ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

করোনায় বদলে যাওয়া পেশা

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২২ মে ২০২২

করোনায় বদলে যাওয়া পেশা

ছোট ছোট উদ্যোগ একদিন অনেক বড় হবে। এ আশা নিয়ে দৃপ্ত মনোবলে এগিয়ে চলছে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদরের অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তাদের গ্রুপ ‘গলাচিপা ই-কমার্স এ্যান্ড এন্টারপ্রেনার্স জিইই।’ এরই মধ্যে এক দু’জন করে উদ্যোক্তার সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। গ্রুপের ফলোয়ার মেম্বার সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় চার হাজারে। গ্রুপের উদ্যোক্তারা বৈচিত্র্যময় খাবার দাবার থেকে শুরু করে পোশাক, অলঙ্কার, হাঁস-মুরগি, হার্ডওয়্যার পণ্য, এমনকি বাসা ভাড়া কিংবা পরিবহন সুবিধাও পৌঁছে দিচ্ছেন গ্রাহকদের দুয়ারে। উপজেলা সদরের গ-ি ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত পল্লী এবং দেশের নানা প্রান্তেও উদ্যোক্তারা পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের পণ্যসেবা। জিইইএর এ উদ্যোগ যেমন অনেককে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করছে, তেমনি এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে। ‘গলাচিপা ই-কমার্স এ্যান্ড এন্টারপ্রেনার্স-জিইই’-এর শুরুটা কিন্তু মোটেই সুখকর ছিল না। বিশেষ করে পশ্চাৎপদ মানসিকতার জনপদে নারীদের এগিয়ে চলায় পেরোতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে- নানা প্রতিবন্ধকতা। তার পরও গ্রুপের সদস্যরা এগিয়ে চলছেন সাফল্যের চূড়া ছুঁতে। গ্রুপের কয়েক সদস্য জানালেন, তাদের এগিয়ে চলার গল্প। শুরুটা হয়েছিল এমডি সুমন শুভ নামের যুবকের হাত ধরে। করোনাকালীন সময়ে তিনি অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর এর সঙ্গে যুক্ত হন তারান্না তাননুম লিজা। স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাকেই অনলাইন পণ্যসেবা ও ব্যবসার অগ্রপথিক গণ্য করা হয়। করোনা মহামারীর আগে তিনি স্থানীয় একটি বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। করোনায় স্কুল বন্ধ হলে তিনিও বেকার হয়ে পড়েন। স্বামীও শিক্ষক। লিজা বলেন, স্বামীর একার আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। অনেক ভেবে-চিন্তে শুরু করলাম হাতে তৈরি খাটি ঘিয়ের ব্যবসা। দুধ আসত গ্রাম থেকে। ফেসবুকের পেজে ঘিয়ের বিষয়টি তুলে ধরতেই বেশ সাড়া পেলাম। অনলাইনে অর্ডার আসত। নিজেই ডেলিভারি দিতাম। এরপরে শুরু করলাম খেজুরগুড়ের ব্যবসা। গ্রাম থেকে রস এনে নিজের হাতে গুড় তৈরি করে ডেলিভারি করতাম। এর পাশাপাশি শিঙ্গাড়া, চমুসা, পাটিসাপটাসহ নানা ধরনের পিঠা এবং ফাস্টফুড সরবরাহ শুরু করলাম। তবে সবচেয়ে বেশি সফল হলাম চালের কুঁড়াতে তৈরি রুটিতে। গোটা এলাকায় চালের রুটি বেশ সাড়া ফেলল। প্রতিদিন শত শত রুটি তৈরি ও সরবরাহ করছি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে পিঠার সাজ ডেলিভারি। সিমেন্টের তৈরি সাজ দেশের নানা প্রান্তেও যাচ্ছে। হাতে কাজ করা ছেলেমেয়েদের পোশাকের চাহিদাও বেশ বাড়ছে। লিজা আরও বলেন, আমার পাশাপাশি আরও অনেক ছেলেমেয়ে করোনাকালীন মহামারীর মধ্যেই অনলাইন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে তুলি ‘গলাচিপা ই-কমার্স এ্যান্ড এন্টারপ্রেনার্স-জিইই’ নামের অনলাইন প্লাটফর্ম। গ্রুপের মেম্বাররা এরই মধ্যে দু’বার গেট টুগেদার করেছেন। দিন কয়েক আগে করেছেন স্থানীয় সরকারী কলেজ মাঠে উদ্যোক্তা মেলা। এতে গ্রুপ সদস্যরা তাদের তৈরি পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করেছেন। মেলাটি স্থানীয় সব মহলেই বেশ সাড়া জাগিয়েছে। অনলাইন যৌথ প্লাটফরমের প্রয়োজনীয়তা এবং এর সুবিধার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারান্না তাননুম লিজা বলেন, উদ্যোক্তাদের সকলের নিজের বা প্রতিষ্ঠানের নামে ফেসবুকের পৃথক পেজ রয়েছে। কিন্তু তা ছড়ানো ছিটানো। গ্রাহকদের পক্ষে নিজ প্রয়োজনের পণ্য খুঁজে বের করা বেশ সময়সাপেক্ষ। গ্রাহকদের এ সমস্যা দূর করতেই সকলের পৃথক পেজের পাশাপাশি সদস্যদের সমস্ত পণ্য এক পেজে