ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশ প্রত্যেকটি শব্দ আজ সমার্থক। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুই অন্য সবার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এই বিশাল জগতে ততোধিক বিশালত্ব নিয়ে বিরাজিত একটি নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত, ১৯৪৭-১৯৫৬ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭ সালে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে কোন মিল না থাকার পরও দুটি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোর পাঁয়তারা করে, যার প্রতিবাদ করে সাধারণ মানুষ। ছাত্রনেতা মুজিবের নেতৃত্বে কলকাতায় একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ঢাকায় ফিরেই বঙ্গবন্ধু সরাসরি যুক্ত হন ভাষা আন্দোলন ও গণস্বাক্ষর অভিযানে। ১৯৪৭ এর আগস্টে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা পাঠ করেন ছাত্রনেতা মুজিব। প্রস্তাবনায় ছিল, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আদালতের ভাষা করা, সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া, অন্যদিকে বাঙালীর ভাষা ও কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধে ১৯৪৮ এর ৪ জানুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ পুনর্গঠিত হয়। ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি ছিল অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলের তমুদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, মুজিবসহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন তারাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছড়াচ্ছে। ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয় এবং ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসে। সভায় একটা অংশ সরকারের সঙ্গে আপোস করতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বললেন, আগামীকাল ধর্মঘট হবে। সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। ১১ মার্চ হরতাল হয়েছিল, পিকেটিং হয়েছিল এবং সেখান থেকে মুজিবসহ ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১১ মার্চের আন্দোলন তখন ছড়িয়ে পড়ে সারা পূর্ব পাকিস্তানে। অবস্থা বেগতিক দেখে খাজা নাজিমুদ্দীন সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে আট দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। বঙ্গবন্ধুসহ অধিকাংশ নেতা কারারুদ্ধ থাকায় চুক্তির খসড়া কারাগারে নিয়ে তাঁদের সম্মতি নেয়া হয়েছিল এবং শর্তানুসারে ১৫ মার্চ মুজিবসহ নেতারা মুক্তি পেলেন। ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সভা শেষে দাবি আদায়ে ব্যবস্থাপক সভা ঘেরাও করেন। সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস সত্ত্বেও প্রতিবাদ করেছিলেন তারা। ১৯৪৮এর ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা এবং ২৪ মার্চ সমাবর্তনেও একই ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার বিরুদ্ধে মুজিবসহ উপস্থিত ছাত্ররা এবং পরে ছাত্র-যুবকরা ভাষার দাবিতে সভা ও মিছিল করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি ধর্মঘটের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে জুলুম প্রতিরোধ পালিত হয়। আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে তাঁকে দু’বার গ্রেফতার করা হয়। তবে কারাগার থেকেই ওই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন তিনি, যা ওই বছরের সরকারের গোপন দলিলে লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন পল্টনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বন্দীদশায় থেকেও কিভাবে মুজিব ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা ও নেতৃত্ব দিতেন তা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, কারাগারের রোজনামচা, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের লেখনীতে উঠে এসেছে। তা ছাড়া, সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক গ্রন্থের দু’খণ্ডেই ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণের প্রমাণ রয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে সারাদেশে ব্যাপক কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় এবং সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক লিখেছেন ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হওয়ার পর শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। তবে জেলে থেকেই তিনি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন।’ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে ইতিহাস হলো মুজিব তখন কারাগারে, ১৯৫২ এর ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট হলো। কারাগার থেকেই তিনি হরতালে সমর্থন, নির্দেশনা দেন আইনসভা ঘেরাও ও সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে অনশন করেন। ফলে তাঁকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করে ১৬ ফেব্রুয়ারি এবং যাওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে কর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে সভা হয় এবং একুশের হরতালের প্রতি সমর্থন জানানো হয়। এদিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন এবং মুক্ত বঙ্গবন্ধু স্বৈরাচারবিরোধী ও ভাষা আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ১৯৫৩ এর একুশের প্রভাতফেরিতে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন এবং এদিন আরমানিটোলার জনসভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানান। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনে সরকার নতি স্বীকার করে এবং ১৯৫৪’র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। এতে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এদিকে ১৬ ফেব্রুয়ারির আইন সভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৫৫ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধিকারের দাবিও তোলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু পূর্ববাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান বলায় বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদে বক্তব্য রাখেন। এভাবেই ভাষার লড়াইকে পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত করেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারে অফিস-আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন, ১৯৭২ এর সংবিধানের মর্যাদাদান, সরকারপ্রধান হিসেবে ১৯৭৪ এর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দান এবং ১৯৭৫ এর ১২ মার্চ সরকারী কাজে বাংলাভাষা প্রচলনের নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে একুশের চেতনায় গড়ে ওঠা বাঙালী শিল্প, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে ধ্বংস করে চক্রান্তকারীরা। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার তা পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর উদ্যোগেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে তা পালনও করা করছে। আত্মমর্যাদার সমুন্নত এক জাতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অন্তহীন প্রেরণার নাম একুশ। বাঙালীই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য যুদ্ধ জীবন দিয়েছে বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের সৃষ্টি বা অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। একুশ ও বঙ্গবন্ধু মিশে আছে বাঙালীর ইতিহাসের পাতায়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে বাঙালীর সাহস, শক্তি ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে একুশ ও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন, আদর্শ ও সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে সবাইকে। লেখক : পরিচালক, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×