ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদ নির্বাচন টার্গেট ॥ জোট পুনর্গঠন করতে চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ২২:৪২, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০

সংসদ নির্বাচন টার্গেট ॥ জোট পুনর্গঠন করতে চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে বিভিন্ন কৌশলে প্রস্তুতি জোরদার করতে চায় বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে রাজনৈতিক জোট পুনর্গঠন করতে চায় দলটি। ডান, বাম ও মধ্যপন্থী দল নিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক জোট করতে দলের কিছু সিনিয়র নেতা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। চেষ্টা সফল হলে আসছে নতুন বছরের যে কোন সুবিধাজনক সময়ে নতুন জোট গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে। সূত্র জানায়, জামায়াতকে কৌশলে দূরে রেখে এবার ডান, বাম ও মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল নিয়ে নতুন জোট গঠন করতে চায় বিএনপি। এতে কয়েকটি বাম দল, কয়েকটি ইসলামী দল, জাসদের একাংশ, এলডিপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে। এরশাদের জাতীয় পার্টিকেও সম্পৃক্ত করার জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধীনে নির্বাচন করে বিএনপি। তবে বিএনপির পুরনো ২০ দলীয় জোট সরাসরি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করে জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের কটি শরিক দল। এ জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন চরম সমালোচনার মুখে পড়েন। বিএনপি কৌশলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতকে শরিক রেখে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় এ নিয়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মধ্যেও কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকেই রাজনৈতিক জোট নিয়ে বিএনপি সঙ্কটে। যে স্বপ্ন নিয়ে তারা বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে তা কোন কাজেই আসেনি। বরং এ জোটের কারণে জামায়াতের নেতাকর্মীরা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছিল কার্যত নিষ্ক্রিয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে ভাগে পাওয়া ২৮১টি আসনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের কটি শরিক দলকে ছেড়ে দেয় ৪০টি আসন। এর মধ্যে ২৫টি আসন জামায়াতকে দিলেও তাতে কোন কাজ হয়নি। কারণ জামায়াত আগেও বুঝে যায়, তারা কোন আসনে জয় পাবে না। তাই নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। অপরদিকে জামায়াতকে দেয়া ২৫ সংসদীয় আসন এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীরা ওই নির্বাচনে ছিল নিষ্ক্রিয়। ২০ দলীয় জোটকে গুরুত্ব না দিয়ে বিএনপি গণফোরাম নেতা সূত্র মতে, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট করার কারণে পুরনো জোটের অন্যান্য রাজনৈতিক দলও বিএনপি থেকে কৌশলে দূরে সরে থাকে। নির্বাচনের পরও বিএনপি সেই দূরত্ব গোছাতে পারেনি। তাই দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও এখন আগের মতো বিএনপিকে সহযোগিতা করছে না। বরং এ জোটের কোন কোন শরিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করায় তা দলটির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীর মধ্যে কেউ কেউ মনে করছে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিয়ে জোট পুনর্গঠন করে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে পারলে বিএনপির ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য ভাল হতো। কিন্তু দলের ভেতরই আবার কোন কোন নেতাকর্মী মনে করছেন জামায়াত-বিএনপি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র। বিএনপির চরম দুর্দিনে জামায়াতের নেতাকর্মীরা দলটির পাশে ছিল। তাই জামায়াতকে বাদ দিয়ে কোন জোট নয়। তাদের মধ্যে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জাসদ সভাপতি আসম রব ও নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, কৃষক শ্রমিক দলের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধিকাংশ নেতা এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আর বামদলগুলো বিএনপির রাজনীতি মনের দিক থেকে পছন্দ করে না। তাই তারা বিএনপির কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করবেন না। বরং নিজেদের স্বার্থে তারা বিএনপিকে কাজে লাগাবে। এর ফলে বিএনপিও এদের নিয়ে জোট করে কোনদিন লাভবান হবে না। তবে বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী ও দলের ভেতর থেকে কোন কোন নেতা এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নতুন জোট করতে পারলে ভাল হবে বলে মনে করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নতুন আঙ্গিকে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। ডান, বাম ও ইসলামী দল নিয়ে জোট গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে সাইকে জানিয়ে দেয়া হবে। এদিকে ২০ দলীয় জোটের বাইরে থেকে যেসব রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনে আগ্রহী তারা বিএনপিকে জোটের শীর্ষ নেতৃত্বে রাখতে অনীহা প্রকাশ করছে। তাদের মতে, বিএনপি এখন চরম সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। এ অবস্থায় প্রগতিশীল দলকে নিয়ে বিএনপি জোট করতে চাইলে বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিএনপির একটি বড় অংশ এবং বেশিরভাগ জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী মনে করেন, একই আদর্শ এবং চেতনাকে ধারণ করে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল। তাই বিএনপির রাজনীতির মূল শক্তি ২০ দলীয় জোট। এ জোটকে আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় করা ছড়া সাফল্য আসবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াত