ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সালাম মূশের্দী, সাবেক তারকা ফুটবলার

রাজার এমন বিদায়ে হতবাক ফুটবলপ্রেমীরা

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ২৭ নভেম্বর ২০২০

রাজার এমন বিদায়ে হতবাক ফুটবলপ্রেমীরা

তিনি ম্যারাডোনা নন, তিনি একজন রাজা। যিনি কোটি কোটি মানুষের মনে গেঁথে আছেন আবেগ আর ভালবাসা নিয়ে। ফুটবলের এমন এক রাজা মাত্র ৬০ বছরেই বিদায় নিবেন- তা কি কেউ ভেবেছে? তার মৃত্যুর খবরটি যেমন আমার কাছে বড় দাগ কেটেছে, তেমনি বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীকে করেছে হতভম্ব। আমি মনে করি ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো কেউ কখনও আসেননি। কখনও আসবেন কিনা আশা করাটাও হয়তো ভুল। যুগে যুগে অসংখ্য ফুটবলার এসেছেন যাদের প্রতিভার ঝলক ছিল। তবে ম্যারাডোনার মতো ঝলক কেউ দেখায়নি। প্রকৃতি তাকে দেয়ার মতো অনেককিছুই অকৃপণ হাতে দিয়েছে। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যুগে যুগে তার ক্রীড়ানৈপুণ্য ভবিষ্যত ফুটবল খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। ম্যারাডোনার মৃত্যু মেনে নিতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। অনন্য জাদুকর ম্যারাডোনা বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। এই চিরবিদাইয়ে একটা শূন্যতা রেখে গেছেন যেটা কখনও পূরণ করা যাবে না। ম্যারাডোনা নামক মহানায়কের খেলা সরাসরি টেলিভিশনে দেখার সৌভাগ্য এদেশের মানুষের হয়েছে। ফুটবলের প্রতি গভীর ভালবাসাটা সেখান থেকেই আসার কথা। তবে সেই ফুটবলের প্রেমের বীজ তো আর এমনিতেই রোপণ হয়নি। ম্যারাডোনার অন্য গ্রহের শৈল্পিক ফুটবল শৈলী তো ছিলই। এরসঙ্গে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে আরও কিছু বিষয়। ম্যারাডোনা ফুটবল অঙ্গনে নিজেকে বৈশ্বিক তারকা হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন মূলত ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। জাদুকরী ফুটবলের মায়ায় সেবার তিনি ফুটবলবিশ্বকে করেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধ। ফুটবলের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের বসবাস সেই অনাদিকাল থেকে। কিন্তু ছিয়াশির বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার মনোমুগ্ধকর ফুটবলের অন্য একটা গুরুত্ব আছে এদেশের মানুষের কাছে। সেবারই প্রথম বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপ দেখে রঙিন টেলিভিশনে। একজন ফুটবলার কিভাবে একা দলকে বিশ্বকাপের মতো একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে টেনে নিতে পারেন, সেই উদাহরণ তো প্রথম ম্যারাডোনাকে দিয়েই দেখেছে ফুটবলবিশ্ব। বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে নিয়ে কত স্মৃতিই না ভেসে ওঠে মানুষের মনে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটি ধরুন। এ ম্যাচ নিয়ে আলোচনার শেষ কি কখন হয়েছে! ম্যারাডোনার জোড়া গোলে ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে একইসঙ্গে নায়ক এবং খলনায়ক ম্যারাডোনা। খলনায়ক ৫১ মিনিটে করা প্রথম গোলটির কারণে। যদিও তিনি খলনায়ক শুধু ইংলিশদের কাছে। গোলটি যে ম্যারাডোনা করেছিলেন হাত দিয়ে। হেডের জন্য লাফিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মাথা দিয়ে বলের নাগাল পাননি। রেফারিকে আড়াল করে নিজের বাঁ হাত দিয়ে বলটি ঠেলে দেন ইংল্যান্ডের গোলকিপার পিটার শিলটনের জালে। ম্যারাডোনার এই গোলটি কখনই মেনে নিতে পারেননি শিলটন বা ইংল্যান্ডের কেউ। তবে ম্যারাডোনা নিজে এই গোলের নাম দিয়েছিলেন ‘ঈশ্বরের হাতের গোল’! বিতর্কিত এই গোলটির কথা বাদ দিন। ৪ মিনিট পর ম্যারাডোনা ইংল্যান্ডের মাঝমাঠ আর রক্ষণের প্রায় সব খেলোয়াড়কে কাটিয়ে যে গোলটি করেছিলেন সেটিকে বিশ্বকাপের ইতিহাসেরই সেরা গোল হিসেবে এখনও চিহ্নিত। গোলটির পর ইংলিশ ধারাভাষ্য বেরি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে এটি জাদুকরী।’ জাদুকরী সেই ম্যারাডোনা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে ফাইনালে খেলেছেন অসাধারণ ফুটবল। আর সবশেষে বিশ্বকাপ জয়ের পর তঁর ট্রফি উঁচিয়ে ধরার দৃশ্যটিও ছিল মোহনীয়। যে দৃশ্য এখনও চোখে লেগে আছে বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমীদের। বাংলাদেশের মানুষ আজ যেমন ফুটবলের এই কিংবদন্তিকে হারিয়ে হতবাক, তেমনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও শোকাহত। আপনারা জানেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিতে এই মুজিববর্ষে ফুটবল নিয়ে আমাদের অনেক বড় বড় পরিকল্পনা ছিল। কথা হচ্ছিল ম্যারাডোনাকেও শুভেচ্ছাদূত হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে আসার। সেই পরিকল্পনা শুধু কল্পনাতেই রয়ে যাবে। আমি প্রত্যাশা করব ম্যারাডোনার অনুপ্রেরণা নিয়ে বিশ্বে ফুটবল টিকে থাকুক যুগে যুগে।
×