ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লোকসানের ভয়

খালাস হচ্ছে না আমদানি করা পেঁয়াজ, উঠছে নিলামে

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১৭ জানুয়ারি ২০২১

খালাস হচ্ছে না আমদানি করা পেঁয়াজ, উঠছে নিলামে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ একদিকে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ, অন্যদিকে আমদানির ভারতীয় পেঁয়াজ। পেঁয়াজের বাজারে আগের সেই অস্থিরতা এখন একেবারেই নেই। দরপতন হয়েছে ব্যাপক। ফলে ভারত ব্যতীত বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির যেসব পেঁয়াজের চালান এসেছিল তার একটি অংশের খালাস নেই। এসব পেঁয়াজ এখন নিলামে উঠছে। কিন্তু ভারত যখন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে তখন ছিল না দেশীয় পেঁয়াজ। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকারকরা যে পেঁয়াজ আমদানি করে আনে তারই একটি অংশ এখন নিলামে তোলা হচ্ছে, যার পরিমাণ প্রায় ১১ শ’ টন। ওই সময়ে দেশীয় টাকায় এর মূল্য ছিল ৫ কোটি টাকারও বেশি। সেই পেঁয়াজ এখন পচে যাওয়ার উপক্রম। কারণ, নিশ্চিত লোকসানের মুখে আমদানিকারকরা এই পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করছে না। ফলে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে আগামী ১৯ জানুয়ারি নিলামে তুলছে। এদিকে, শনিবারের খাতুনগঞ্জের বাজার চিত্রে দেখা গেছে, পাইকারদের কাছে পেঁয়াজের কোন সঙ্কট নেই। আমদানিকারকদের সূত্রে জানানো হয়েছে, এখন শীত মওসুম বিভিন্ন ধরনের সবজির পাশাপাশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হচ্ছে। এ অবস্থায় পেঁয়াজের চাহিদা আগের তুলনায় কিছুটা কম। এর ওপর প্রায় চার মাস বন্ধ রাখার পর ভারত পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে প্রতিনিয়ত ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি হয়ে আসছে। গত ২৮ ডিসেম্বর ভারত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর এখন দেশীয় পেঁয়াজের পাশাপাথি ভারতীয় পেঁয়াজে সয়লাব হয়ে আছে বাজার। এতে করে সঙ্কটকালে মিয়ানমার, পাকিস্তান, মিসর, আফগানিস্তান, হল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, চীন, ইউক্রেন, ইরান, তুরস্কসহ যেসব দেশ থেকে পেঁয়াজের চালান বন্দরে আমদানি হয়ে এসেছিল তা পুরোটা খালাস হয়নি। কারণ, ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি এবং দেশীয় পেঁয়াজের উৎপাদন বাজারে চলে আসায় দাম হ্রাস পেতে থাকে। ফলে যে দামে উপরোক্ত দেশসমূহ থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে আসে বাজারমূল্য আমদানিমূল্য থেকে কমে যায়। এতে করে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কায় বহু আমদানিকারক বন্দর থেকে পেঁয়াজ খালাস করেনি। নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এখন তা নিলামে তুলছে। কাস্টম সূত্রে জানানো হয়েছে, এই ১১ শ’ টন পেঁয়াজ নিলামে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। তবে এর বাইরে আরও কিছু পেঁয়াজ রয়েছে। যদি সে সব আমদানিকারকরা তা খালাস না নেয় তখন ওইসব চালানও নিলামে তোলা হবে। এ বিষয়ে ভোগ্যপণ্যের একক বৃহত্তম বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে হামিদ উল্লাহ মার্কেট সমিতির সভাপতি মোঃ ইদ্রিস জনকণ্ঠকে জানান, এবার পেঁয়াজ আমদানিকারকরা বড় ধরনের লোকসান দিয়েছে। সঙ্কটের শুরুতে হাতে গোনা ৫ থেকে ৬টি আমদানিকারকদের বড় হাউসগুলো পেঁয়াজ আমদানি করে এনে তা টিসিবিকে দিয়েছে। এরা লাভবান হয়েছে। টিসিবিতে থাকা পেঁয়াজেও পচন ধরেছে। কিছু কিছু পেঁয়াজে চারা গজিয়েছে। এসব পেঁয়াজ খোলা বাজারে প্রতিনিয়ত আনা হচ্ছে। অপরদিকে, বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে যারা পেঁয়াজ এনেছে তারা ধরা খেয়েছে। শনিবার খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৪০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ২৫ থেকে ২৬ টাকা এবং হল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের পেঁয়াজ ১২ থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ পেঁয়াজের বস্তায় চারা গজাতে শুরু করেছে। আবার কিছু পেঁয়াজে পচন ধরেছে। ফলে বাজারে যে যা দর পাচ্ছে তাতে পেঁয়াজ ছেড়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ বিষয়টা হচ্ছে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে চারা গজানোসহ গলিত এবং অর্ধগলিত পেঁয়াজ রোদে শুকাতে দেয়ার চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে প্রায় ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। যার অর্ধেক দেশে উৎপাদিত হয়। চাহিদার অবশিষ্ট অংশ আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। এ চাহিদার অর্ধেক অংশের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। এ ধরনের প্রক্রিয়া চলতে থাকার প্রেক্ষাপটে ভারত সরকার হঠাৎ করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। চার মাস পর গত ২৮ ডিসেম্বর হঠাৎ করে রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় সে দেশের সরকার। তখন চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় থাকে কন্টেনার বোঝাই বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ। তড়িঘড়ি করে কোন কোন আমদানিকারক কিছু খালাস করলেও বড় একটি অংশ লোকসানের ভয়ে আমদানির পেঁয়াজ খালাস করেনি। সে পেঁয়াজ এখন বাধ্য হয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলামে তুলছে। বাজার সূত্রে ধারণা পাওয়া গেছে, বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি টাকার পেঁয়াজ থাকলেও সেই পেঁয়াজ সর্বোচ্চ এক কোটি টাকায় নিলামে বিক্রি হতে পারে। এতে বড় অঙ্কের লোকসানের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এদিকে, দেশীয় পেঁয়াজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা বার বার বলে আসছে, দেশে পেঁয়াজের মওসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে যাতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়। এ নিরুৎসাহিত করা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন ম্যাকানিজম রয়েছে, যা কার্যকর করলে এ ধরনের অবস্থা হয় না। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে দেশে উৎপাদনকারীরাও লোকসান দিচ্ছে, সঙ্গে বিদেশ থেকে যারা আমদানি করে এনেছিল তারাও মোটা অঙ্কের লোকসান গুনছে। দেশীয় উৎপাদনকারীদের দফায় দফায় আহ্বানের প্রেক্ষিতে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে বাড়তি যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল তাতে তেমন কোন সুফল আসেনি। তবে এতে করে দেশীয় পেঁয়াজের বাজারমূল্যের চাইতে ভারতীয় পেঁয়াজের বাজারমূল্য কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়তি থাকছে। কিন্তু যেসব অনুষ্ঠানে পেঁয়াজের চাহিদা বেশি সেখানে বরাবরই ভারতীয় পেঁয়াজের আধিক্য রয়েছে। মূলত এসব কারণে আমদানির ভারতীয় পেঁয়াজে বাজার ছেয়ে আছে।
×