগে নেমে সেতুর গুরুত্বপূর্ণ মালামাল চুরি ও ক্ষতি করছে। এ ছাড়া সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে সাধারণ জনগণ প্রবেশ করে মালামালের ক্ষতি করছে। এ অবস্থায় সেতুর উপরিভাগ ও উভয় প্রান্তে জরুরী ভিত্তিতে টহল জোরদার ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোঃ আব্দুল কাদের বলেন, সেতুর ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট ও সেফটি টিমের প্রধান সমন্বয়কসহ মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টরা তৎপরতা শুরু করেছেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টরা পদ্মা সেতুসংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে এরই মধ্যে আলোচনা করেছেন। কঠোরভাবে পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কোনভাবেই কেউ যেন সেতুতে নেমে অপ্রীতিকর কিছু করতে না পারে, সে বিষয়েও কঠোর ভূমিকা নেয়া হবে। সেতুতে যেন কেউ না নামতে পারে, সে বিষয়ে প্রশাসন আরও কঠোর হচ্ছে। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ বলেছেন, পদ্মা সেতুর ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি টিভি) ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু সবার জন্য খুলে দেয়ার প্রথম দিনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাসহ একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটানো হয়েছে, যা অদূর ভবিষ্যতে সেতুর নিরাপত্তার জন্য ভয়ঙ্কর বিপদজনক। পদ্মা সেতু দেশের এত বড় একটি অর্জন, একে ঘিরে মানুষের উচ্ছ্বাস থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আজ যা হয়েছে, তাতে অনেক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটে গেছে। সারাদিন এ সব পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজ করতে হয়েছে প্রশাসনের প্রায় সকলকেই। একজনকে দেখলাম পিলারের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। একজনকে দেখলাম বাইক থেকে রেঞ্জ বের করে সেতুতে লাগানো নাট খুলছে। একজনকে পেলাম, যিনি বলছেন বাড়িতে স্মৃতি হিসেবে নিয়ে যেতে নাকি নাট খুলেছেন! এগুলো দুঃখজনক। সবাইকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আর যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রশাসনিকভাবে সমন্বয় করে নিরাপত্তার বিষয়গুলো কার্যকর করা হবে। সবাই তো আর বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। যারা পারে, তাদের নিয়েই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়ার প্রথম দিনেই এই সেতু ঘিরে দেখা গেছে মানুষের ঢল, তুমুল উচ্ছ্বাস, নিয়ম ভাঙ্গার হিড়িক পড়ার খবর পাওয়া গেছে। নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ম না থাকলেও সেতুতে গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলা, টিকটক ভিডিও করতে দেখা গেছে অনেককেই। এমনকি, সেতুর রেলিংয়ের নাট পর্যন্ত খুলতে দেখা গেছে! এর মধ্যেই পদ্মা সেতুর নাট খুলে নেয়ার একটি টিকটক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ছাড়াও কিছু বাসচালককে দেখা যায় টিকটকারদের তুলছে টোল প্লাজার বাইরে থেকে, আর এরপর তাদের সেতুর মাঝখানে নামিয়ে দিচ্ছে। ১০০ টাকার বিনিময়ে নাকি তারা এমনটা করেছে। আবার দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন স্থান থেকে মোটরসাইকেলে অনেকে যাত্রী নিয়ে এসে সেতুর মাঝখানে নামিয়ে দিচ্ছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পদ্মা সেতুর নাট খুলে নেয়ার একটি টিকটক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বায়েজিদ নামে এক তরুণকে চিহ্নিত করে রাজধানীর শান্তিনগর থেকে আটকও করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করতে হয়েছে পদ্মা সেতু উত্তর থানাকে। কেবল বায়েজিদ নয়, এ দিন পদ্মা সেতুর রেলিং থেকে নাট খোলার ঘটনা ঘটেছে একাধিক স্থানে। এ অভিযোগে অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সেতুর ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) সহায়তায় বাকিদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে বলে সিআইডি কর্তৃপক্ষের দাবি। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ পারভেজ হাসান বলেছেন, নানাভাবে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করা হচ্ছে। আমরা মাইকিং করেছি। তবে, সেতুর ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে কিন্তু অনেক অংশীজন যুক্ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন আছে, ঠিক একইভাবে সেতু কর্তৃপক্ষও আছে। যেভাবে নির্দেশনা আসবে, সেভাবেই আমরা বাস্তবায়ন করব। পদ্মা সেতুর ওপর যে সব নিয়ম মেনে চলার নির্দেশনা ॥ গত ২৩ জুন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এক গণবিজ্ঞপ্তিতে নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব রক্ষার্থে পদ্মা সেতু ব্যবহারকারীদের জন্য কিছু নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়। নির্দেশনাগুলো হলো- পদ্মা সেতুর ওপর অনুমোদিত গতিসীমা থাকবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার, পদ্মা সেতুর ওপর যে কোন ধরনের যানবাহন দাঁড়ানো ও যানবাহন থেকে নেমে ছবি তোলা/হাঁটা সম্পূর্ণ নিষেধ। তিন চাকাবিশিষ্ট যানবাহন (রিক্সা, ভ্যান, সিএনজি, অটোরিক্সা ইত্যাদি), পায়ে হেঁটে, সাইকেল বা নন-মোটরাইজড গাড়িযোগে সেতু পারাপার হওয়া যাবে না, গাড়ির বডির চেয়ে বেশি চওড়া এবং ৫.৭ মিটার উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতার মালামালসহ যানবাহন সেতুর ওপর দিয়ে পারাপার করা যাবে না, সেতুর ওপরে কোন ধরনের ময়লা ফেলা যাবে না। গত ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন ২৬ জুন ভোর ছয়টা থেকেই গণপরিবহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় সেতু। উদ্বোধনের আগে সরকারীভাবে দেয়া নির্দেশনায় জানানো হয়, পদ্মা সেতুতে হেঁটে পার হওয়া যাবে না। এমনকি, দাঁড়িয়ে ছবিও তোলা যাবে না। তবে, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটি চালুর পর থেকে দেখা যায় নানাভাবে অনেকেই মানছেন না সেই নিষেধাজ্ঞা।
×