ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তের পাশাপাশি ঢাকায়ও বাড়ছে করোনা

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ১১ জুন ২০২১

সীমান্তের পাশাপাশি ঢাকায়ও বাড়ছে করোনা

অপূর্ব কুমার ॥ সীমান্তের জেলার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাতেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার। মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে ঢাকাতে সংক্রমণের হার দ্বিগুণ বেড়েছে। ডেল্টা ধরনের প্রভাব ও দেশের মানুষের সব ধরনের কর্মকাণ্ডের একমাত্র স্থান হওয়ায় রাজধানীতে দ্রæত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। করোনা শনাক্তের হার বিবেচনায় মনে হচ্ছে করোনার তৃতীয় ঢেউ খুবই নিকটে অবস্থান করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ইতোমধ্যে কঠোর হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছে। স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ না মানলে চলতি মাসে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এপ্রিলের শেষ নাগাদ দেশে সংক্রমণের যে নিম্নগতি ছিল সেটি এখন উর্ধমুখী। ঈদ কেন্দ্রিক মানুষের যাতায়াতের সঙ্গে ডেল্টা ধরন যুক্ত হয়ে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আবারও শঙ্কার মুখে ফেলেছে। এখনকার সংক্রমণকে তৃতীয় ঢেউ না বলেও এভাবে চলতে থাকলেও তৃতীয় ঢেউ খুবই অল্প সময়ে বাংলাদেশে আছড়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর পাশাপাশি এখন খোদ রাজধানীতেও সংক্রমণের হার জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। সীমান্তের জেলাগুলোর সংক্রমণ পুরো দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। এছাড়া সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে দেশে প্রাপ্ত নমুনার ৮০ শতাংশ ডেল্টা ধরন। এই ধরনের সংক্রমণ ক্ষমতা গতবারের ধরনের ৫০-৬০ গুণ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার ঢাকাতে নমুনার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। গত জুন ঢাকাতে মে ২৭৩ জন রোগী শনাক্ত হয়। নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৯ শতাংশ। ৮ জুন মোট ৩১৯ জন রোগী শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ১০ শতাংশ। ৭ জুন রোগী শনাক্ত হয় ৩২৭ জনে। এই দিনে মোট শনাক্তের হার ৭ শতাংশ। ৬ জুন মোট শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২৪৫ জন। রোগী শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশ। ৫ জুন রোগী শনাক্ত হয় ২৩৬ জন। শনাক্তের হার ৫ শতাংশ। ৪ জুন মোট শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৬৭ জনের। শনাক্তের হার ৫ শতাংশ। ৩ জুন মোট শনাক্ত হয় ২৯৪ জন রোগী। শনাক্তের হার ৬ শতাংশ। ২ জুন মোট ২৪০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৪ শতাংশ। ১ জুন মোট ২৪০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৪ শতাংশ। গত মে মাসের পুরোটা জুড়েই রাজধানীতে করোনা সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের নিচে ছিল। গত ১৩ মে ঢাকায় একদিনে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়। ১২ মে করোনা রোগী শনাক্তের হার ছিল ৮ শতাংশ। ২০ মে ৭ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়। বাকি পুরোটা মাস ধরেই করোনা সংক্রমণের হার ছিল ৬ শতাংশের নিচে। বেশিরভাগ দিনেই করোনা শনাক্তের হার ছিল ৬ শতাংশ। রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ডাঃ মুসতাক হোসেন বলেন, বর্তমানে করোনা শনাক্তের হার উর্ধমুখী। সীমান্তবর্তী জেলাগুলো ছাড়াও সারাদেশে দ্রæত সংক্রমণ বাড়ছে। সংক্রমণ বাড়লেও এখন পর্যন্ত করোনার তৃতীয় ঢেউ বলার মতো সময় আসেনি। দ্বিতীয় ঢেউ কিছুটা নিম্নমুখী হয়ে ফের উর্ধমুখী হচ্ছে। তবে কয়েকটি জেলার সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনক। তিনি বলেন, সংক্রমণ মোকাবেলায় রোগীকে শনাক্ত হয়ে দ্রæত চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। রোগীকে দ্রæত আইসোলেটেড করতে হবে। তাহলে সংক্রমণ ছড়াতে পারবে না। এছাড়া জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। ঈদের পর সীমান্তের জেলাগুলো করোনার হটস্পট হয়ে উঠলেও চলতি মাসের ৬ তারিখের আগ পর্যন্ত রাজধানীতে করোনা পরিস্থিতি স্বস্তির ছিল। দেশের সব কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হওয়ার কারণে আস্তে আস্তে করোনা সংক্রমণের হার রাজধানীতে বাড়তে শুরু