ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শোকের ছায়া

চলে গেলেন কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ২২:০৭, ১৬ নভেম্বর ২০২০

চলে গেলেন কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ রূপালী পর্দায় তিনি ছিলেন নায়ক। তবে অভিনয়ের কুশলতায় ভেঙ্গেছিলেন বৃত্তবন্দী নায়কের বৈশিষ্ট্য। তাই যে কোন চরিত্রের রূপায়ণে তার জুড়ি মেলা ভার। তাই গোয়েন্দা থেকে ভিলেন কিংবা ফেলুদা থেকে গঙ্গাচরণÑসব চরিত্রেই ছিল তার সাবলীল বিচরণ। থেমে গেল সেই কিংবদন্তি অভিনেতার বর্ণাঢ্য জীবনের পরিভ্রমণ। চলেন গেলেন কালের সাক্ষী হয়ে থাকা প্রবাদপ্রতীম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলো তার একচল্লিশ দিনের জীবনযুদ্ধ। রবিবার বেলা সোয়া বারোটায় কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বাংলা ছবির এই মহাতারকা, অভিনেতা, নাট্যকার, বাচিকশিল্পী ও চিত্রকরের বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। রেখে গেছেন মেয়ে পৌলমি ও এক ছেলেকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের খবরে ওপার বাংলা ছাপিয়ে শোকের ছায়া নেমে আসে এপার বাংলায়। শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ থেকে সাধারণ দর্শক-ভক্তরা নিমজ্জিত হয়েছেন বেদনার বালুচরে। ফেসবুকের পাতায় পাতায় ভেসে উঠেছে শোকের প্রকাশ। সৌমিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নন্দিত অভিনেত্রী জয়া আহসান ফেসবুকে নিজস্ব ভেরিফায়েড পেজে লিখেছেন, পর্দায় তিনি যখন অভিনয়ের গরিমা ঝেড়ে ফেলে চরিত্রের আচরণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন, ভারতবর্ষের শিল্পভুবনে সেটা শুধু বিস্ময়কর একটা ঘটনাই ছিল না, ছিল এক নতুন যুগের শুরু। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অভিনয়ের প্রথম সারিতেই তার স্থান। কিন্তু অমন যে ইতিহাসের স্রষ্টা, অমন যে শিখরে ওঠা শিল্পী, মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন এক মহাসাগর। যে মহাসাগর অতলান্ত, কিন্তু শান্ত। তার মৃত্যু নেই! সৌমিত্রের মেয়ে পৌলমির বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, রবিবার দুপুর দুটায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার গল্ফগ্রীন বাসভবনে। এর পর টেকনিশিয়ান স্টুডিও হয়ে নিয়ে যাওয়া রবীন্দ্র সদনে। দুই দফা শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়াতলা শ্মশানে। সেখানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এর আগে সৌমিত্রের মৃত্যুর খবরে তাকে চিরবিদায় জানাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ছুটে যান হাসপাতালে। এক টুইট বার্তায় মমতা লেখেন, ফেলুদা আর নেই। অপু আমাদের বিদায় জানিয়েছেন। বিদায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উনি একজন কিংবদন্তি। বাংলা, ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র একজন মহান অভিনেতাকে হারাল। ওঁকে খুব মিস করব আমরা। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ অভিভাবকহীন হয়ে গেল। গত ১ অক্টোবর থেকে সৌমিত্রের শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হন। তখনও করোনার কোন উপসর্গ পাওয়া যায়নি। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর তার কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ৬ অক্টোবর তাকে ভর্তি করানো হয় বেলভিউ নার্সিং হোমে। এর আগে একটা সময়ে ক্যান্সারেও আক্রান্ত হয়েছিলেন সৌমিত্র। সেই অসুস্থতা স্বভাবতই তাকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। ফলে কখনও উন্নতি কখনও অবনতি; এই দোলাচলেই চলছিল হাসপাতালবন্দী সৌমিত্রের জীবন। এছাড়াও একাধিক কোমর্বিডিটি ছিল তার। এসব কিছুর মাঝেই হাসপাতালে চিকিৎসাকালে সর্বশেষ ১৪ অক্টোবর তাঁর করোনার নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। এর পরই সৌমিত্র সুস্থ হতে থাকেন। চলছিল চিকিৎসা। এর পর ২৪ অক্টোবর রাত থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। এর পর ধীরে ধীরে তিনি চেতনাহীন হয়ে পড়েন। তাকে সুস্থ করার জন্য গত বৃহস্পতিবারও প্লাজমা থেরাপি দেয়া হয়। এর আগে বুধবার কিডনির ডায়ালাইসিস করা হয়। শুক্রবার বিকেলে তাঁর হৃদস্পন্দন হঠাৎ করে বেড়ে যায়, রাতে চেতনা স্তর ৫-এ নেমে যায়। শারীরিক অবনতি পৌঁছে যায় বিপজ্জনক মাত্রায়। সৌমিত্রের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ১৬ সদস্যের চিকিৎসক দলের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। ফুসফুসে আরও বেশি করে অক্সিজেন পৌঁছানোর জন্য শনিবার বাড়ানো হয়েছিল অক্সিজেনের মাত্রা। এ সময় তার চিকিৎসক দলের প্রধান ক্রিটিক্যাল বিশেষজ্ঞ অরিন্দম কর জানিয়েছিলেন, এই চেতনা স্তর ৩-এ নেমে গেলে চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্রেন ডেথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকে বিভিন্ন ধরনের লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছিলেন অরিন্দম কর। এদিকে অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। রবিবার তাকে দেয়া হয়েছিল শতভাগ ভেন্টিলেশন সাপোর্ট। রক্তচাপ, হার্টবিট, হার্ট রেট স্বাভাবিক করার জন্য যা যা ওষুধ দরকার, সব দেয়া হয়। শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচারসহ নানাভাবে এই অভিনেতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কোন কিছুতেই চিকিৎসায় তিনি সাড়া দেননি। