ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তবুও অবেহলা পুণ্যভূমির প্রতি

মেঘালয়ের পাদদেশে দুর্জয় ঘাঁটি, বীরের স্মৃতিধন্য ট্যাকেরঘাট সাব- সেক্টর

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

মেঘালয়ের পাদদেশে দুর্জয় ঘাঁটি, বীরের স্মৃতিধন্য ট্যাকেরঘাট সাব- সেক্টর

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় এখন কিছুটা গতি এসেছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এই গতি সমান নয়। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সচেতন প্রয়াস তেমন চোখে পড়ে না। একই ঘটনা ঘটেছে ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টরের বেলায়। ১৯৭১ সালে সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সাবসেক্টর গড়ে তোলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে মোট সেক্টর ছিল ১১টি। ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনে তখন সুনামগঞ্জ। এখন এটি জেলা বটে। তখন ছিল মহকুমা। যুদ্ধের সুবিধার্থে মহকুমাটিকে চার সাবসেক্টরে ভাগ করে নেয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে ছিল বালাট সাবসেক্টর, সেলা সাবসেক্টর, ভোলাগঞ্জ সাবসেক্টর ও ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টর। ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টরটি মেঘালয়ের পাদদেশে হাওড় বেষ্টিত অঞ্চল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। জেলা শহর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সাবসেক্টরটিতে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আশপাশের এলাকায় অপারেশন চালানোর আগে-পরে এখানেই অবস্থান করতেন তাঁরা। ফলে বহু অমূল্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টর। সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা এখান থেকে নৌকোয় হাওড় পাড়ি দিতেন। স্থলভাগে অবস্থান নেয়া পাক হানাদার বাহিনীকে এক মুহূর্ত স্বস্তিতে থাকতে দিতেন না। আক্রমণের পর আক্রমণ সাজাতেন। তার পর ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে, রক্তাক্ত দেহে ফিরে আসতেন ট্যাকেরঘাটে। প্রাণ বাঁচাতে এখানে আশ্রয় নিতেন। হাওড় অঞ্চলের সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম হাজী মোঃ রৌজ আলী। ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টর থেকেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন তিনি। একটি গেরিলা আক্রমণের কথা তো বই-পুস্তকে ঘুরেফিরেই এসেছে। সেখান থেকে জানা যায়, যুদ্ধ চলাকালীন হাওড়ে পাকিস্তানীদের তিন তিনটি কার্গো এসে নোঙর করেছিল। চারপাশে কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। রৌজ আলীসহ পাঁচ বীর মুক্তিযোদ্ধা কার্গোগুলো টার্গেট করলেন। প্রস্তুতি নিলেন আক্রমণের। কঠিন চ্যালেঞ্জ। প্রাণ নিয়ে ফেরা যাবে কিনা, ঘোর সন্দেহ। তার পরও পিছপা হলেন না। দেশপ্রেমের বোধ আর তারুণ্যের শক্তি-সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা। এক্সপ্লোসিভ মেরে, অনেকটা সিনেমার মতো, কার্গোগুলো ডুবিয়ে দিলেন। কিন্তু সফল অপারেশনের আনন্দ উদ্যাপন করতে পারলেন না। এক্সপ্লোসিভের আগুনে দগ্ধ হয়ে শহীদ হলেন রৌজ আলীর বীর সহযোদ্ধা প্রফুল্ল চন্দ্র তালুকদার। চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হলো মুজাহিদ উদ্দীনের। রৌজ আলী নিজে কার্গোর নিচে চাপা পড়লেন। অজ্ঞান অবস্থায় বেশ কিছু সময় পর উদ্ধার করা হলো তাঁকে। আবারও ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টর থেকে অস্ত্র হাতে ছুটতে শুরু করলেন তিনি। এমন আরও অনেক বীর যোদ্ধার স্মৃতি নীরবে ধারণ করে আছে হাওড়ঘেঁষা ছোট্ট এলাকাটি। একাত্তরে যেমন বীর মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাকেরঘাটে এসে শান্তিতে ঘুমিয়েছেন, তেমনি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন বীর শহীদরা। বহু আগে নির্মিত একটি সমাধিসৌধ রয়েছে সেখানে। ভারতের পাহাড়ঘেঁষা সমাধিসৌধে ঘুমিয়ে আছেন শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীরবিক্রম। সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মহকুমার সাচনা নদীবন্দর পাক হানাদার মুক্ত করতে ৩৬ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটি এ্যাডভান্স পার্টি