ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পণ্যের মোড়কে গণতন্ত্র

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ১৮ নভেম্বর ২০২০

পণ্যের মোড়কে গণতন্ত্র

উপনিবেশ-উত্তর দেশগুলোর নতুন শাসন ব্যবস্থার গালভরা নাম গণতন্ত্র হলেও এর আসল উদ্দেশ্য পুঁজির পুঞ্জীভবনের জগত নিরাপদ রাখা। বাংলাদেশের মতো প্রান্তের দেশগুলো মূলত সে লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়। পুঁজির কেন্দ্রীভবনের মূল নিয়ন্ত্রক বহুজাতিক কোম্পানি ও কর্পোরেশনগুলো। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী পাঁচটি কর্পোরেশনের সামগ্রিক বিক্রি পৃথিবীর এক শ’ বিরাশিটি দেশের জিডিপির চেয়ে বেশি। আর মাইক্রোসফট, কোকা-কোলা এবং আইবিএম কোম্পানির বার্ষিক বিক্রি তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সম্মিলিত জিডিপি ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং এদের ক্ষমতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। এদের কাছে অন্য সব কিছুর মতো গণতন্ত্রও একটি পণ্য। এ পণ্য বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী প্রান্তের দেশগুলোয়। বিশেষ করে যেসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে আছে মার্কিন কর্পোরেশনগুলো। মার্কিন গবেষক হাওয়ার্ড জিমের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের শতকরা ষাট ভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলো নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। গত শতকের আশির দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বাজার সম্প্রসারণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক পুঁজির চরিত্র বদলের সঙ্গে এরপর ধীরে ধীরে আমদানি হয় গণতন্ত্র। কেননা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে লুটপাট ও দখলদারিত্ব ভদ্রস্থ গ্রহণযোগ্যতা পায়। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও এ চিত্র দেখি। উনিশ শ’ একানব্বই সালে গ্যাট চুক্তি থেকে শুরু করে অন্য প্রায় সব চুক্তি সই হয়েছে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়। এ চুক্তির মাধ্যমে দেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ আন্তর্জাতিক বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষা, শিল্প ও কৃষিনীতির পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি এখন বিক্রয়যোগ্য একেকটি পণ্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান-সব মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও এগুলো চড়া দামে বিক্রি হয় বলে দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী এ থেকে প্রায় বঞ্চিত। দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা দু’হাজার আট-এ বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ গণতন্ত্রের নামে এখনও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় বাস করেন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র বা বহুদলীয় গণতন্ত্রের ঢোল পেটানো হয় এই জনগণের নামে। তাদের নামে নির্বাচন হয়। সংসদ বসে, উন্নয়নের নানা পরিসংখ্যানের প্রজেকশন হয়। অথচ প্রাকৃতিক যে সম্পদের মালিক জনগণ তা যখন বিভিন্ন চুক্তির নামে বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে চলে যায় কালা জনগণ তার কিছুই টের পায় না। জাতীয় সংসদ ঠুঁটো জগন্নাথ। আজ পর্যন্ত যত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার কোনটাই সংসদের মাধ্যমে হয়নি। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে এখন সংসদের কোন ভূমিকা নেই। এ দায়িত্ব চলে গেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব প্রক্রিয়ার কেন্দ্রের কর্পোরেট পুঁজির হাতে। তাদের দরকার এমন শাসন ব্যবস্থা যা প্রান্তের দেশগুলোর পুঁজির প্রবাহ ও উদ্বৃত্তের প্রবাহ প্রাপ্তি নিরাপদ রাখতে পারে, জনগণের অসন্তোষ বা ক্রোধ থেকে ব্যবস্থাটি রক্ষা করে চড়া মুনাফা ফেরত নিশ্চিত করতে পারে। তাই তাদের জন্য সহায়ক গণতন্ত্রকেই তারা বাংলাদেশের মতো দেশে চালান করে। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ। স্বাভাবিক কারণেই বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজির এ ভূখণ্ড নিয়ে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে সেখানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনীতিসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় প্রতিবেশী দেশগুলো। অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি এর কম-বেশি বিরূপ প্রভাব পড়ে ভারত ও চীনসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির ওপর। তা ছাড়া এ অঞ্চলের কোন রাষ্ট্রেই ধর্মীয় বা ভৌগোলিক কারণেই তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সবার জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। এসব দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ছেদ ফেলে। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং এ অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বক্তব্য-মন্তব্য গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, আঞ্চলিক অগ্রগতির জন্য তারা স্থিতিশীলতাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। সংলাপ, অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন ইত্যাদি শব্দাবলী আসলে কোন তাৎপর্য বহন করে না। এসব শব্দের সঙ্গে জনগণের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। এ নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে তর্কের তুফান তোলা মানে আসল সমস্যা আড়ালে রাখার চেষ্টা। বরং সজাগ থাকা উচিত বহুজাতিক কর্পোরেশনের গতি-বিধির ওপর। তাদের প্রসারিত হাত কিভাবে এদেশীয় সম্পদ তুলে নেয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। যে সম্পদের মালিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার খেলোয়াড়রা নয়, এ দেশের মানুষ। নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে কি কৌশলে ওই প্রসারিত হাত জনগণের সম্পদ তুলে নেবে- সচেতন নাগরিকদের সেদিকে সতর্ক খেয়াল রাখা জরুরী। নাইজিরিয়ার কবি কেন্্ সারো উইয়া কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যেমন মানুষকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে, কর্পোরেট পুঁজি তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট ও ভূমি এবং পরিবেশ ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে মানুষ হত্যা করে।’ একে তিনি ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এবং এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা, লেখালেখি করায় তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল নাইজিরিয়ার সামরিক শাসকের হাতে। যে সরকারের পেছনে তখন অন্যতম খুঁটি ছিল ডাচ ও মার্কিন দুই বিখ্যাত কোম্পানি। এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো নামে নাইজিরিয়ান এক লেখক তার ‘আপসাইড ডাউন’ বইয়ে বলেছেন, ‘তেল সম্পদ লুট করতে গিয়ে শেল ও শেভরন নাইজিরিয়ার অগোনি সম্প্রদায়ের ভূমি ও নদী-নালাসহ তাদের পুরো পরিবেশই ধ্বংস করে ফেলেছে।’ অথচ এদের কাছ থেকেই আমরা পরিবেশ রক্ষার জ্ঞান আহরণ করি। তৃতীয় বিশ্বের পরিবেশ রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকার ফান্ড আসে। পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখার জন্য পদক আসে। গণতন্ত্র নিয়ে বহুমাত্রিক খেলাধুলা পৃথিবীর নানা দেশে চলছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়।
×