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে থমকে যায় সৌমিত্রের হৃদস্পন্দন, বিদায় নেন প্রকৃতির নিয়মে। পারিবারিকভাবে শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক বলয়ের মাঝে বেড়ে ওঠেন সৌমিত্র চট্টোয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম নেন এই কীর্তিমান। বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। জীবনের প্রথম দশটা বছর সৌমিত্র কাটিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরে। তার দাদার নাটকের দল ছিল। বাড়িতে নাট্যচর্চার পরিবেশ ছিল। ছোটবেলা থেকেই নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে সৌমিত্র ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে হঠাৎ একদিন মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখার সুযোগ হয় তাঁর। সেদিনই ঘুরে যায় তার জীবনের মোড়। পুরো মনোনিবেশ করেন নাটকে। শিশির ভাদুড়ীকে গুরু মানতেন সৌমিত্র। নিজেই বলেছেন, অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের। সব রকম আলোচনা হতো দুজনের। পরবর্তীতে অস্কারজয়ী নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই বিকাশ ঘটে সৌমিত্রের অভিনয় জীবনের। সব মিলিয়ে সত্যজিতের ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। বাংলা সিনেমা জগতের আরেক কিংবদন্তি ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে সৌমিত্রকে পরিচয় করিয়ে দেন সত্যজিৎ রায় নিজেই। সিনেমার জগতে হাতেখড়ি হয় সৌমিত্রের সে সময়। ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে রূপ দেন অপু চরিত্রে। প্রথম ছবিতেই আলোচনায় এসেছিলেন। সেই ছবির শূটিংয়ে প্রথম দিনের ফার্স্ট শটেই সিন ওকে হয়ে যয়। ছবিতে ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’, তার আর শর্মিলা ঠাকুরের সেই সংলাপ, রসায়ন এখন বাঙালী মননে অমলিন। পরে একে একে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘চারুলতা’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’সহ বহু ছবি করেছেন তিনি। সত্যজিতের প্রায় ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র। সত্যজিতের সৃষ্টি ‘ফেলুদা’কে সেলুলয়েডে জীবন্ত করেছিলেন তিনিই। ফেলুদা বহুবার ছোট ও বড় পর্দায় এলেও সৌমিত্রের মতো আর কেউ সেরূপ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি সেই চরিত্রকে। ১৯৬১ সাল ছিল সৌমিত্রের অভিনয় জীবনের আরেক মাইলফলক। ওই বছরই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত ‘ঝিন্দের বন্দী’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সেই ছবিতে সৌমিত্রকে প্রথম দর্শক পেয়েছিলেন একটি খলচরিত্রে। নাম ‘ময়ূরবাহন’। যে অভিনেতা ‘অপু’ হিসেবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’ বা ‘সমাপ্তি’তে যে নায়ক ঝড় তুলেছেন, সেই অভিনেতাকে তপন সিনহা দিলেন এক নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। তখনও বাংলার দর্শকের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল। উপন্যাসে ময়ূরবাহনকে একজন অত্যন্ত ‘সুদর্শন ও লম্পট’ যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন শরদিন্দু। সৌমিত্রের অভিনয়গুণে বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু সংলাপ আজও ঘুরেফিরে বেড়ায় দর্শকের স্মৃতির মণিকোঠায়। এর একটি হচ্ছে ‘কোনি’ ছবির বিখ্যাত সংলাপ, ‘ফাইট! কোনি ফাইট!’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘অশনি সংকেত’, ‘ সোনার কেল্লা’, ‘দেবদাস’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গণদেবতা’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘আতঙ্ক’, ‘গণশত্রু’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘তিন কন্যা’, ‘আগুন’, ‘শাস্তি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। বর্ণিল অভিনয় জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের এই দিকপাল ২০১২ সালে পেয়েছেন ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ২০০৪ সালে তাকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করা হয়। এছাড়া পেয়েছেন দেশ-বিদেশের অজস্র সম্মাননা ও পুরস্কার। এর মধ্যে ২০১৮ সালে পেয়েছেন ফ্রান্সের ‘লেজিয়ঁ দ্য নর’ পুরস্কার। পেয়েছেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র, সংগীত, নাটক একাডেমি, ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার। বাংলাদেশেই সৌমিত্রের আদিবাড়ি ॥ বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া নামে একটি গ্রামে আদিবাড়ি ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তার পিতামহের সময় থেকে তারা পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন। কৃষ্ণনগরেই ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি তার জন্ম হয়। ৬০ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলার এপার ও ওপারে তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্ত রয়েছেন।
×