ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাব্যে রূপের রানী হেমন্ত

প্রকাশিত: ০০:৪৪, ২৯ অক্টোবর ২০২১

কাব্যে রূপের রানী হেমন্ত

প্রকৃতির রোষানলে ষড়ঋতুর যে দুই ঋতু এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে তার একটি হলো হেমন্ত। বাংলার প্রতিটি ঋতুর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সব মিলিয়েই এই বাংলা। বাংলার গান, কবিতা, ছড়া, গল্প বা উপন্যাস সব শাখাতেই ঘুরে ফিরে কম-বেশি সব ঋতুই এসেছে। ঋতু বন্দনা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, বাংলা কবিতায় যেভাবে ঋতুরাজ বসন্ত, বর্ষা বা শরত বন্দনা হয়েছে সে তুলনায় হেমন্ত এসেছে কমই। এই উপেক্ষার কোন যথাযথ কারণ নেই। কারণ সৌন্দর্য এবং বৈশিষ্ট্য লালিমায় কোন অংশেই কম নয় হেমন্ত। সেই বন্দনায় হেমন্তও কম কিছু নয়। হেমন্তের মাঠ-ঘাট, শিশির ভেজা সকাল, মাঠের পাকা সোনালি ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য, ঘরে ঘরে ডোলা ভর্তি ধান, কৃষক-কৃষাণির আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অণুষঙ্গ। বৈচিত্র্য রূপের সাজে প্রকৃতিতে হেমন্ত বিরাজ করে। হেমন্ত ঋতুতে চলে শীত-গরমের খেলা। হেমন্তের শুরুতে এক অনুভূতি আর শেষ হেমন্তে অন্য অনুভূতি। ভোরের আকাশে হালকা কুয়াশা, শিশিরে ভেজা মাঠ-ঘাট তারপর ক্রমেই ধরণী উত্তপ্ত হতে থাকে। বাংলার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ীই এদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালা করে প্রকৃতি একে এক তার ছয়টি রূপ আমাদের সামনে আনে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতুর পালাবদলের। আমাদের জীবনযাত্রায় এসব ঋতু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ফসল উৎপাদন এবং ঋতু নির্ভর ফল ঋতু বদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ভিন্ন বৈচিত্র্যে হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে। প্রিয় ঋতুর তালিকায় ভিন্ন মত আছে। তবে সৌন্দর্যের তালিকায় হেমন্তের আলাদা কদর রয়েছে। কারণ হেমন্ত হলো নবান্ন উৎসবের ঋতু। নতুন ধানে ঘরে ঘরে পিঠা-পুলি-পায়েস তৈরির ধুম এই ঋতুতেই শুরু হয়। অন্য যে কোন ঋতুর তুলনায় এই ঋতুর বৈশিষ্ট্য একটু বেশি ভিন্ন। কবি সাহিত্যক, গায়কের খাতায় এ ঋতু নিয়ে নানা সৃষ্টিকর্ম উঠে এসেছে। বারো মাস আর ছয় ঋতু এই তো বাংলার প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। বাংলা মায়ের নতুন নতুর রূপ তার সন্তানদের মুগ্ধ করে রাখে। তাই তো কবি বলেছেন, ‘তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’ ঋতুর পালাবদলে এখন প্রকৃতিতে হেমন্ত এসেছে। শরতের সাদা মেঘের ভেলা এখনও ভাসতে দেখা যায়। বিশেষ করে কার্তিকের আকাশে। প্রকৃতির এই নতুন সাজ বাংলার মানুষের কাছে খুব চেনা। শত বছরের পরিচিত দৃশ্য। বাংলার রূপের নাম হেমন্ত। মাটিতে বিছানো থাকে শিউলি ফুল। কবির কবিতার খাতায় নতুন ছন্দ আসে। গায়কের কণ্ঠে নতুন গানের সুর ওঠে। সে সুর ভেসে যায় বহুদূর পালতোলা নৌকার মাঝির কানে। আনন্দে বৈঠা বেয়ে যায় সে। আশি^ন পেরিয়ে কার্তিক এলেই নবান্নের ধুম পড়ে যায়। এর পরেই যেহেতু শীতকাল। তাই এ মাস থেকে শীতের আগমনী বার্তা জোরেশোরেই বোঝা যেতে থাকে। বেগম সুফিয়া কামালের হেমন্ত কবিতায়- ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে? এই কবিতায় হেমন্তের যে মধুর রূপ ফুটে উঠেছে তা অবর্ণনীয়। খেজুর রস, হাল্কা শীতের মেজাজ, ঘাসের ডগায় শিশিরের অস্তিত্ব, সকালের মিষ্টি রোদ সবকিছুই যেন প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে আসে আমাদের মাঝে। হেমন্তে প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের বহু ব্যবহার দেখা যায় নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতায়। বার বার হেমন্ত এসেছে তার কবিতায়। হেমন্তের মাঠ-ঘাট, সন্ধ্যা, কুয়াশা, শিশির ভেজা ভোর সব তাকে দারুণভাবে টেনেছে। তার বিখ্যাত কবিতা- ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার একাংশে লিখেছেন- হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়। উল্লেখ্য, এই কবিতায় কবি অনেক প্রকারে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও ঋতু হিসেবে কার্তিক অর্থাৎ হেমন্তের প্রাধান্য দিয়েছেন। হেমন্ত এক অপরূপ রূপের ঋতু। যে ঋতুর সঙ্গে মানুষের আনন্দের যোগসূত্র