ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

৯৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি সিঙ্গারের

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ৫ নভেম্বর ২০২১

৯৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি সিঙ্গারের

রহিম শেখ ॥ দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড। সারাদেশে সিঙ্গারের বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ৪২৪টি। এরমধ্যে ৩১৪টিই ভ্যাট নিবন্ধনের বাইরে। ১৯টি ওয়্যারহাউসের একটিরও ভ্যাট নিবন্ধন নেই। ফলে শো-রুম, ওয়্যারহাউসের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে উপকরণ রেয়াত নিয়ে মাত্র চার মাসে ৯৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড। দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসলেও সম্প্রতি বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-ভ্যাট) অভিযানে বিষয়টি ধরা পড়ে। পাওনা পরিশোধে ইতোমধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রমতে, সিঙ্গার বাংলাদেশ কিছু পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন করে বাজারজাত করে। কিছু পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে বাজারজাত করে। সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের তিনটি মূসক নিবন্ধন রয়েছে। এরমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির একটি কারখানা এলটিইউতে নিবন্ধিত। ইন্টারন্যাশনাল এ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেড নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা পশ্চিম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কেন্দ্র ঢাকা (দক্ষিণ) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। তিন জায়গায় তিনটি মূসক নিবন্ধন থাকায় সিঙ্গার তিন জায়গায় রিটার্ন দাখিল করে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ও রেয়াত জালিয়াতি, নিবন্ধনহীন বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউস পরিচালনা করে আসছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় এলটিইউ। এরই অংশ হিসেবে দুটি দল গঠন করা হয়। গত ২৫ মে একটি দল প্রতিষ্ঠানটির সাভারের গেন্ডা এলাকার গেন্ডা ওয়্যারহাউস এবং অপর একটি দল ঢাকার ফুলবাড়িয়া ওয়্যারহাউসে অভিযান পরিচালনা করেন। দুটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও তল্লাশি করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি জব্দ করা হয়। এসব দলিলাদি যাচাই করে একই প্রতিষ্ঠানের একাধিক জায়গায় অবৈধ রেয়াত গ্রহণ, বিক্রির বিপরীতের ভ্যাট ফাঁকির চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। ১৪ জুন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে এলটিইউ, যাতে ভ্যাট ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ৯৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে-এই চার মাসে বিক্রির বিপরীতে ভ্যাট ও অবৈধ রেয়াত নেয়ার মাধ্যমে এই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এলটিইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের আওতায় সিঙ্গারের ১১০টি বিক্রয়কেন্দ্র ঢাকা (দক্ষিণ) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে নিবন্ধিত। তবে পরিদর্শনে জব্দ করা দলিলাদিতে সিঙ্গার বাংলাদেশের ওয়্যারহাউস ও বিক্রয়কেন্দ্রের তালিকা পান ভ্যাট কর্মকর্তারা, যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২৪টি। কিন্তু ঢাকা (দক্ষিণ) কমিশনারেটের আওতাধীন মতিঝিল বিভাগে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১১০টি। বাকি ৩১৪টি বিক্রয়কেন্দ্র মূসক নিবন্ধনের আওতাবহির্ভ‚ত। অর্থাৎ এসব বিক্রয়কেন্দ্রে ভ্যাট আদায় করা হলেও তা সরকার পায় না। এছাড়া পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ১৯টি ওয়্যারহাউস রয়েছে, যার দুটি ভ্যাট কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। এই ১৯টি ওয়্যারহাউসও মূসক নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে। সিঙ্গার বাংলাদেশ বাংলাদেশে কিছু পণ্য উৎপাদন করে, কিছু পণ্য সিঙ্গারের অন্য দেশের কারখানা আমদানি করে। উৎপাদন ও আমদানির পর পণ্যগুলো এসব ওয়্যারহাউসে রাখা হয়। এসব পণ্য ওয়্যারহাউস থেকে বিক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে বিক্রি করা হয়। আবার ওয়্যারহাউস থেকে ডিলার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি ও সরবরাহ করা হয়। এই ওয়্যারহাউস থেকে পণ্য সরবরাহে কোন ভ্যাট দেয় না সিঙ্গার বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহেতু এসব বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউস কোন নিবন্ধনের অন্তর্ভুক্ত নেই, সেহেতু এসব ওয়্যারহাউস ও বিক্রয়কেন্দ্র এলটিইউয়ের অধিক্ষেত্রাধীন এবং ভ্যাট আদায়সহ ন্যায় নির্ণয়ন কার্যক্রম এলটিইউয়ের এখতিয়ারাধীন। এসব বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউস মূসক আইন লঙ্ঘন করে পরিচালনা করা হচ্ছে। এলটিইউ এসব বিক্রয়কেন্দ্র ও ওয়্যারহাউসের অনিয়মের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে। কারণ দর্শানোর নোটিস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য অনিবন্ধিত ওয়্যারহাউসে পাঠানো হতো। এর বিপরীতে সিঙ্গার বাংলাদেশ উপকরণ কর রেয়াত নিত। যদিও অনিবন্ধিত ওয়্যারহাউসে পণ্য সরবরাহের বিপরীতে রেয়াত নেয়ার সুযোগ নেই। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এভাবে ২৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার রেয়াত নিয়েছে সিঙ্গার। একইসঙ্গে ভ্যাট আইনে অনিবন্ধিত ও পরিবর্তিত স্থান থেকে পণ্য সরবরাহের বিপরীতে ১৫ শতাংশ আদায়ের বিধান রয়েছে। যেহেতু সিঙ্গারের ওয়্যারহাউস নিবন্ধিত নয়, সেহেতু ওয়্যারহাউস থেকে পণ্য সরবরাহের বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। সাভারের গেণ্ডা ও রাজফুলবাড়িয়া এলাকার ওয়্যারহাউস থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত যথাক্রমে ৫৬ কোটি এবং ৩৬৩ কোটি টাকার পণ্য সরবরাহ করা হয়। এর বিপরীতে ৬৩ কোটি টাকা ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি। এ বিষয়ে সিঙ্গার বাংলাদেশের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, এলটিইউ ভ্যাট অযৌক্তিকভাবে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে। আমরা নোটিসের জবাব প্রস্তুত করছি। সিঙ্গার কখনোই ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকি দেয় না। গতবছর আমরা ২৫২ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছি। সব ওয়্যারহাউস ও শোরুমের ভ্যাট নিবন্ধন নেই কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন উত্তর দিতে রাজি হননি।
×