গঠন করা হয়। এ পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন টগবগে যুবক সিরাজুল ইসলাম। কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা আগেই তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছিল। ফলে কঠিন হয়ে পড়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। সিরাজুল ইসলাম সহযোদ্ধাদের পেছনে রেখে গ্রেনেড নিয়ে একাই ক্রলিং করে শত্রুর বাঙ্কারের দিকে এগিয়ে যান। গ্রেনেডও চার্জ করেন। তাঁর সফল গ্রেনেড আক্রমণে শত্রুর দুটি বাংকার ধ্বংস হয়। কিন্তু তৃতীয় বাঙ্কারে গ্রেনেড চার্জ করার সময় একটি গুলি শরীরে বিদ্ধ হয় তাঁর। পরে চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হলেও পথিমধ্যে শহীদ হন তিনি। বীরবিক্রমকে সমাহিত করা হয় ট্যাকেরঘাটে। স্বাধীন দেশে এসব ইতিহাস বহুকাল অজানা ছিল। চাপা পড়েছিল। এই প্রতিবেদক নিজেও এক সময় ইতিহাসটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। শহীদ সিরাজুল ইসলামের সমাধি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখেছেন তিনি। তবে এখন ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টর সম্পর্কে অনেকেই অবগত। আর এ অবগত করানোর সচেতন প্রয়াস দীর্ঘকাল পূর্বে যিনি গ্রহণ করেছিলেন তিনি হাজী মোঃ রৌজ আলী। হ্যাঁ, আগেই এ বীরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রণাঙ্গনে তিনি যেমন লড়াকু ছিলেন, এখন তেমনি সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায়। জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের আগে এ এলাকায়ই বসবাস করতেন তিনি। পরেও চাকরি এবং ব্যবসাসূত্রে বহু বছর সেখানে অবস্থান করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকলেও, সময় পেলেই ছুটে যান। রণাঙ্গনের স্মৃতি-আবেগ সেখানে টেনে নিয়ে যায় তাঁকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা অনেকটা একক প্রচেষ্টায় ট্যাকেরঘাট সাবসেক্টরের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। রণাঙ্গনে শহীদ ও সহযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা তুলে ধরছেন আগামী প্রজন্মের কাছে। বহু বছরের সচেতন প্রয়াসের ফল এই হয়েছে যে, এখন মুক্তিযুদ্ধের সাবসেক্টর হিসেবে এলাকাটি বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্প্রতি সাবসেক্টর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জঙ্গলে পরিণত হওয়া শহীদের সমাধি সংস্কার করা হয়েছে। সুন্দর করে লেখা হয়েছে এপিটাফ। ট্যাকেরঘাটে নতুন করে একটি স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অহর্নিশ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা রৌজ আলী বলেন, দেশ ও জাতির অনিবার্য প্রয়োজন মেটাতে তরুণ বয়সে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। একই ধারণা থেকে এই প্রবীণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার কাজ করছি। এটা আমার দায়। তিনি বলেন, শহীদ সিরাজভাই আমার সহযোদ্ধা। এখানে ঘুমিয়ে আছেন। আর কেউ না জানুক আমি তো সেই ১৯৭১ সাল থেকেই জানি। তাই এই শহীদের নামে শহীদ সিরাজ সংসদ গঠন করে কাজ করছি আমি। যতভাবে সম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি সেই আত্মদানের ইতিহাস। আরেক সহযোদ্ধা তাহিরপুরের প্রথম শহীদ আবুল কাশেম। তাঁর পরিবারকেও সম্প্রতি খুঁজে বের করেছি। শেষদিন পর্যন্ত শহীদ সহযোদ্ধাদের কথা বলে যেতে চান বলে জানান তিনি। তবে এত কিছুর পরও পুরোপুরি সফল হননি রৌজ আলী। এলাকা ঘুরে মনে হয়েছে, স্থানীয় অনেকের মধ্যেই সাবসেক্টর নিয়ে উদাসীনতা আছে। প্রশাসনও বিচ্ছিন্ন এই এলাকা নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়। একই কারণে এমনকি বুধবার বিজয় দিবসে ট্যাকেরঘাটে একবারের জন্য ঢুঁ মারেননি স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক বা থানা নির্বাহী কর্মকর্তা। অনুপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যানও। কীভাবে দেখেন? জানতে চাইলে রৌজ আলী বলেন, একাত্তরে আমাদের হাতে ছিল সব। নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন তো আমাদের হাতে কিছু নেই। খুব বেশি আশাও করি না। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন কখনও এগিয়ে আসে। কখনও আসে না। তাতে কী? নিজের মতো কাজ করে যাই। যাব।
×