রয়েছে। হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে। শতাব্দিকাল ধরেই আমরা কৃষিপ্রধান দেশ। আর এই কার্তিকেই ফসল ঘরে ওঠে। ধান শুকানো, মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় কাটে। বাংলার খুব চেনা রূপ যে তরুণীর কল্পনা করে সে হেমন্ত বৈ আর কোন ঋতু নয়। সারা বছরের মহাজনের কাছ থেকে ধার নেয়া পাওনা পরিশোধের সুযোগ হয় ফসল ঘরে ওঠার পরেই। সারা বছরের মুখের অন্নের জোগানও আসে এ সময়। হেমন্ত তাই সুখ-সমৃদ্ধির কাল। তাই মুখের হাসিটা অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই থাকে কার্তিকের নবান্নের দেশের মানুষের। জীবনানন্দ দাসের ’কুড়ি বছর পর’ কবিতার প্রথমেই কবি লিখেছেন,’ আবার বছর কুড়ি পরে তার সঙ্গে দেখা যদি হয়/আবার বছর কুড়ি পরে-/হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/কার্তিকের মাসে-/তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী/নরম নরম শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভেতরে! আবার ’নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতায় লিখেছেন- আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!/ যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে/পথের পাতার মতো তুমিও তখন আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে?। হেমন্তের দুই মাস কার্তিক ও অগ্রহায়ণ রূপে আলাদা। শরত ও শীত দুইয়েরই দেখা মেলে হেমন্তে। তাই সম্ভবত হেমন্তকে খুব একটা আলাদা করার প্রয়োজন হয় না! বুঝতেও একটু অসুবিধা হয়! কুয়াশা দেখলে আমরা তাকে শীত বলি। হেমন্ত হলো শীতের পূর্বাভাস। গাছের নিচে তাকালেই রঙিন পাতা ঝরে পড়ার দৃশ্য দেখা যায়। এই শীতের শুরুটাই হলো হেমন্ত যা মূলত অঘ্রাণে ভেসে ওঠে। যেমন বৃষ্টি দেখলে বর্ষা! কিন্তু কুয়াশার শুরু যে সেই হেমন্তে তা যেন ভুলতেই বসেছি। অঘ্রাণে কুয়াশার মাত্র একটু বেশি দেখা যায়। সম্ভবত সেই পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখেই কবি তার ’এই জল ভাল লাগে’ কবিতায় অঘ্রাণের স্তুতি করেছেন। তিনি লিখেছেন- আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে/ঝরে পড়ে;- যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ। অঘ্রাণ বা অগ্রহায়ণ মাস এলেই শীতের তীব্রতা শুরু হতে থাকে। পাতা ঝরা দিনের শুরু হয় তখনই। প্রকৃতিতে নেমে আসে আড়ষ্টতা। হিম করা সন্ধ্যায় থেমে থাকে চারদিক। কবির একটি কবিতায় যেন অঘ্রাণকে ঘিরে। তার অঘ্রাণ প্রান্তরে কবিতায় ‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে/খোঁজে না আর পৃথিবীর পরে-/বলে চুপ থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভেতরে/শুকনো মিয়ানো ছেঁড়া;-অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, গোবিন্দচন্দ্র দাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়ও হেমন্তের রূপছটা উঠে এসেছে। কাজী নজরুল ইসলামে ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতায় লিখেছেন- ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এলা কি ধরণীর সওগাত?/নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মা/গিন্নি পাগল চালের ফিরনি/আতরি ভরে নবীনা গিন্নি/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে খুশিতে কাঁপিছে হাত/শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত! আমাদের পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের কবিতায়ও হেমন্ত এসেছে। এসেছে কার্তিকের ফসল পাকার গান। কবির নক্সী কাঁথার মাঠে লিখেছেন- ’আশি^ন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান/সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হলদি-কোটার গান/ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িয়ে বায়/কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়। আজও এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে/মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে। কবিগুরু তার নৈবেদ্য কবিতায় হেমন্তের কথা বলেছেন। হেমন্ত এলে পাল্টে যায় প্রকৃতি ও মানুষ। গ্রামের পরিবেশে আনন্দ বিরাজ করে। গ্রাম্য মেলা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস বানানোর আয়োজন, ঢেঁকির শব্দ সব মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রকৃতিকে বরণ করে নেয় হেমন্তে।
×