নিয়ে আসা হয়েছে। এতে গ্রাহকদের যেমন সুবিধা হয়েছে আবার বেচাকেনা এবং ডেলিভারিতেও স্বতঃস্ফূর্ততা এসেছে। নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো তুলে ধরাও সহজ হয়েছে। লিজার মতে- অনলাইন যৌথ প্লাটফরমের অভিনব এ ধারণাটি নিঃসন্দেহে পণ্য পরিচিতিতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে। যদিও উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য নিজ দায়িত্বে বেচাকেনা করেন। এর সঙ্গে প্লাটফর্মের কোন ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা-অসুবিধা জড়িত নেই। বর্তমানে জিইইএর উদ্যোক্তার সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ২০-৩০ জন উদ্যোক্তা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে (এধষধপযরঢ়ধ ঊ-পড়সসবৎপব ্ ঊহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎং (এঊঊ) নামের পেজটির ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় চার হাজার। যা ক্রমে বাড়ছে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জন পোশাকের ব্যবসা করেন। এর মধ্যে কয়েকজন আবার পোশাকে হাতের কারুকাজ করেন। কেউ কেউ গ্রাহকের পছন্দমতো ডিজাইন ও সূচিকর্ম করেন। বিভিন্ন ধরনের বিরিয়ানিসহ ফাস্টফুডের সঙ্গে যুক্ত আছেন ৫-৬ জন। বৈচিত্র্যপূর্ণ কেক তৈরি করেন ৬-৭ জন। নারীদের অলঙ্কারে যুক্ত আছেন ৫-৬ জন। অর্ডার অনুযায়ী মুখের মাস্ক তৈরি করেন একজন। হাতে দৃষ্টিনন্দন মেহেদি পরানোর কাজ করেন ৪-৫ জন। বিয়ে কিংবা জন্মদিনের মতো সামাজিক এবং পারিবারিক উৎসবে সব ধরনের খাবার সরবরাহ করেন গ্রুপের কয়েক সদস্য। এসবের সঙ্গে বাড়ি ভাড়া, সাংসারিক মালামাল সরবরাহ, পরিবহন থেকে হাঁস-মুরগি সবই অনলাইনের এ প্লাটফর্মে যুক্ত হয়েছে। এমনকি গ্রুপের সদস্যরা পণ্য ডেলিভারির জন্য নিজস্ব একটি গ্রুপকেও যুক্ত করে নিয়েছেন। দেশের নানা প্রান্তে পণ্য পৌঁছে দিতে ব্যবহার করেন কুরিয়ার সার্ভিস। এতে গ্রুপের উদ্যোক্তারা আরও আশাতীত সাড়া পাচ্ছেন। বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তা নিয়ে গড়ে ওঠা ‘জিইই’ গ্রুপের অন্যতম মডারেটর ও এডমিন তারান্না তাননুম লিজা জানান, ফেসবুকের এ পেজের মাধ্যমে বর্তমানে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার লেনদেন হচ্ছে। যা দিন দিন বাড়ছে। লেনদেনের পাশাপাশি বাড়ছে উদ্যোক্তার সংখ্যাও। উদ্যোক্তাদের মধ্যে কয়েকজন এর মাধ্যমে খুঁজে নিয়েছেন সফলতার চাবিকাঠি। যা অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করছে। লিজার মতোই কয়েক উদ্যোক্তা জানালেন তাদের আশা, স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার কথা। শারীরিক প্রতিবন্ধী মুশফিকা ইসলাম ঐশির রয়েছে সাংসারিক নানা জটিলতাও। এসব বাধা ডিঙিয়ে তিনি ঘরে বসে তৈরি এবং দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহ করেন মনোমুগ্ধকর ডিজাইনের মাস্ক। এর দ্বারা তিনি সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে কিছুটা হলেও অবদান রাখছেন। নাদিয়া জামান হিমু বিভিন্ন স্বাদ ও বর্ণের কেক এবং পিৎজায় অনলাইনে বেশ সাড়া ফেলেছেন। অলঙ্কারে মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা আয় করেন আশিফা জাহান। তার তৈরি অলঙ্কার এখন যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। হাতে তৈরি পোশাকেও সফলতার মুখ দেখছেন মারিয়া রহমান। সামাজিক এবং ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কেক কিংবা বিরিয়ানিতে ইয়াসমিন ইসলাম নিশাত ক্রমে অদ্বিতীয়া হয়ে উঠছেন। একইভাবে গ্রুপের অধিকাংশ সদস্যই নিজেরা দেখছেন এবং সমাজকে দেখাচ্ছেন আশার আলো। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ঘরে বসেই যে স্বপ্ন পূরণ সম্ভব তাও দেখিয়ে দিচ্ছেন জিইই পরিবারের সদস্যরা। গ্রুপের উদ্যোক্তা সদস্যরা আশা করছেন- তাদের এ ক্ষুদ্র উদ্যোগ একদিন অনেক বড় হবে। প্রত্যন্ত জনপদের গ-ি পেরিয়ে দেশ-বিদেশেও ছড়িয়ে পড়বে তাদের কর্মপরিধি। এর মধ্যে দিয়ে আরও অনেক নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টি হবে। নিত্য নতুন পণ্য যুক্ত হবে। স্বাবলম্বী হবে আরও অসংখ্য উদ্যোক্তা। শীর্ষে পৌঁছাবে তাদের সফলতার গল্প।
×