ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নৌকার গ্যারেজ

গ্রামাঞ্চলে বর্ষার বাহন, মৌসুম শুরুর আগেই চলছে মেরামত

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ১১ মে ২০২২

গ্রামাঞ্চলে বর্ষার বাহন, মৌসুম শুরুর আগেই চলছে মেরামত

সমুদ্র হক ॥ সমুখে আষাঢ়। শুরু হবে বর্ষা মৌসুম। বাঙালী সংস্কৃতির ঋতুবৈচিত্র্যে বর্ষা মানেই রিমঝিম বৃষ্টি। বারিধারায় গ্রামের মাঠঘাট জল থৈ থৈ। নদী ভরে ওঠে। নদী তীরের গ্রাম, চরগ্রামে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে নৌকাই বাহন। জেলেদের মাছ ধরার বাহন নৌকা। শুধু চরগ্রাম নয়। বন্যা থাবা দিলে জন চলাচলে নৌকাই একমাত্র বাহন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক নৌকা, কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সহস্রাব্দের পথে। নৌকা কালের পরিক্রমায় চিরন্তন হয়েই আছে। চৈত্রের শেষেই নৌকা ঠিকঠাক করার কাজ শুরু হয়েছে। মোটর গাড়ির যেমন গ্যারেজ আছে হালে নৌকারও গ্যারেজ গড়ে উঠেছে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। যমুনা তীরবর্তী সারিয়াকান্দি সোনাতলা ধুনট এলাকায় গড়ে উঠেছে নৌকা ঠিকঠাক করার ওয়ার্কশপ। যেখানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে নৌকা এনে ঠিকঠাক করা হচ্ছে। নৌকা কখনও আসে ভ্যানগাড়িতে। কখনও নৌকার ওপর নৌকা তুলে নদীপথে আনা হয়। সারিয়াকান্দির নৌকার কারিগর ওসমান বললেন, কাঠ দিয়ে ঠিকঠাকভাবে নৌকা বানিয়ে কাঠের পাটাতন সেট করতে হয়। ছই লাগানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এরপর গাব আলকাতরা দিয়ে ফিটিং করতে হয়। তারপর কাছের জলাশয়ে টেস্ট করা হয় পানি ওঠে কিনা। নদী পথের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একদার স্টিমার আজ আর চোখে পড়ে না। নারায়ণগঞ্জে দুই তিনটি স্টিমার বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য প্রচারে স্বাস্থ্য সেবার ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের কাজ করে জানান দেয় একদার অস্তিত্ব। কয়লা চালিত স্টিমারের বদলে বর্তমানে নদী পথের যাত্রী সেবায় ডিজেলচালিত লঞ্চ ও মিনি জাহাজ আসন করে নিয়েছে। এমন যন্ত্রযানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিংবদন্তির নৌকা বসে নেই। যে মাঝি-মাল্লারা এক সময় চৌর ও বৈঠায় নৌকা বাইত তারা এখন শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকায় মোটরগাড়ির ইগনিশনের (চাবি দিয়ে স্টার্ট) মতো নৌকা স্টার্ট দেয়। মাঝিকেও নৌকা চলাচল নিয়ন্ত্রণে হাল ধরে রাখতে হয়। দেশের প্রতিটি এলাকায় এখন সকল ধরনের নৌকা আছে। কোনটি বৈঠা বওয়ার সাধারণ নৌকা। কোনটি শ্যালো ইঞ্জিনে চালিত। দেশে অনেক ধরনের নৌকা আছে। আবার একদার ঐতিহ্যের অনেক নৌকা হারিয়েও গিয়েছে। তার পরও নৌকার আবেদন এতটাই বেশি যে গ্রামে গৃহস্থবাড়িতে নৌকা আছেই। হালে কৃষকের বাড়িতে নৌকা থাকে। যারা ঘাটে নৌকায় যাত্রী পারাপার করে তারা ব্যবসায়ী ভিত্তিতে একাধিক বড় ও মাঝারি নৌকা বানায়। আগে খেয়া ঘাটে মাঝি নৌকা নিয়ে থাকত। এখনও থাকে। তার সঙ্গে গৃহস্থ ও কৃষকেরও নিজস্ব নৌকা ও ডিঙি নৌকাও ভিড়ানো থাকে। ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রতিটি পরিবারে মোটরগাড়ি আছে। তেমনই বাংলাদেশের নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরগ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নৌকা এখন অতি প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই গাঁও ওই গাঁও এই হাট সেই হাটে পণ্য বাজারজাত করণসহ নানা কাজে নৌকাই একমাত্র মাধ্যম। মোটরগাড়ি সচল রাখতে গ্যারেজে নিতে হয়। নৌকাকে ঠেকঠাক রাখা ও মেরামতের সময় শুকনো মৌসুম থেকে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। দেশের প্রতিটি এলাকায় নৌকা মেরামতের কাজ চলে। এই সময়টায় নদ নদীতেই পানি কমে গিয়েছে। অনেক নদীতে চর জেগে ওঠায় সামান্য পানি হেঁটেই পার হওয়া যায়। খেয়া ঘাটে নৌকা বেশি থাকে না। বেশিরভাগ নৌকাই এখন মিস্ত্রিদের কাছে। হালে নৌকার মিস্ত্রিদের পদবি বাড়িয়ে নাম হয়েছে বোট মেকানিক। বগুড়ার ধুনটের যমুনা তীরের সারিয়াকান্দি ও সহরাবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় নতুন নৌকা তৈরির পাশাপাশি পুরনো নৌকা মেরামতের কাজ চলছে। সারিয়াকান্দি এলাকার রফিকুল ইসলাম জানালেন বৈশাখে একদিকে নতুন ধান মাড়াই-কাটাই শুরু হয়ে যায়, আরেকদিকে গৃহস্থ ও কিষান বাড়িতে নৌকা ঠিকঠাক চলে। এর মধ্যে যে নৌকা আগে ঠিকঠাক হয় সেই নৌকায় ঢুলিরা উঠে মাঝ নদীতে গিয়ে ঢাকের বাদ্যি বাজান শুরু করে। সারিয়াকান্দির এক প্রবীণ ব্যক্তি জানালেন, জোড়াকষা, বজরাবালা নৌকা এখন আর চোখে পড়ে না। একটা সময় নৌকায় সামনে ময়ূরের আকুতি বানিয়ে ভেতরে লঞ্চের মতো দোতলা করে ময়ূর পঙ্খী নাও বানানো হতো। এখন আর সেই নৌকা নেই। এখন সকল নৌকা জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। বর্ষা মৌসুমে যে নৌকা বাইচ হতো সেই নৌকাও আলাদা।
×