ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

১৬ বছর পর রহস্য উদ্ঘাটন

হত্যার পর পারভেজের লাশ ধলেশ্বরীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

হত্যার পর পারভেজের লাশ ধলেশ্বরীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দীর্ঘ ষোলো বছর পর এসএসসি পরীক্ষার্থী সোহেল পারভেজ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। মোটরসাইকেল কেনার জন্য দেয়া টাকা হাতিয়ে নিতেই অপহরণের পর হত্যা করা হয় পারভেজকে। হত্যার পর লাশ বালুর বস্তার সঙ্গে বেঁধে ধলেশ্বরী নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আজও সেই পারভেজের লাশের হদিস মেলেনি। হয়তো মাছ বা জলজ কোন প্রাণীর খাবার হয়ে গেছে। মুক্তিপণের টাকা দেয়ার পরও ছেলেকে হত্যার ঘটনায় আজও ভুলতে পারেনি পারভেজের পরিবার। তার পরিবারে ষোলো বছর ধরেই চলছে শোকের মাতম। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পারভেজকে তার পিতা একটি মোটরসাইকেল কেনার জন্য টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা হাতিয়ে নিতে পারভেজকে কৌশলে ডেকে নিয়ে অপহরণ করে। তারপর হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়। তিনি বলছিলেন, ২০০৪ সালের ১৫ জুন মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানা এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। পারভেজের পিতা অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ হাবিবুর রহমান। পারভেজ এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। পাশাপাশি পারভেজ ২০০৩ সাল থেকেই সংসারের সচ্ছলতা আনতে পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবসা দেখাশোনা করত। ব্যবসার সুবিধার্থে পারভেজের পিতা ছেলেকে একটি মোটরসাইকেল কিনে দিতে চান। পারভেজ খুব খুশি। সে এমন খুশির কথা ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আলাপ করে। পরে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে পারভেজের আরেক বন্ধু ইউনুছ আলীও মোটরসাইকেল কেনার বিষয়টি জানতে পারে। ২০০৪ সালের ১৫ জুন ইউনুছ পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক পারভেজকে কম টাকায় মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার লোভ দেখায়। এতে রাজি হয় পারভেজ। সে মোতাবেক পারভেজকে কৌশলে ওইদিনই দুপুরে ডেকে নিয়ে যায়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সোহেল বাড়িতে আসে। সন্ধ্যার পর বাইসাইকেল নিয়ে মোটরসাইকেল দেখতে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যায়। রাত হয়ে যায় পারভেজ আর বাড়ি আসে না। এদিকে বাড়ির লোকজনও পারভেজ কার সঙ্গে গেছে, তা জানত না। কারণ বন্ধুরা রাস্তা থেকে পারভেজকে কৌশলে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর সাত লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে পারভেজের বাড়িতে দুইটি চিঠি পাঠায়। পরবর্তীতে পুলিশের সহযোগিতায় সোহেল পারভেজের সন্ধান চলতে থাকে। সন্ধান না পেয়ে ওই বছরের ২৯ জুন পারভেজের পিতা চারজনকে অভিযুক্ত করে সাটুরিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ (মানিকগঞ্জ জেলা), ও সিআইডি তদন্ত করে। তদন্ত শেষে চার জনকে অভিযুক্ত করে গত বছরের ১৪ নবেম্বর আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। বিচার চলাকালীন তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়ে গত ২৪ নবেম্বর আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয় পিবিআইকে। পিবিআই মামলার প্রধান আসামি মোঃ ইউনুছ আলীকে (৩৫) গ্রেফতারের চেষ্টা করতে থাকে। ততদিনে এই আসামি পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, নিজস্ব আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আত্মগোপনে চলে যায়। এদিকে ইউনুছ অন্য এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে চলে যায়। দীর্ঘদিন এ তথ্য গোপন ছিল। পরে সে জামিনে ছাড়া পায়। ছাড়া পেয়ে সে সাধন সূত্রধর নামের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সাধন সূত্রধরকে পারভেজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। দেড় লাখ টাকা দিলে পারভেজকে পাওয়া যাবে বলে ইউনুছ সাধন সূত্রধরকে জানায়। সাধনকে পারভেজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে ইউনুছ। সাধন সে মোতাবেক ফোন করে পারভেজের পরিবারকে বিষয়টি জানায়। এই কর্মকর্তা বলছেন, বছর দেড়েক আগে সাটুরিয়ার বাসিন্দা সাধন সূত্রধর এমন কথা জানায় পারভেজের পরিবারকে। পারভেজের পরিবার ছেলের আশায় দেড় লাখ টাকা ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় নির্দিষ্ট একজনের কাছে দিয়ে যায়। এরপরও ছেলেকে পায় না। ইউনুছ সেই টাকা নিয়ে হোটেল ব্যবসা শুরু করে। ইউনুছ হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ইউনুছ জানায়, পারভেজকে হত্যা করে বালির বস্তার সঙ্গে লাশ বেঁধে ধলেশ্বরী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। সোহেল পারভেজকে আটকে রেখে টাকা আদায়ের সময় পর্যন্ত ঘটনাটি গোপন রাখা আর সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্যই পারভেজকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ বালির বস্তার সঙ্গে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। যাতে লাশ আর না ভেসে ওঠে। আজও লাশের কোন হদিস মেলেনি।
×