ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণের শিকার নারীরা ‘ওয়ার হিরোইন’॥ ট্রাইব্যুনাল

মৌলভীবাজারের তিন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২০ মে ২০২২

মৌলভীবাজারের তিন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৌলভীবাজারের বড়লেখার আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুলসহ তিন রাজাকারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় প্রদান করেছেন ট্রাইব্যুনাল। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অন্য দুজন রাজাকার হলো মোঃ আব্দুল মতিন ও আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মতিন আপন দুই ভাই। আব্দুল মতিন পলাতক রয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর ৪৫তম রায়। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বৃহস্পতিবার এ রায় প্রদান করেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম। মুক্তিযুদ্ধের সময় মৌলভীবাজারের বড়লেখার মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনার সময় ধর্ষণের শিকার নারীদের ‘ওয়ার হিরোইন’ উপাধির পাশাপাশি স্যালুট জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নি জনকণ্ঠকে বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, তারা (ধর্ষণের শিকার নারীরা) যুদ্ধের হিরোইন। ‘ওয়ার হিরোইন’ হিসেবে তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছে। ট্রমা থেকে তারা কখনোই বের হতে পারে না। আদালত তাদের স্যালুট জানিয়েছেন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ২৪০ পৃষ্ঠার এ রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান তিন বিচারপতি। যুদ্ধাপরাধের পাঁচ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- দেয়া হয়। এরমধ্যে আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মতিনকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে, অন্য দুটি অভিযোগে তাদের মোট ৩০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। আর আব্দুল মান্নানকে এক অভিযোগে মৃত্যুদ- এবং আরেক অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষ এ রায়ে ক্ষুব্ধ। তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবে। এ মামলার শুনানিতে আসামি আব্দুল মান্নানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এম. সারোয়ার হোসেন ও আব্দুল আজিজের পক্ষে আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নি। রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। আরও উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত, প্রসিকিউটর হৃষিকেশ সাহা, সুলতান মাহমুদ সীমন, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল। উপস্থিত ছিলেন তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক। এছাড়া গ্রেফতারকৃত দুই আসামিকেও আদালতে হাজির করা হয়। রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি সাংবাদিকদের বলেন, মামলায় তিন আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে এক আসামি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার পরে দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে শান্তি কমিটির পক্ষে কাজ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ দালিলিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, রায়ে আমরা ক্ষুব্ধ। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করলে আসামিরা খালাস পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। প্রথম অভিযোগ ॥ ১৯৭১ সালের ১৯ মে আসামিরা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা হরেন্দ্র লাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করেন। তিনদিন বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতনের পর জুরিবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাসকে হত্যা করে। শ্রীনিবাস দাস কোনক্রমে প্রাণে বেঁচে যান এবং দুই দিন পর বাড়ি ফিরে আসেন। দ্বিতীয় অভিযোগ ॥ ১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে আসামিরা বড়লেখা থানার বিওসি কেছরিগুল গ্রাম থেকে সাফিয়া খাতুন ও আবদুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আসামিরা সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প ও বড়লেখা সিও অফিসে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়েও সাফিয়া খাতুনকে ধর্ষণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া খাতুনকে সিও অফিসের বাঙ্কার থেকে উদ্ধার করে। তৃতীয় অভিযোগ ॥ ১৯৭১ সালের ১৩ নবেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে বাড়ির মালামাল লুটপাট করে। রাজাকাররা মঈনের বাবা বছির উদ্দিন, নেছার আলী, ভাই আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে তারা মুক্তি পান। চতুর্থ অভিযোগ ॥ ১৯৭১ সালের ১৪ নবেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মস্তকিন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে। মস্তকিনকে না পেয়ে তার ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙ্গে যায়। আসামিরা মস্তকিন ও মতছিন আলীর বাড়ির মালামাল লুট করে তিনটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেয়। পঞ্চম অভিযোগ ॥ ১৯৭১ সালের ১৭ নবেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন্য বাড়িতে হামলা করে তারা। সেখান থেকে আসামিরা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে আসামিরা আফিয়া বেগমকে ধর্ষণ করে। হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর বাড়ির মালামালও লুটপাট করা হয়।
×