ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্রি হচ্ছে গর্ভে থাকা শিশু, নিঃসন্তান দম্পতিরাই গ্রাহক

প্রকাশিত: ২১:২৬, ৩০ নভেম্বর ২০২০

বিক্রি হচ্ছে গর্ভে থাকা শিশু, নিঃসন্তান দম্পতিরাই গ্রাহক

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ রাজশাহী নগরে নবজাতক থেকে শুরু করে গর্ভের সন্তান বিক্রির চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। কখনও শিশু চুরি করে আবার কখনও অবৈধ সন্তান ধারণের পর তা বিক্রি করা হচ্ছে। নিঃসন্তান দম্পতিরাই এসব শিশুর গ্রাহক। আইনের কোন তোয়াক্কা না করে গোপনে কেনাবেচা হচ্ছে শিশু। এ চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর বিষয়টি নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী রেলস্টেশনের গণশৌচাগারের পেছনের ফাঁকা এলাকা ঘিরেই উঠতি কিশোরীদের আনাগোনা থাকে। মূলত এরা ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী। সেখানেই কিশোরীদের কথিত সংসার। সেখানে এক কিশোরীর গর্ভে এখন বেড়ে উঠছে শিশু। তবে ওই শিশুর বাবার নাম জানে না সে। ভূমিষ্ঠ না হতেই পেটের শিশুকে বিক্রি করে দিয়েছে ওই কিশোরী। নগরীর এক নিঃসন্তান দম্পতি ১০ হাজার টাকায় কিশোরীর পেটে থাকা সন্তানকে কিনে নিয়েছেন। প্রতিদিন সন্তানসম্ভবা ওই কিশোরীকে ওই দম্পতির পক্ষ থেকে তিন বেলা খাবার পৌঁছে দেয়া হয় স্টেশন এলাকায়। সন্তান ভূমিষ্ঠের পর কিশোরী পাবে নগদ ১০ হাজার টাকা। এখন সে ওই অপেক্ষায় নিশ্চিন্তেই আছে। ১৮ বছর না হওয়া আরেক কিশোরীর পেশাও একই। গত রমজান মাসে তার সন্তানকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে সে। কামাল নামের এক মোটর গ্যারেজ (ভদ্রা এলাকার) কর্মী শিশুটিকে কিনে নেয়। এভাবেই রাজশাহীতে চলছে গর্ভের সন্তান বেচাকেনা। তবে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে লিঙ্গ ভেদে। মেয়ে হলে কম আর ছেলে হলে বেশি দাম। নগরীর ভদ্রা বস্তি এলাকার সীমা নামের এক নারী এসব শিশু বেচাকেনার সমন্বয় করে। সে তার নিজের সন্তানকেও বিক্রি করেছে। সর্বশেষ শনিবার পুলিশ তাকেসহ তিন নারীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে একজন শিশু ক্রেতা রয়েছে। জানা গেছে, গত শুক্রবার সীমার মাধ্যমে ভদ্রা এলাকায় শ্যামলী নামের আরেক নারী তার ৫ মাসের এক শিশুকে বিক্রি করে মাত্র ১২ হাজার টাকায়। ওই শিশুকে কিনে নেয় ঢাকার এক গার্মেন্টস কর্মী। বিক্রির পর থেকে শিশুর সেই মা শ্যামলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শিশুকে কিনে বিপদে পড়েছে ওই নিঃসন্তান দম্পতি। ক্রয় করা শিশু আদৌ শ্যামলীর, নাকি চুরি করা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এদিকে রাজশাহীতে যারা সন্তান ধারণ করে গর্ভে বা জন্ম দিয়ে বিক্রি করছে তারা নগরে ভ্রাম্যমাণ পতিতা হিসেবে কাজ করে। রাজশাহীতে এই সিন্ডিকেটে কয়েকজন রয়েছে। যাদের মধ্যে কয়েকজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর বিক্রি হয়ে যাওয়া শিশুদের শেষ পরিণতি কী হচ্ছে তা কেউই খবর রাখছে না। কোন হিসেবও কারও কাছে নেই। রাজশাহী স্টেশন এলাকায় সন্তানসম্ভবা কিশোরী জানায়, তার বাড়ি বরিশাল। শিশুকালে তার এই শহরে পা পড়ে। নিজের বাবা-মা সম্পর্কে তার জানা নেই। তার মতো অনেক কিশোরী ও নারী রাজশাহী স্টেশনের পশ্চিমে অবস্থিত প্রাইমারী স্কুলের পেছনে কথিত সংসার পেতেছে। কে তার গর্ভের শিশুর বাবা তাও সে জানে না। এই সন্তানের দায়িত্ব সে নিতে পারবে না। তাই গর্ভে থাকা অবস্থায় সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছে। এদিকে, গত মে মাসে সন্তান বিক্রি করেছিল আরেক কিশোরী। সেই কিশোরী জানায়, তার স্বামী ছিল। তবে এখন সে একা। স্টেশন ঘিরে সেও সংসার পেতে বসেছে। খদ্দের প্রতি তার আয় ১০০ টাকা। সেইসঙ্গে কোন নিঃসন্তান দম্পতি যদি তাকে অনুরোধ করে তবে সে ওই দম্পতির জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে শিশু জোগাড় করে দেয়। এই কিশোরীর ভাষায়, কন্যাশিশু হলে রেট কম, আর ছেলে শিশুর রেট বেশি। আবার গায়ের রং ও স্বাস্থ্যভেদেও দাম কম-বেশি হয়। এদিকে সর্বশেষ জান্নাতি ওরফে সূর্য নামের এক গার্মেন্টস কর্মী গত শুক্রবার রাতে রাজশাহীর ভদ্রা রেল বস্তি থেকে সীমার মাধ্যমে শ্যামলীর কোলের ৫ মাসের শিশুকে কেনার পর আইনের সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছে। বিষয়টি জানাজানির পর শনিবার দুপুরে তাকেসহ তার খালা রোকেয়া ও মধ্যস্থতাকারী কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় রেল পুলিশ। রাজশাহী রেলওয়ে থানা পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দিয়ে চীফ মেট্রোপলিটন আদালতে হাজির করে। আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠায়। আর শিশুকে ছোটমনি নিবাসে প্রেরণ করে। জান্নাতি ও তার স্বামী জানান, ১২ বছরের সংসারে তাদের কোন সন্তান নেই। তাই তারা ঠিক করেন অনাথ কোন শিশুকে দত্তক নেয়ার। গত ১০ থেকে ১২ দিন আগে জান্নাতি রাজশাহীতে ছোটবনগ্রাম এলাকায় তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসে। এর মাঝে শুক্রবার রাতে ভদ্রা রেলবস্তিতে বসবাসকারী তার খালা রোকেয়া তাকে জানান, একটা শিশু পাওয়া গেছে। জান্নাতি দ্রুত ভদ্রায় পৌঁছায় এবং শিশুকে ১২ হাজার টাকায় কিনে নেয়। রাজশাহী রেলওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ শাহ কামাল জানান, গ্রেফতারকৃতরা যে শিশুকে কিনেছে তা আসলে কার কাছ থেকে তা তারা বলতে পারেনি। অর্থাৎ শিশুর প্রকৃত মা কে তারা জানাতে পারেনি। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে শিশু অপহরণ মামলা দেয়া হয়েছে।
×