ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতকে দেখেও আমরা সাবধান হব না?

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ১১ মে ২০২১

ভারতকে দেখেও আমরা সাবধান হব না?

মাঝে মাঝে উল্টাপাল্টা ঘটনার ঢেউ এসে ঢেকে দেয় বাস্তবতা। এটাই যেন আমদের দেশের মানুষের নিয়তি। যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আমি বলব দ্বিতীয় ফণা গোপনে দংশনের জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন আমরা উদ্যাপনে ব্যস্ত। একের পর এক অতিথি রাজকীয় গেস্ট। তাঁরা যাওয়ার পর দেশে যখন করোনা আঘাত হানতে শুরু করল আমাদের সামনে হাজির হলেন মামুনুল হক। হেফাজতের কাহিনী না নতুন, না এর কোন সমাধান আছে? আপনি ভাল করেই জানেন দেশে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, কিছু মিডিয়া আছে, কিছু মানুষ আছেন যারা সরকারকে কেয়ার করেন না এবং সেটা তারা পরিষ্কার করে বলেনও। হেফাজতের আদেশে তাদের পাঠক্রম চলে। তাদের ছাত্রদের পড়াশোনায় কি আছে কি নেই তার সঙ্গে দেশের স্বাভাবিক ধারার মিল আছে কি নেই সরকার ভাল জানে। কিন্তু কিছু বলে না। তাদের নেতা মামুনুল হক এখন ঘোর বিপদে। তাকে একের পর এক মামলা ও রিমান্ডে কাহিল হতে দেখছি। মামুনুল হকের বেলায় সরব বুদ্ধিজীবীদের এবারের চেহারাটা কিন্তু ভিন্ন। এবার বলতে নতুন যে ঘটনা তার কথা বোঝাতে চাইছি। মামুনুল হকের বেলায় সরবেরা বসুন্ধরার এমডির বেলায় কেন নীরব? এটা জানতে চাইলেও বিপদ। সামাজিক মিডিয়ায় রাজাকার ট্যাগ খাওয়ার পাশাপাশি প্রশ্ন ওঠে প্রশ্ন করে, আমি কি মামুনুল হকের সমর্থক? কি বিপদরে বাবা! সত্যি কথা কি একেবারেই নিষিদ্ধ হয়ে গেল আমাদের সমাজে? এই চরিত্র বিষয়ক লেখা আজ আমার উদ্দেশ্য নয়। জাতির চারিত্রিক অধঃপতন না নতুন, না কোন বিস্ময়ের ঘটনা। তার সমাধান ঘটাতে প্রয়োজন সামাজিক জাগরণ ও আইনের সঠিক ব্যবহার। সেটা কবে হবে বা হবে কি না কেউ জানে না। তাই সেদিকে নজর না দিয়ে বলব আমাদের জাতির সামনে সমূহ বিপদ করোনা। বিশেষত ভারতের বেহাল আর সামনে যে ঈদ উৎসব তার আলোকে এখন সাবধানতার বিকল্প নেই। সাবধান মানে কঠোর সাবধানতা ছাড়া প্রতিবেশী ভারতের অবস্থা এড়ানো যাবে না। ভারত নিয়ে কিছু লেখা বা বলাটাও অনিরাপদ। সীমান্ত হত্যা, পানি বণ্টন সমস্যাসহ নানা কারণে নাজুক সম্পর্কের কারণে ভারত ও সংখ্যালঘুবিরোধিতা এখন একাকার। জন্মগত পরিচয় হিন্দু হওয়ার কারণে লেখালেখি করতে এসে যত গালি শুনেছি তার সিংহভাগ ভারতকে জড়িয়ে। দেশ বিভাগের দাঙ্গার পর পিতৃ ও মাতৃকুলের প্রায় সবাই চলে গেলেও আমার মা-বাবা জন্মভূমি ছেড়ে যাননি। তাঁরা দুজন ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রামে। তারপরও আমরা নাকি ভারতের দালাল। একাত্তরে শরণার্থী হয়ে প্রথম ভারত যাই। বাংলাদেশ তখন রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লড়ছে। অসম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা হয়ে কলকাতা পৌঁছানো- আমরা কোথাও শরণার্থী বলে অপমানিত হইনি। পুরো নয় মাসজুড়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের মানুষ দিয়েছিল প্রাণখোলা অকুণ্ঠ সমর্থন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী না থাকলে বাংলাদেশ কতদিনে স্বাধীন হতো বা আদৌ স্বাধীন হতে পারত কি না, এ সংশয় থেকেই যায়। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়সহ খাইয়ে-পরিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শিল্প-সংস্কৃতি, বাণিজ্য, খেলাধুলা সব মিলিয়ে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কয়েক বছর পরপর কলকাতা যাওয়া তখন নেশা। সিডনি চলে আসার পর বহু দেশ বহু জাতি ভ্রমণে অভ্যস্ত হবার পরও মনে হয় ভারত না গেলে যাত্রা পূর্ণতা পায়নি। কারণ ইতিহাস। কারণ অতীত ঐতিহ্য ও সংযোগ। ভারত মানেই তো আজমীর শরীফ। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দেখতে গিয়ে জালিয়ানাওয়ালাবাগে না গেলে হয়? ভারতবর্ষের স্বাধীনতার নান্দীপাঠ রক্তমাখা সে ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর নাইট উপাধি। সাউথ ইন্ডিয়া গেলেই মনে পড়ে বিবেকানন্দের কন্যাকুমারিকা। বাঙালী মনীষা দার্শনিক ঋষি অরবিন্দের প-িচেরী না ঘুরে এলে কি তীর্থ হয়? বাংলার মানুষ প্রেমে পড়লেই যে জিনিসটা গড়ে তোলে তার নাম তাজমহল। মনে তার যমুনার ঢেউ। দিল্লী যাবেন জামে মসজিদ দেখবেন না? কুতুবমিনার না দেখে উপায় আছে? ভারত শুধু মোদি-মমতার দেশ নয়। ভারত জাকির হোসেন, অমিতাভ বচ্চন, দীলিপ কুমার, নার্গিস, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের দেশ। আম্বেদকার, এ পি জে আবদুল কালাম, অমর্ত্য সেনের দেশ। বাঙালীর রোজ দরকার পড়ে জয়তীর রবীন্দ্রসঙ্গীত, সুমন, নচিকেতা হয়ে রূপঙ্করের গান। ভারত মানেই তো রবীন্দ্রনাথ, চুরুলিয়ার নজরুল, গান্ধী, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, সত্যজিৎ রায়, বিভূতি ভূষণ, মানিক, সুনীল, শঙ্খ ঘোষ। আজ সেই ভারত মহামারীর যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার পথে। প্রতিদিন চিতার আগুন, কবরের মাটিতে কাঁদছে ভবিষ্যত। যত সমস্যা, যত অভিমান, যত রাগ-অভিযোগ থাকুক সে হিসাব পরে। এখন একটাই প্রার্থনা, উঠে দাঁড়াক ভারত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ভারতেরে সেই স্বর্গে কর জাগরিত। মনে রাখা ভাল নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না। নিকটতম প্রতিবেশী যার সঙ্গে চারদিকে সীমান্ত তার সুস্থতা ব্যাহত হলে আমরাও ভুগব। ভারত নির্ভরতা আছে এ কথা মানার পরও এখন তার সঙ্গে সব ধরনের মানুষ বিষয়ক যোগাযোগ বন্ধ রাখতে হবে। ঈদের সময় কলকাতা ও ভারতের বেশ কিছু জায়গা হয়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। দলে দলে বাংলাদেশী ভিড় জমান সেখানে। এবার যাবেন না বা যেতে পারবেন না। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এক-দুজনও যদি যায় আর ফিরে আসে সেটাই আগুন জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া ভারত যেভাবে আজ বিপদের মুখে সে বিপদ যেন আমরা ডেকে না আনি। এই যে ঈদ আর আমাদের আনন্দ-উৎসব তার সবটাই কি কেবল কেনাকাটা? যে হারে কেনাকাটার ধুম চলছে তাতে মনে হতে পারে এটাই যেন জীবনের একমাত্র ও শেষ ঈদ । এই যে মা-বাবা, ভাই-বোন বাচ্চাদের জন্য কেনাকাটা তারা ভাল না থাকলে কি হবে বাজার দিয়ে ? আমরা নিশ্চয়ই চাই না আমাদের শেষ বাজার হোক অক্সিজেন কেনা! ভারতের ঘটনা চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিচ্ছে করোনা কতটা ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী হতে পারে। ভারতের জন্য আমরা এবং সে দেশের বিবেক কাঁদলেও ভারতের মোদি সরকার নির্বাচন করিয়ে ছেড়েছে। সরকারের ভুলের কারণে ভারতের করোনা নতুন বল ও শক্তি পেয়েছে। আমরা যেন আর সে ভুল না করি। ঈদ আবারও আসবে। আবারও আমরা উৎসব করব। স্বয়ং ঈশ্বরও বলেন বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে। পবিত্র কোরানে বারবার যে সংযমের কথা বলা হয়েছে সেটাই প্রমাণের সময় এখন। [email protected]
×