করেছে। চিকিৎসা সেবা, ব্যবসা বাণিজ্য, সীমান্ত জেলাগুলো থেকে কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য রাজধানীতে আনা হচ্ছে। আবার রাজধানী থেকেও বাইরে যাচ্ছে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের জন্য ঢাকা পুনরায় করোনা হটস্পট হয়ে উঠার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। গত এক মাস ধরে রাজধানীতে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখা গেছে। রাজধানীতে গণপরিবহন চালু, সব ধরনের ট্রেন, লঞ্চ ও নৌ-যান স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করার পরও গাদাগাদি করে মানুষ চলাচল করছে। এছাড়া মাস্ক ব্যবহার না করা, সামাজিক দূরত্ব না মানা, দোকানপাট ও বিপণিবিতানগুলোতে ভিড়ের কারণে এখন রাজধানীতে করোনা সংক্রমণ উর্ধমুখী। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডাঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা সংক্রমণ রোধে স্থানীয়ভাবে জারি করা বিধিনিষেধ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে শিথিলতার পরিচয় দিলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। শুধুমাত্র সীমান্ত এলাকা নয়, রাজধানীসহ দেশের সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ মানতে হবে। নইলে চলতি জুন মাস আগের মতো স্বস্তিদায়ক হবে না। গত ৮ জুন সকাল আটটা থেকে ৯ জুন সকাল পর্যন্ত বিভাগ ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে তার আগের ২৪ ঘণ্টায় চেয়ে সংক্রমণ বেড়েছে। কমেছে কেবল রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের শনাক্তের হার। আর ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি শনাক্তের হার রংপুর বিভাগে। বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে শনাক্তের হার সাত দশমিক শূন্য এক, যা কিনা তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ছয় দশমিক শূন্য চার শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে শনাক্তের হার ১০ দশমিক শূন্য সাত, যা তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল সাত দশমিক ৯৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ১১ দশমিক শূন্য এক শতাংশ, রংপুর বিভাগে শনাক্তের হার ৩২ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ, আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ২৮ শতাংশ, আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সিলেট বিভাগে শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ, আগে ২৪ ঘণ্টায় ছিল ১১ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। শনাক্তের হার কমা বিভাগের মধ্যে রাজশাহী বিভাগে রয়েছে ১৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ আর খুলনা বিভাগে শনাক্তের হার ৩৬ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ, যা কিনা তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ৩৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এদিকে, তার আগেরদিন ৭ জুন বিভাগ ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে শনাক্তের হার ছিল পাঁচ দশমিক শূন্য শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৩০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ আর সিলেট বিভাগে ছিল ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাসহ যেসব জায়গাতে সংক্রমণের হার বাড়ছে সেসব জায়গায় অন্যরকম ব্যবস্থা’ নিতে হবে। তিনি বলেন, জনসংখ্যা কত সে বিবেচনা নিয়ে সংক্রমণ পরিস্থিতি দেখতে হবে। কারণ, রাজধানী ঢাকায় যে পরিমাণ মানুষ থাকেন রাজশাহী শহরে তার চেয়ে অনেক কম লোকের বাস। সে হিসেবে সংক্রমণের হারে অনেক তফাৎ। তাই সেভাবেই ধরতে হবে সংক্রমণের হার। শুরুতে কম থাকলেও রাজধানীতে সংক্রমণে হার এখন উর্ধগতি। তবে আমাদের (জাতীয় পরামর্শক কমিটি) পরার্মশ ছিল, পুরো বাংলাদেশেই বিধিনিষেধ চলুক কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকাতে ভিন্ন লকডাউন দেয়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনও উপজেলায় করোনার নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৫৯ শতাংশ এবং এটি সত্যিই বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ যাতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্য জরুরী ভিত্তিতে দুই সপ্তাহের জন্য সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে অবশ্যই কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
×