ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে বেপরোয়া

ট্রাক কাভার্ডভ্যান থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ হয়নি

প্রকাশিত: ২১:৫১, ১৬ অক্টোবর ২০২১

ট্রাক কাভার্ডভ্যান থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ হয়নি

আজাদ সুলায়মান ॥ ধর্মঘটের কর্মসূচীতে সম্প্রতি বড় সঙ্কট তৈরির পরও এখনও বন্ধ হয়নি টার্মিনালের বাইরে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার নামে ট্রাক কাভার্ডভ্যান থেকে চাঁদা আদায়। এখনও বেপরোয়া চলছে এ সেক্টরের চাঁদাবাজি। পণ্যবাহী এসব ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় বন্ধ না হলে আবারও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ২৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ১০ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল চাঁদা আদায়ের বিষয়টি। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছেন ট্রাক মালিক সমিতির নেতারা। তারাও বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে সরকারের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসতে আগ্রহী শ্রমিক নেতারা। তবে যদি চাঁদাবাজি বন্ধে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয় তাহলে আগামী মাসেই ফের কঠোর কর্মসূচী আসতে পারে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাঙ্কলরি, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন- আমাদের ১০ দফা দাবি ছিল। সরকার আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে সমাধানে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাজ শুরু হয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার সড়কে এখনও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। আমরা চাঁদাবাজি বন্ধের জোর দাবি জানিয়েছিলাম। সরকারও একমত হয়েছিল। এখনও যে চাঁদাবাজি হচ্ছে তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। তারা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। ঢাকার দুই সিটির মধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নামে কিছুদিন চাঁদা আদায় করা হচ্ছিল। মেয়রকে বিষয়টি জানার পর তা বন্ধ করা হয়। কিন্তু দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছেই। ঢাকার বাইরে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন চাঁদা আদায় হচ্ছে। তবে অন্য দাবিগুলো পূরণ করছে সরকার। প্রশাসন আমাদের সহায়তা করছে। আমরাও তাদের সহায়তা করে যাচ্ছি, যদি চাঁদাবাজি বন্ধ না হয়, তাহলে প্রয়োজনে আমরা আবারও কঠোর হব। আন্দোলনের দিকে যাব। দেখি এবার কি ঘটে। জানা গেছে, সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ, সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০২ ধারায় মামলা বন্ধ, চুরি-ডাকাতি রোধসহ বেশ কিছু দাবিতে গত সেপ্টেম্বরে আন্দোলনের নামে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক শ্রমিকরা। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ধর্মঘটের হুঁশিয়ারি দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়। এরই মধ্যে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি কয়েক দফা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে দাবিগুলো সমাধান করার চেষ্টা করেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাঙ্কলরি, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ ও পরিবহন শ্রমিক মালিকদের একটি গ্রুপ ১০ দফা ও আরেকটি গ্রুপ ১৫ দফা দাবি জানায়। তবে বৈঠকে ১০টি বিষয়ে আলোচনা হয়। এবং ওইসব বিষয় সমাধানে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নে পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের সংগঠন, সিনিয়র সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, আইজিপি, সকল জেলা প্রশাসক ও সরকারের সংস্থাগুলোকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়। সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য দফতরের সচিব ও উর্ধতনরা উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (রাজনৈতিক-৬) শাহে এলিদ মাইনুল আমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো অবহিত করা হয়। এ বিষয়ে শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হচ্ছে- সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হলেও সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় চাঁদা আদায় বন্ধ হয়নি। এ কারণে এখনও তাদের পণ্য পরিবহনে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন মালিক ও শ্রমিকরা। সভায় প্রথম দাবি ছিল ট্রাক চালক লিটন ও আবু তালেব প্রমাণিকসহ সকল হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় আনা। এবং সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০২ ধারায় হওয়া সকল হত্যা মামলা প্রত্যাহার। আলোচনা শেষে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি ও তদন্ত সাপেক্ষে ৩০২ ধারায় মামলার সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় দাবি ছিল-ড্রাইভিং লাইসেন্স জটিলতা নিরসন করে লাইসেন্স প্রদান করা। এ বিষয়ে কমিটি বা টাস্কফোর্স গঠন করে জরুরীভিত্তিতে সকল কার্যক্রম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তৃতীয় দাবি ছিল-পণ্য পরিবহনের সময় মামলাল চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই রোধে জরুরী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বন্ধে চালক, ট্রান্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন ও গাড়ির মালিকদের কঠোর নজরদারির সিদ্ধান্ত হয়। বর্ধিত আয়কর প্রত্যাহার করে করোনাকালীন পূর্বের ন্যায় জরিমানা ব্যতীত গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদের সুযোগ দেয়ার বিষয়ে দ্রুত সভার আয়োজন করে সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সড়ক-মহাসড়কে কাগজপত্র তল্লাশির নামে পুলিশি হয়রানি, চাঁদাবাজি বা মাসিক মাসোহারা বন্ধ করার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ব্যবস্থা নিবে এবং কুইস রেসপন্স টিমের (০১৩২০১৮২১৪৮) নম্বরে কল করে সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। সড়ক ও মহাসড়কে অবৈধ চাঁদা উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এবং স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করার উদ্যোগ বাতিল করার দাবির বিষয়ে, রেজিস্ট্রিকৃত সংগঠনে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটির তালিকা যাচাই-বাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়। তাছাড়া সড়ক মহাসড়কের পাশে এবং প্রত্যেক জেলায় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করার বিষয়ে ৬৪ জেলায় ও মহাসড়কের পাশে উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করে টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। টার্মিনাল ছাড়া ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার সড়ক এবং মহাসড়কে অবৈধ চাঁদা বন্ধ করার দাবি ছিল অন্যতম। এ বিষয়ে টার্মিনাল ছাড়া অন্যত্র চাঁদা না নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দেশে সড়ক মহাসড়কগুলো শুধু হাইওয়ে পুলিশের অধীনে তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে এবং নির্দিষ্ট স্থানে কাগজপত্র তল্লাশির ব্যবস্থা করার বিষয়ে বিনা প্রয়োজনে তল্লাশি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। ওই আলোচনা শেষে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন শ্রমিক নেতারা। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যেসব সমস্যা তাৎক্ষণিক সমাধান করা যায়, সেগুলো সমাধানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর যেগুলোতে সময় লাগবে সেগুলো ধীওে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় চালক-সহকারীদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, কেউ ইচ্ছে করে কারও উপরে যদি গাড়ি চালিয়ে দেয়, তাহলে অবশ্যই ৩০২ ধারায় যাবে। তাদের দাবি ছিল- পুলিশ যেন সঠিকভাবে ইনকোয়ারি করে কনভার্ট করে। রাজধানীসহ দেশব্যাপী চাঁদাবাজি সম্পর্কে হাইওয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হাইওয়েতে কোন ধরনের চাঁদাবাজি হলে বরদাশত করা হবে না। বিশেষ করে কোন ধরনের পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করার ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। চাঁদাবাজি প্রতিরোধে গোয়েন্দা নজরদারি কয়েক দাফ বৃদ্ধি করা হয়েছে সড়কে। পুলিশের কোন সদস্য এসব অপকর্মে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাঙ্কলরি, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের এক নেতা জানান, জরিমানা ছাড়া গাড়ির কাগজ ঠিক করা, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা কাজ শুরু হয়েছে। আমরা চিঠি পেয়েছি। তবে সিটি কর্পোরেশন থেকে চাঁদা নেয়া বন্ধ হয়নি। এটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। সিটি কর্পোরেশন অনেক ইজারাদার নিয়োগ করছে। তারা চাঁদা নেয়া বন্ধ করেনি। তারা এখনও টাকা উঠাচ্ছে। আমরা মেয়রদের চিঠি দিচ্ছি। এতেও সমাধান না হলে আমরা কঠোর হবো। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, ট্রাক বা পণ্যবাহী পরিবহন থেকে টাকা না নেয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। আমরা এমন কোন সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানি না। যে কারণে ইজারাদারদেরও কিছু জানাইনি আমরা। সিদ্ধান্ত রেজুলেশন আকারে আসতে হয়তো সময় লাগছে। তবে আগামী দিনগুলোতে এভাবে চাঁদাবাজি হলে তখন আরও বড় কর্মসূচী আসতে পারে।
×