থাকায় ২০ দলীয় জোটকে দেশ-বিদেশে অনেকেই পছন্দ করছে না। এর ফলে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সহযোগিতা থেকে বিএনপি বঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যেই ২০ দলীয় জোট থেকে কয়েকটি রাজনৈতিক দল চলে গেছে। ডামি নেতা দিয়ে ওই সব দলের অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। তবে এ জোটের সবচেয়ে পুরনো দল বিজেপি চলে যাওয়ার পর কোন ডামি নেতাকে দিয়ে এ দলটির অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। আর ২০ দলীয় জোটের আরেক প্রভাবশালী দল এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ এ জোটের আরও কটি দলকে নিয়ে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করেছেন। যদিও জাতীয় মুক্তি মঞ্চ বিএনপি জোট ত্যাগ করেনি তবুও মাঝেমধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে বেফাস কথা বলে রাজনৈতিকভাবে চরম ক্ষতি করছে। তবে অলি আহমেদকে নতুন জোটে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলে তিনি আবার বিএনপির আপনজনের মতো কাজ করবেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ২০ দলীয় জোট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি জেলে থাকায় বিএনপি কিংবা এ জোটের সিনিয়র নেতারা রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্বে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপির কিছু অতি উৎসাহী নেতার ইচ্ছায় রাজনীতিতে কার্যত নিষ্ক্রিয় বয়োবৃদ্ধ গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। আর এ ফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিটি শরিক দলের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয় ড. কামাল হোসেনকে। এ বিষয়টি বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো সহজভাবে নিতে পারেনি। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই শুরু হয় সঙ্কট। যা পরবর্তীতে আস্তে আস্তে আরও ঘনীভূত হয়। অভিজ্ঞ মহলের মতে ড. কামাল হোসেনকে নিয়েই বিএনপি জোটে এখন সমস্যার মূল কারণ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোটকে উপেক্ষা করে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর মহাধুমধামে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। এ জোট গঠনের পর গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপকালে ২০ দলীয় জোটের কোন শরিক দলের প্রতিনিধি নেয়নি বিএনপি। এ কারণে তখন থেকেই ২০ দলের শরিকরা বেঁকে বসে। আর নির্বাচনে ভরাডুবির পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এখন ২০ দলীয় জোট কিংবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কোন জোটের পক্ষ থেকেই কোন ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছে না বিএনপি। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে ২০০০ সালে জামায়াত, বিজেপি ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে ৪ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। জোটগতভাবে নির্বাচন করে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে বিএনপি। তবে ওই সরকারে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে ৪ দলীয় জোটের কলেবর বাড়িয়ে ১৮ দলীয় জোট করে বিএনপি। ১৮ দলীয় জোটে বিএনপি ছাড়া শরিক দলগুলোর মধ্যে ছিল জামায়াত, বিজেপি, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশ, এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, জাতীয় জাগপা, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এনডিপি), লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ ও ডেমোক্র্যাটিক লীগ। পরে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দলের একাংশ এই জোটে যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়। আর ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর গণফোরাম, জাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্যকে নিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌশলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট- এই দুই জোটকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচন করে বিএনপি। এ নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের শরিকদের ৪০টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ১৯টি আসন ছেড়ে দেয় বিএনপি। মূলত ওই আসন বণ্টন থেকেই বিএনপির প্রতি শরিক দলগুলোর ক্ষোভ শুরু হয়। বিশেষ করে ২০ দলীয় জোটের নিবন্ধনবিহীন রাজনৈতিক দল জামায়াতকে ২৫টি আসন দেয়া হলেও যেসব শরিক দলকে কোন আসন দেয়া হয়নি তারা চরম ক্ষুব্ধ হয়। এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের প্রতি তেমন আস্থা না থাকায় এলডিপির সভাপতি কর্নেল অলি আহমেদও কৌশলে এ দুই জোট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। তবে তিনি এখনও জোট ত্যাগের ঘোষণা দেননি। জোট ত্যাগ না করেই তিনি নতুন রাজনৈতিক মোর্চা ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ গঠন করেন। এই মঞ্চে কর্নেল অলির সঙ্গে যোগ দেন ২০ দলের শরিক মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন কল্যাণ পার্টি, ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাগপা ও ২০ দলীয় জোটের অপর শরিক দল খেলাফত মজলিশসহ কটি রাজনৈতিক দল। যদিও অলি আহমেদ বলেছেন, জাতীয় মুক্তি মঞ্চ কোন রাজনৈতিক জোট নয়। যারা দেশ এবং সমাজের পরিবর্তন চান তারা সবাই এই মঞ্চে থাকতে পারবেন। তার এই মঞ্চ গঠনের পর বেহাল দশায় পড়ে ২০ দলীয় জোট। অপর দিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেরও এখন নড়বড়ে অবস্থা। এ কারণে এখন আর এ দুই জোটের বৈঠকও হয় না। তাই এই ২ জোটের মূল চালিকা শক্তি বিএনপি এখন নতুন মেরুকরণে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করতে চায়।
×