বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অহেতুক বিতর্ক

দেশে এখন তুমুল বিতর্ক চলছে নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে। বিতর্কের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ-মিছিলে কেঁপে উঠছে রাজপথ। পক্ষে-বিপক্ষে রীতিমতো যুদ্ধংদেহী অবস্থা। ইতোমধ্যে কৃষ্টিয়ার পাঁচমাথার মোড়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গাও হয়েছে, যাতে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। গ্রেফতারের খবরও আছে। ইন্ধনদাতা হিসেবে কয়েকজন হেফাজত নেতার নামও এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কেন এই অহেতুক বিতর্ক? কিইবা এর মূল ভিত্তি? শিল্পকলা, ধর্ম, রাজনীতি? নাকি এর সবই। কতটুকু আবেগ কাজ করছে, আর কতটুকুই বা যুক্তিবোধে চালিত হচ্ছে এ বিতর্ক? ঘটনা পরিক্রমা সচেতনভাবে অনুসরণ করে থাকলে আপনার মনে হতে পারে, উল্লিখিত সবগুলো উপাদানের মিশেলে একটি জগাখিঁচুড়ি অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ মহাবিশ্বে বিধাতার এক অপূর্ব লীলা হচ্ছে সৃষ্টির বৈচিত্র্য। আল্লাহ তায়ালা শত সহস্র রকমের প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছেন। বিশ্ব-ভ্রহ্মাণ্ডকে সুশোভিত করেছেন সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী- এবম্বিধ বহুতর অপূর্ব সৃষ্টি দিয়ে। উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতে বিদ্যমান হাজারো প্রজাতির মধ্যে আর একটু ডিটেইলসে গেলে আপনি দেখতে পাবেন আরও অসংখ্য ভাগ-উপভাগ। বিধাতার বিচিত্র রকমের এই শত সহস্র সৃষ্টির মধ্যে আপনি অনেক অমিল যেমন খুঁজে পাবেন, মিলও পাবেন এন্তার। তবে, এত সব বৈচিত্র্যের মধ্যে যে বিষয়টি আপনাকে বিমোহিত করবে সেটা হলো, এরা সবাই মিলে এ মহাবিশ্বে তৈরি করেছে এক অপূর্ব ঐক্যতান, সবে মিলে আবদ্ধ হয়েছে ঐক্যের এক বাজডোরে। কোথাও কোন বিরোধ নেই, সবাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যার যার কাজ করে যাচ্ছে। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘তুমি পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোন বিরোধ/অমিল খুঁজে পাবে না।’ (আল-কুরআন ৬৭:৩) এবার আদম সন্তানদের কথা ভাবুন। এ পৃথিবীর ঊষর-উর্বর, গরম-ঠাণ্ডা সর্বত্র আল্লাহ আদম সন্তানদের ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের বিভক্ত করেছেন বিভিন্ন জাতি, বর্ণ, গোত্রে। অসংখ্য ভাষা-উপভাষায় তারা কথা বলে। এলাকা ও ধর্মভেদে তাদের মধ্যে বিচিত্র রকমের কৃষ্টি-কালচার গড়ে উঠেছে। তবে সাদা-কালো-বাদামি নির্বিশেষে সকলের ভেতরটা একই রকম, সকলের রক্তের বর্ণই লাল। সকলের মধ্যেই একই রকম আনন্দ-বেদনার অনুভূতি কাজ করে। বিশ্বমানবতার কল্যাণে কেউ যখন কোন যুগান্তকারী আবিষ্কার করে, অন্যরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক তাঁর কৃতিত্বে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অভিনন্দন জানায়। আর কোন এলাকায় যখন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভূমিকম্প কিংবা করোনা মহামারীর মতো কোন বড় দুর্যোগ দেখা দেয়, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সব দেশই তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এই যে সার্বজনীন সহানুভূতি-সহমর্মিতা, এটা কি এ সাক্ষ্যই দেয় না যে, শত বিরোধ আর বৈপরীত্যের মধ্যেও আমরা সবাই মিলে একটি অভিন্ন জাতি, এক আদমেরই সন্তান। মোটা দাগে, আপনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিন্তা-দর্শন ও জীবনাচারে অনেক মিল ও অমিল খুঁজে পাবেন। আপনি এমন কিছু বিষয় পাবেন, যেখানে ধর্ম-বর্ণ, গোত্র-জাতি নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষ অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। যেমন ধরুন- সত্য কথা বলা, সদাচরণ করা, বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করা, অন্যায়ভাবে পরাস্বপহরণ না করা ইত্যাদি। অন্যদিকে, আপনি দেখে থাকবেন, সময়ের পরিক্রমায় কিছু বিষয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক ফারাক তৈরি হয়েছে। প্রাচ্যে এখনও পারিবারিক বন্ধন অনেক সুদৃঢ়। বিয়ে বহির্ভূত যুগল জীবন এখনও এখানে সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি। অন্যদিকে, পাশ্চাত্যে লিভ-টুগেদার একটি স্বীকৃত সামাজিক ব্যবস্থা। বিয়ে বহির্ভূত সন্তান জন্মদান তাদের কাছে কোন বিষয়ই নয়। এমনকি, সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ের মতো বিষয়ও পাশ্চাত্যের অনেক দেশে আইনি স্বীকৃতি লাভ করেছে। অথচ, প্রাচ্যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কমবেশি সবখানেই এটি একটি অনাচার হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে, ধর্মের একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে। আধুনিক যুগে পাশ্চাত্যে খ্রিষ্টীয় জনজীবনে চার্চের প্রভাব অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। অন্যদিকে, প্রাচ্যে ইসলাম, হিন্দু বা বৌদ্ধ- যে কোন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে প্রাত্যহিক জীবনাচারে এখনও ধর্মের প্রভাব অনেক শক্তিশালী। সন্দেহ নেই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা পাশ্চাত্যের কাছে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। তবে তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, তাদেরকে সব বিষয়েই আমাদের মডেল মানতে হবে। প্রাচ্য সমাজে প্রধান তিনটি ধর্মের মধ্যে আপনি মৌলিক আকিদা-বিশ্বাসে একটি প্রধান পার্থক্য দেখতে পাবেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অনেকে দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করে। এসব দেব-দেবীর মূর্তি বানিয়ে তাদের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন তাদের নিয়মিত ধর্মাচারের অংশবিশেষ। অন্যদিকে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি তৈরি করে তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। কিন্তু ইসলাম অত্যন্ত কঠোরভাবে এক আল্লাহতে বিশ্বাস করে। তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাউকে অংশীদার করাকে আমার্জনীয় পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। মহানবী (সা.) আরব থেকে মূর্তি পূজাকে সমূলে উৎপাটন করেন। তাঁর অনুসারীরা এ বিষয়ে সদা সোচ্চার ছিলেন এবং আছেন। ছোট-বড় যত ত্রুটি-বিচ্যুতিই এসে থাকুক না কেন, গত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলিম সমাজের কোথাও কি মূর্তি পূজা জায়গা করে নিতে পেরেছে? প্রশ্ন হচ্ছে, মূর্তি আর ভাস্কর্য কি এক? কোথাও কি মূর্তির ন্যায় ভাস্কর্যের পূজা হচ্ছে? তাহলে এটা নিয়ে এত শোরগোল হচ্ছে কেন? ভাস্কর্য আসলে কি? ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে কি উদ্দেশ্যই বা কাজ করে থাকে? বিশ্ব সভ্যতার ক্রমবিকাশের দিকে তাকান। এখানে বিজ্ঞান, ধর্ম ও শিল্পকলা- প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিজ্ঞান যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাসমূহের সমাধানে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে, ধর্ম তার নৈতিক সত্তাকে বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষায় রয়েছে সদা ব্যাপৃত। আর, শিল্পকলা? আনন্দ-পিপাসু মানুষের চিত্তবিনোদনের অফুরন্ত উৎস হিসেবে কাজ করে গেছে। শুধুই কি তাই? ধর্মের যেমন রয়েছে অতুলনীয় উজ্জীবনী শক্তি, শিল্পকলাও বিনোদনের পাশাপাশি জনমানস গঠনে রাখতে পারে অনন্যসাধারণ ভূমিকা। এখানে ভাস্কর্যের অবস্থান কোথায়? একটি চিত্রকর্ম দ্বিমাত্রিকভাবে অনেক কথাই বলতে পারে, তবে এটাকে বড় জোর কোথাও ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু, ভাস্কর্য নামের ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম যদি দৃষ্টিনন্দন হয়, পাবলিক প্লেসে স্থাপন করেন, এটি অগণিত মানুষের জন্য দর্শনীয় স্থানে পরিণত হতে পারে। মানুষ এটা দেখবে, এর নির্মাণশৈলী আর শিল্পগুণে বিমোহিত হবে, আর এটি যে বার্তা দিতে চায় তা সঙ্গে করে নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে। কাজেই, ক্ষেত্রভেদে একটি ভাস্কর্য হতে পারে একটি চলমান ইতিহাস, একটি জাতির অহংকার, গৌরব ও বীরত্বের জয়গাঁথা। একটি সমাজের কোন স্মরণীয় মুহূর্তের প্রতিবিম্ব, একটি দেশের কোন মহান নেতার স্মৃতিফলক কিংবা কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দেব-দেবীর প্রতিমূর্তি। ব্যাপার যাই হোক, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, একটি ভাস্কর্য তার নান্দনিকতা ও দর্শনীয়তা গুণে জনসধারণ্যে বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেয়ার শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে অবশ্যই। এবার দেখা যাক, মুসলিম বিশ্বে ভাস্কর্যের ব্যাপৃতি কেমন? পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই প্রয়াত জাতীয় নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে। এদের মধ্যে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, পাকিস্তানের কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মিসরের জামাল আবদুল নাসের, ইরানের ইমাম খোমেনি ও ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইরাকে মার্কিন অভিযানের পর সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্যগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা ইকবাল, শেখ সাদী, ফেরদৌসী, রুমী প্রমুখ। আরব উপদ্বীপেও কিছু ভাস্কর্য আছে বলে সংবাদ মাধ্যমের খবরে এসেছে, যদিও কোন ব্যক্তির ভাস্কর্য আছে কিনা তা সুস্পষ্ট নয়। তাহলে, সমস্যাটা কোথায়? এদেশের আলেম-উলামারা ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছেন কেন? তাদের কাছ থেকেই শোনা যাক। তাঁরা বলছেন, কোন মুসলিম দেশে ভাস্কর্য থাকার মানে এই নয় যে, ইসলাম এটাকে অনুমোদন করে। ইসলামের গাইডলাইন আসে কুরআন ও হাদিস থেকে। একাধিক নির্ভরযোগ্য হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়, ইসলাম কঠোরভাবে মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর ত্রিমাত্রিক ইমেজ তৈরিতে নিষেধ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, হাদিস থেকে এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, অতীতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে শিরকের সূত্রপাত ঘটেছে শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও অনুপ্রেরণা লাভের উদ্দেশ্যে প্রয়াত বিশিষ্টজনদের ছবি টাঙানো বা ইমেজ তৈরির মধ্য দিয়েই। শয়তান এভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে শিরকের দরজা উন্মুক্ত করে। তাঁরা আরও দাবি করেন, রাসূল (সা.)-এর সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-উলামাদের এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। এ বিরোধিতার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তরসূরি হিসেবে তাঁরা তাঁদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র। যদিও বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলমান, তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি আলেমদের বক্তব্যই সঠিক। বিশেষ করে, ধর্মীয় বিষয়ে তাদের বক্তব্য অগ্রাধিকার পাবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি তাদের দায়িত্ব পালনে সঠিক পন্থা অনুসরণ করছেন? তারা তাদের বক্তব্য সাধারণ্যে ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুন্দরভাবে বিজ্ঞতার সঙ্গে তুলে ধরুন না কেন? একজন মানুষের প্রতি এটাই আল্লাহর হেদায়েত নয় কি? শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তারা তাদের অবশ্যই মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা চালাতে পারেন, কিন্তু এমনভাবে কথা বলা কি সঠিক হবে, যাতে জনসাধারণ্যে মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে? কেউ যদি বলে বসেন, ‘ওটা ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেব’, তাতে আদৌ কাজের কাজ কিছু হবে কি? মনে রাখা চাই, দেশ একজন মুসলিম শাসক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এ দেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। আজকের এই যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সেটা তাঁরই হাতে গড়া। আমাদের জানা মতে, তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, নিয়মিত নামাজ-কালাম করেন। যেসব তরুণ-যুবারা আপনাদের কথা শুনতে চাচ্ছেন না বলে ভাবছেন, তাদেরও বেশির ভাগ মুসলিম পিতা-মাতার ঔরসে জন্ম