ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টিকা কি আসবে কে কি বলেছিলেন সেদিন!

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২১ জানুয়ারি ২০২১

টিকা কি আসবে কে কি বলেছিলেন সেদিন!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ অবসান হলো অপেক্ষার। টাকার বিনিময়ে নয়। বিনামূল্যেই দেশে আসলো ভারতের তৈরি অক্সফোর্ডের করোনা ভাইরাসের টিকা ‘কোভিশিল্ড’।কেবল তাই নয়, এখন পর্যন্ত ভারতের উপহার হিসেবে অন্য যে কোন দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ২০ লাখ ডোজ টিকা পেলো বাংলাদেশ। তবে সরকারের ইতিবাচক কুটনৈতিক সাফল্যের পথ ধরে টিকা আসার সঙ্গে সঙ্গে এখন মূখে কুলুপ আটার দশা দেশের ‘গুরুত্বপূর্ন’ অনেক ব্যক্তির। ‘অন্য দেশে টিকা পাঠানোয় ভারতের নিষেধাজ্ঞা’ এমন এক গুজবকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই টিকা আসা নিয়ে ছিলেন সন্দিহান, না হয় সরকার ও ভারত বিরোধী জিকির তুলে রাজনৈতিক ফাঁয়দা লোটার প্রহর গুনছিলেন। বিএনপির-জামায়াতের কায়দায় গুজব ও সন্দেহের বিষ ছড়ানোর চেষ্টায় সক্রিয় কাউকেউ অবশ্য বৃহস্পতিবার ভারতের তৈরি অক্সফোর্ডের টিকা ‘কোভিশিল্ড’ আসার দিকে কথা বলতে দেখা যায়নি। ভারত সরকারের উপহার হিসেবে দুপুরে ২০ লাখ ডোজ টিকা ঢাকায় এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশ কিছু মিডিয়া ও বিশিষ্টজন এই টিকা আসার বিষয়ে ছিলেন দারুণ সন্দিহান। এসোসিয়েট প্রেসে (এপি) প্রকাশিত সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইনডিয়ার প্রধান নির্বাহী আদর পূনাওয়ালার এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সেই সন্দেহ আর গুজবের খেলা। এপিতে বলা হয়েছিলো, কয়েক মাসের জন্য টিকা রপ্তানির অনুমতি দেবে না ভারত সরকার। দেশটির জনগণ যাতে যথাযথভাবে টিকা পায় সে জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে নিজ টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে তিনি লেখেন, ‘আমাদের যে কোনো দেশে টিকা রপ্তানির অনুমোদন রয়েছে।’ তারপরও চলে আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনা। এই সুযোগে আলোচনায় আসেন জনপ্রিয় কলাম লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ডা. আসিফ নজরুল। তার ফেসবুকে প্রায় সাত লাখ ২৬ হাজার অনুসারিকে লেখেন, ‘বিবিসির আজকের রিপোর্ট অনুসারে ভারতের বায়োটেকের উৎপাদিত টিকা অনুমোদিত হয়েছে পিয়ার রিভিউ (ফেজ ১ ও ২ ) ছাড়া এবং অসম্পূর্ণ ফেস থ্রি ট্রায়ালের ভিত্তিতে। এটা তো উদ্বেগজনক! মনে হচ্ছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন না দিয়ে শেষে বায়োটেকের ভ্যাকসিন ভারত আমাদেরকে গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। সরকার কি তখন শক্ত থাকবে?' যদিও তার এমন বক্তব্যের সঠিক কোন ভিত্তি ছিলো না এবং তা মিথ্যা প্রমাণ করে শেষ পর্যন্ত বায়োটেকের টিকা নয়, বরং অক্সফোর্ডের টিকাই পৌঁছালো বাংলাদেশে। জাতীয় দৈনিক দ্য নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর তার ভেরিফাইড ফেসবুক প্রফাইলে ভারত থেকে টিকা সময়মত নাও আসতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়ে লেখেন, ‘ভারত আমাদের এত ভালো বন্ধু যে যখন আমাদের নদী বন্যায় প্লাবিত হয় তখন পানি পাঠায়, আর যখন আমাদের কৃষকরা পেয়াজ উৎপাদন করে তখন পেয়াজ পাঠায়। আর তারা আমাদের তখন করোনার ভ্যাকসিন সরবরাহে অস্বীকৃতি জানায় যখন আমরা অন্য কোন ব্যবস্থাই রাখিনি। আমাদের এমন অসাধারণ বন্ধুত্ব অচিরেই ত্যাগ করা উচিত’। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন দেশে পৌঁছানোর পর বিষয়টি নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি তারা। আজ বিনামূলে টিকা পেল দেশ। অথচ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পপ্রতষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ভারত যে টিকা (করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন) পাচ্ছে দুই ডলারে, আমরা সেই টিকা পাচ্ছি সোয়া পাঁচ ডলারে। বাড়তি এই টাকার অংশ কে পাচ্ছে সে বিষয়ে প্রশ্নও তুলেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এখানেই শেষ নয়, তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ ভারতের সেরামকে টিকার জন্য প্রথম ধাপে যে ছয়শ কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ, তার চেয়ে কম টাকায় যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশ বিজ্ঞানীকে এক কোটি টাকা মাসিক বেতনে দেশে আনা হতো, তাতেও দেশের ১২০ কোটি টাকা খরচ হতো। তাহলে এখানে অনেক বিজ্ঞানী তৈরি হতো’ এদিকে করোনার টিকা নিয়ে কম টিপ্পনী খেতে হয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। ছাড়েননি সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিতরাও। বিগত মাসগুলোতে অনেকেই দাবি করেছেন বাংলাদেশে টিকি আনার জন্য কোন কাজ করছেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অনেকেই ছিলেন সন্দিহার। বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও দেশের এক সময়কার জনপ্রিয়া টিভি শো ‘পরিপ্রেক্ষিত' এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ বোরহান কবীর ‘টিকা এবং টিপ্পনী’ শিরোনামের এক কলামে লেখেন, ‘টিকা নিয়ে আসলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী করেছেন যাতে তিনি নিশ্চিত যে ফেব্রুয়ারির শুরুতে আমরা টিকা পাব? এ মুহূর্তে সারা বিশ্বের ১০৭টি দেশে করোনার টিকা প্রদানের কার্যক্রম চলছে। এখানে একটি কথা বলে রাখি, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়নি। (জ্যোতিষীদের সব ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে কে বলেছে? দু-একটা সত্য হলেই তাঁর পসার জমে যায়)। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বিশ্বে করোনার টিকা আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পাবে।’ কিন্তু বাংলাদেশ পাবে বলে ‘আকাশের ঠিকানায় চিঠি’ লিখলে তো আর করোনার টিকা বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো ঝরবে না। গুজব ও সন্দেহের বিষ এননভাবে কদিন কিছুৃ গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছিলো যে, মনে করা হয় এতেই সাধারন মানুষের মনে টিকা নিয়ে একটা নেতিবাচব মনোভাব তৈরি হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য অক্সফোর্ডের টিকাকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মাঝে ফেলার জন্য ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যকে দায়ী করছেন এখন অনেকেই। বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, অন্য অনেকে সন্দিহান ছিলেন টিকা আসবে কিনা। আর আসিফ নজরুলের বক্তব্য ভারতে তৈরি অক্সফোর্ডের টিকাকেই জনসাধারনের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। এটা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। গুজবের কারনে একটা সময় পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে, সত্যিটা প্রকাশ করে জনসাধারনের কাছে টিকার বিষয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরী হয়ে পরেছিলো। সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লেখক ও অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাত তার এক লেখায় তখন অনেকটাই হতাশা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ভারতের একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান করোনা ভ্যাকসিন আনার জন্য চুক্তি করবে, আর এটা বিনা বাধায় কোনও প্রোপাগান্ডা ছাড়া এসে যাবে তা কল্পনা করাটাও কষ্টের! অন্তত বিগত সময়ে আমরা তাই দেখে এসেছি! যেকোনও ইস্যুতেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইলে একদল সব গেলো বলে রব তুলে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি! ইতোমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় অপপ্রচার শুরু হয়েছে এই মর্মে যে, বাংলাদেশ নাকি ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে কোনো কারণ ছাড়াই কম টাকার ভ্যাকসিন বেশি টাকায় কিনছে! ইউরোপ ও আমেরিকার চেয়েও বেশি দামে ভ্যাকসিন কিনছে বাংলাদেশ। এবং এই বক্তব্য অনেক মানুষ শেয়ার দিচ্ছে, অনেকে বিশ্বাসও করছে।’ কিন্তু বাস্তবতা আসলে যে তার নয় বিশে^র বিভিন্ন দেশের তথ্য প্রমান তুলে ধরে লেখার প্রমান দিয়েছিলেন লেখক। তবে সত্যটা বের হয়ে আসতে সময় লাগেনি। এই মুহুর্তে একটাই খবর। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে উপহার পেলো। যার পরিমাণ অন্তত ২০ লাখ ডোজ। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে পৌঁছেছে ভ্যাকসিনের চালান। বাংলাদেশ যে ভ্যাক্সিন পেলো তার পুরোটাই অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত কোভিশিল্ড যা তৈরি করেছে ভারতের সিরাম ইনসস্টিটিউট। এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমে টিকা নিয়ে এতদিনের অপপ্রচার বিশেষত আসিফ নজরুলের মতো বিশ^বিদ্যাালয়ের একজন শিক্ষকের কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন ক্ষোভ ঝেড়েছেন অনেকেই। অনেকেই বলছেন, ‘এই ভ্যাকসিন প্রথমে আসিফ নজরুল ও তাদের আদর্শিক বন্ধুদের দেয়া হোক। যারা মনে করেছিল ভারত ভ্যাকসিন দিবেনা। দিলেও অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিন দিবেনা। সরকার ভ্যাকসিন আনতে পারবে না। ধান্দা ছিলো ভ্যাকসিন নিয়ে এই বুঝি সরকার বিরোধী মওকা পাওয়া গেল।" আহারে সরকার বিরোধী ধান্দাটা হাতছাড়া হয়ে গেল!
×