ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

লে. কর্নেল ডাঃ নাসির উদ্দিন আহমদ

মানবদেহে থাইরয়েড হরমোনের ভূমিকা

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ২৪ মে ২০২২

মানবদেহে থাইরয়েড হরমোনের ভূমিকা

আমাদের কণ্ঠনালীর ঠিক নিচে পাখনা মেলা প্রজাপতির মতো একটি অঙ্গের নাম থাইরয়েড। এখান থেকে নিঃসৃত হয় মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। এই হরমোন আমাদের শারীরবৃত্তীয় অসংখ্য কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এর ঘাটতি কিংবা আধিক্যজনিত রোগে অনেকেই ভুগছেন। সে কারণে এই হরমোনের কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা দরকার। গর্ভস্থ শিশুর ওপর হরমোনের প্রভাব গর্ভস্থ শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে থাইরয়েড হরমোনের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। এটি গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্ক এবং হাড়ের বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এ কারণে যেসব মায়েদের থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি রয়েছে তাদের গর্ভজাত শিশুদের বুদ্ধি বৈকল্য হতে পারে, দৈহিক বৃদ্ধি মারাত্মক ব্যাহত হতে পারে। কখনও গর্ভস্থ শিশুর জন্মগতভাবে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি থাকলে তারা মারাত্মক পর্যায়ের বুদ্ধি বৈকল্যৈর শিকার হয়। তারা হয়ে থাকে খর্বাকৃতির। এ রোগটিকে বলা হয় ক্রিটিনিজম। ওজন নিয়ন্ত্রণে হরমোন এটি শরীরের অক্সিজেনকে কাজে লাগিয়ে তাপ উৎপাদনে সাহায্য করে। মানুষের দেহকোষে শক্তি উৎপাদনের কারখানা হচ্ছে মাইট্রোকনড্রিয়া। এই হরমোনটি মাইট্রোকনড্রিয়া তৈরিতে সাহায্য করে। মানুষের শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে এই হরমোনের অভাবে শরীরের বিপাক কমে যায়। শরীরের শক্তি কমে যায়, তাপ কমে যায়। শরীরের ক্যালরি কম খরচ হয় বলে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। ওজন বাড়তে থাকে। হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ এটি হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। প্রান্তীয় রক্তনালীর রোধক কমিয়ে দেয়। রক্তনালীর অভ্যন্তরের আয়তন বাড়িয়ে দেয়। এই হরমোন বেড়ে গেলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। হরমোন কমে গেলে হৃদস্পন্দন হ্রাস পায়। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা পালন করে। এ কারণে থাইরয়েড হরমোনের তারতম্য দেখা দিলে বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। কোষে অক্সিজেন সরবরাহ অক্সিজেন বাহিত হয় হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে। কোষে কোষে অক্সিজেন পৌঁছে যায় হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে। অক্সিজেন হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। কোষে অক্সিজেন পৌঁছতে হলে হিমোগ্লোবিন থেকে এটিকে মুক্ত হতে হয়। এই অবমুক্ত করার ক্ষেত্রে থাইরয়েড হরমোনের ভূমিকা রয়েছে। থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতির কারণে অক্সিজেন সহজে মুক্ত হতে পারে না। ফলে কোষে কোষে অক্সিজেন পৌঁছতে পারে না। এ কারণেই থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতিজনিত কারণে রোগীরা ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ মানব দেহের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র মস্তিষ্কে। অক্সিজেনের ঘাটতি কিংবা বৃদ্ধিজনিত কারণে এখান থেকে সঙ্কেত চলে যায় ফুসফুসে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। থাইরয়েড হরমোন শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে। ফলে এই হরমোনের ঘাটতি হলে শ্বাস-প্রশ্বাস কমে যায়। এছাড়া এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে এই হরমোনের আধিক্যের কারণে শ্বাসকষ্টের অনুভব সৃষ্টি হয়। মাংসপেশি ও হাড়ের কার্যক্রম পরিচালনায় হরমোন হাড়ের কার্যক্রমকে উদ্দিপ্ত করে। ফলে হাড় ক্ষয় হতে থাকে। এ হরমোন এর বৃদ্ধিজনিত কারণে হাড় থেকে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম বেরিয়ে আসে। ফলে রক্তে ক্যালসিয়ামের আধিক্য সৃষ্টি হয় এবং মূত্রের সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়। এ কারণে হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এই হরমোনের প্রভাবে মাংসপেশি থেকে প্রোটিন ক্ষয় হতে থাকে। এ কারণে অনেক সময় মাংসপেশির দুর্বলতা তৈরি হয়। এটি মাংসপেশির সঙ্কোচন এবং প্রসারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া পেশি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সমস্ত স্নায়ু দায়ী সে সমস্ত স্নায়ুর কার্যক্রমকেও এটি বাড়িয়ে দেয়। ফলে এই হরমোনটির বৃদ্ধিজনিত কারণে অনেক সময় মাংসপেশির সঙ্কোচন প্রসারণ এতটাই বেড়ে যায় যে হাত কাঁপতে শুরু করে। এই হরমোনের প্রভাবে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বেড়ে যায়। রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ থাইরয়েড হরমোন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যকৃতে গ্লুকোজ উৎপাদন বেড়ে যায়। এই হরমোনের প্রভাবে অন্ত্রে গ্লুকোজ শোষণ বৃদ্ধি পায়। এ সমস্ত কারণে এই হরমোনের আধিক্যে ডায়াবেটিস আরও খারাপ পরিণতির দিকে যায়। এটি কোলেস্টেরল উৎপাদন ও বিশ্লেষণে ভূমিকা রাখে। বিশেষত রক্তে শত্রু কোলেস্টেরল এলডিএলের পরিমাণ হ্রাস করতে এটি সাহায্য করে। এ কারণে এই হরমোন ঘাটতিজনিত রোগে এলডিএল কোলেস্টেরল অনেক বেড়ে যায়। অন্যান্য হরমোনের ওপর প্রভাব এই হরমোনটি আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। এর অভাবে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। ফলে শৈশবে এই হরমোনের অভাবজনিত রোগে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এই হরমোনের অভাবে দুগ্ধ নিঃসরণকারী আরেকটি হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। মহিলাদের মাসিক অনিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। এই হরমোনটির অভাবে অনেক ক্ষেত্রে ডিম্ব নিঃসরণ হয় না। ফলে নেমে আসে বন্ধ্যত্ব। এই হরমোনের আধিক্যজনিত কারণেও বন্ধ্যত্ব হতে পারে। মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে যথাযথ চিকিৎসা করলে এ সমস্ত সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। লেখক : মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, সিএমএইচ। চেম্বার : আল রাজী হাসপাতাল ( ২য় তলা) ফার্মগেট, ঢাকা। মোবাইল- ০১৭৫৬১৭৩৭৬৫ ও ০১৭২৬০৫০৯১২
×