নিয়েছেন। আপনারা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যভাবে আপনাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারেন, কারও দ্বিমত পোষণের কথা নয়? তা না করে যদি খালি মাঠ গরম করেন, করতেই পারেন। আখেরে লাভের গুড় পিঁপড়েয় খাবে! এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইসলাম নিজেকে একটি বিশ্বজনীন ধর্ম ও আদর্শ হিসেবে দাবি করে। এর মানে এটাই দাঁড়ায় যে, এতে বিশ্বের শত-সহস্র জাতি-গোষ্ঠীর স্থানীয় কৃষ্টি-কালচারকে একোমোডেট করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ইসলামের আবির্ভাবের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটি আরব উপদ্বীপের বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকার মানুষ নিজস্ব ধর্ম ও কৃষ্টি বিসর্জন দিয়ে ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে অবলীলায় আলিঙ্গন করে। লক্ষ্য করে থাকবেন, এক্ষেত্রে ইসলাম নিজস্ব মৌলনীতি ও আদর্শকে অক্ষুণ্ন রেখে স্থানীয় কৃষ্টি-কালচারকে ইসলামাইজ করেছে। ইসলামের দুটি মৌল স্তম্ভ নামাজ ও রোজার কথা চিন্তা করুন। নামাজ ও রোজা এ দুটি শব্দের কোনটিই কুরআন ও সুন্নাহয় ব্যবহৃত পরিভাষা নয়। এগুলো হয়ত পারস্যের অগ্নি উপাসকদের কোন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকত। কিন্তু ইসলাম এর ক্রম-প্রসারের সময় স্থানীয় জনতার সুবিধার্থে কুরআন ও সুন্নাহয় নির্দেশিত সালাত ও সাওম নির্দেশ করতে এসব আঞ্চলিক পরিভাষাকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছে। এতে কিন্তু আসল বিষয়ে কোন হেরফের হয়নি। আজ আপনি নামাজ ও রোজা বলতে কুরআন ও হাদিসে সালাত ও সাওম দ্বারা যে সব আচার-অনুষ্ঠানকে নির্দেশ করা হয়েছে সেগুলোকেই বুঝছেন, কেবল নামটাই ভিন্ন। সুতরাং, ভাস্কর্যকে যদি আপনি অনৈসলামিক বিবেচনা করেন, তাহলে বিকল্প কিছু প্রস্তাব করুন, যা একদিকে শিল্পগুণসমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর একটি মেমোরেন্ডাম হবে, আবার ইসলামের গাইডলাইনের গণ্ডির ভেতরেই অবস্থান করবে। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান এ বিষয়ে ইতিবাচক প্রস্তাব রেখেছেন, যা সরকারের উদারতার পরিচায়ক। শুরুটা যেভাবে করেছিলাম, এ মহাবিশ্বের পরতে পরতে বৈচিত্র্যের যে বিপুল সমাহার, তা যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তিকেই অভিভূত করে। কিন্তু, এই বিপুল বৈচিত্র্যের মধ্যেই এক অতুলনীয় সমন্বয় ও হারমোনি পুরো বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছে। মনুষ্য সমাজেও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, দলে দলে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে- অনেক বিষয়ে মতানৈক্য থাকে এবং এটাই স্বাভাবিক। এটা মানব সমাজের সৃজনশীলতার বহির্প্রকাশ। এসব মতপার্থক্যকে সমন্বিত করে একটি সুন্দর সমাধান ও সিদ্ধান্তে পৌঁছাই আমাদের সামষ্টিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। মনে রাখা দরকার, বিতর্কিত বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, বিশেষ করে, যেহেতু এখানে বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িয়ে আছে। তিনি বাংলাদেশের ঐক্যের সূত্র। তিনি গত হয়ে গেছেন। আল্লাহ যেটুকু তৌফিক দিয়েছেন, এ দেশ, এ জাতির জন্য তিনি তা করে গেছেন। এখন আমাদের স্বার্থেই তাঁকে সব বিতর্কের উর্ধে রাখা চাই। কারও কোন কথায়, কোন কাজে যেন তাঁর অশ্রদ্ধা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরী। আলেম উলামাদের কাছ থেকে যে সব আপত্তি আসছে, নীতিনির্ধারকদের উচিত অহেতুক আবেগতাড়িত না হয়ে এসবের একাডেমিক দিকটি পর্যালোচনা করে দেখা। খেয়াল রাখা দরকার, অযাচিত উত্তেজনা সৃষ্টি কেবল সমাজে ধূম্রজাল তৈরি করবে, যা সাধারণ্যে পুরো বিষয়টি নিয়ে একটি বিরূপ ধারণার জন্ম দেবে। কাজেই সবাইকে আস্থায় নিয়ে ধীরে সুস্থে এগুনোই বিজ্ঞজনোচিত নয় কি? বঙ্গবন্ধু এখন আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু এদেশে শান্তি, সুস্থিতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে নিশ্চয়ই তাঁর পরলোকগত আত্মা পরম প্রশান্তি লাভ করবে। লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়