ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাইডেন প্রশাসনের নীতি কেমন হবে?

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১৫ নভেম্বর ২০২০

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাইডেন প্রশাসনের নীতি কেমন হবে?

ইলেক্টোরাল ভোট এবং মোট ভোটের হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাপকাঠিতে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ঘোষণা হওয়ার পর জো বাইডেন তার প্রথম ভাষণে আমেরিকানদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আমেরিকান জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী চেতনা সুপ্তভাবে সব সময় লক্ষ্য করা যেত। সেই সুপ্ত বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রচারণায় নিয়ে এসে ট্রাম্প প্রথম দফায় সাফল্য পান আর দ্বিতীয় মেয়াদে হন বিফল। তবে অর্ধেকের কাছাকাছি আমেরিকান ট্রাম্পের নীতিকে সমর্থন করেছেন। ফলে বাইডেন যে ঐক্যবদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আমেরিকান রাষ্ট্রের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তাতে অর্ধেক আমেরিকানের চেতনা বাদ যাবে না। তিনি হয়তো শ্বেতাঙ্গদের অধিকার ও মর্যাদাকে উচ্চকিতই রাখবেন, তবে অশ্বেতাঙ্গদের অধিকারকে পদদলিত করে নয়। ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাট শাসনে আমেরিকান অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। আর রিপাবলিকান শাসনে দুরবস্থা নেমে আসে। ট্রাম্পের বিদায়ী মেয়াদটি ছিল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। করোনার মতো দুর্যোগের সময়ও আমেরিকার অর্থনীতির স্থিতি তিনি মোটামুটি ধরে রাখতে পেরেছেন। জুনিয়র বুশের পর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতির গতি ফেরাতে ওবামাকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। বাইডেনকে সম্ভবত সে অবস্থায় পড়তে হবে না। যদিও করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অন্য অনেক দেশের মতো তাকেও সামলাতে হবে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সমর্থন দিয়ে নতুন নতুন কাজ সৃষ্টি করতে হবে। বাইডেনের অতীত অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের কারণে অর্থনৈতিক অগ্রগতি চাঙ্গা করার ব্যাপারে আমেরিকানরা তাদের আস্থার বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছে সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যার প্রতিফলন ঘটেছে জো বাইডেনের অনুকূলে। জো বাইডেনের শপথ নেয়ার বিষয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঘরের মধ্যে তাকে মুখোমুখি হতে হবে তিক্তভাবে বিভক্ত জাতির। বাইডেনের মনোযোগ পররাষ্ট্রনীতিতে নিবদ্ধ করতে পারে গৃহের তিক্ততা। আরও কিছু কারণে ট্রাম্প যেমন বহির্বিশ্বের দিকে পিঠ ফিরিয়ে রেখেছিলেন, এর বিপরীতে বহির্বিশ্বকে আলিঙ্গন করবেন বাইডেন। তার প্রথম কারণ, পররাষ্ট্রনীতিতে অভিজ্ঞ আমেরিকায় জীবিত যে কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছেন, তার মধ্যে জো বাইডেন অন্যতম। একজন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তো বটেই, দীর্ঘদিন সিনেট বৈদেশিক কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তার পররাষ্ট্র টিমের সবাই অভিজ্ঞ। এরই মধ্যে তার টিম সবচেয়ে বড় তিনটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। যেমন- কোভিড, ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও চীন। বাইডেন এ তিন ইস্যু নিয়ে কাজ করলে ইউরোপ ও এশিয়াকে নিজের পাশে পাবে যুক্তরাষ্ট্র। কয়েকদিন আগে অফিসিয়ালি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে আবার অন্তর্ভুক্তিই হতে পারে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রথম পদক্ষেপ। এছাড়া মানবাধিকার, অভিবাসন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ ইউরোপীয় নীতিতে অনেকটা নমনীয় ও যৌক্তিক হবে বলে বিশ্ববাসীর ধারণা। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে অভিবাসন নীতি কঠোর হলেও বাইডেন প্রশাসনের আমলে তা অনেকটা শিথিল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী বাংলাদেশী নাগরিকরা সুবিধা পেতে পারেন, বিশেষ করে অবৈধ অভিবাসীরা বৈধ হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় বৈশ্বিক ফোরামে কাজ করছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বে যে কয়েকটি দেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে জোর দিয়েছেন জো বাইডেন। নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু ইস্যুতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের একযোগে কাজ করা আরো সহজ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অভিবাসন ও জলবায়ু ইস্যুতে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, জো বাইডেন জলবায়ু ইস্যুতে সোচ্চার, অভিবাসী ইস্যু নিয়েও তিনি সোচ্চার। তবে বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তার নিজের স্বার্থ দেখে। তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এশিয়ার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি হবে আগের প্রশাসন থেকে ভিন্নতর, সে কথা তিনি তার প্রথম বিজয় ভাষণে জোর দিয়ে বলেন। আশা করা যায় তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেবেন। এছাড়া তার রানিংমেট এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ধমনিতে ভারতীয় উপমহাদেশের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণেই ধারণা করা যাচ্ছে, নতুন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নতি হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ওবামা প্রশাসনের সময় থেকে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার বা কৌশলগত মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। জো বাইডেনের প্রশাসনেও এ নীতি অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে। কারণ, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাতে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূ-কৌশলগত অবস্থানে আছে। সুতরাং, নতুন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে অবশ্যই গুরুত্ব দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ সুবিধাগুলো ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করলে এখন তা পাওয়া যেতে পারে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে আমেরিকান ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কড়াকড়ি ছিল সেটাও তুলে নেওয়া হবে বলে আশা করা যায়। আর এখন বাংলাদেশী ছাত্ররাও উচ্চশিক্ষা নিতে সহজেই যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবে। যেসব বাংলাদেশী দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করলেও নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন, তাদের প্রতি নতুন প্রশাসন সহানুভূতিশীল আচরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পূর্ব এশিয়াজুড়ে সবচেয়ে বড় যে বাধা বাইডেন প্রশাসনকে মোকাবিলা করতে হবে, তা হচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। অর্থনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন নানাভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে সামরিক শক্তির দিক থেকেও চীন এখন আগের মতো পিছিয়ে নেই। ফলে ভয় দেখিয়ে চীনকে বাগে আনার মতো পরিস্থিতি এখন আর নেই, যে চেষ্টা ট্রাম্প প্রশাসন করে যাচ্ছিল। আন্তপ্রশান্ত মহাসাগর অংশীদার বা টিপিপির মতো নতুন কোনো বহুপক্ষীয় কাঠামোতে চীনকে যুক্ত করে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কি না, জাপান সেটা এখন বিবেচনা করে দেখছে এবং ওয়াশিংটনকেও হয়তো টোকিও এ বিষয়ে প্রভাবিত করতে পারে। তবে তা করতে হলে তাইওয়ান সংক্রান্ত কঠোর অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা হলেও সরে আসতে হবে। ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যযুদ্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন, তার অনেক কিছুই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার রীতি-নীতির খেলাপ বলে বেইজিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। এটি পুনর্বিবেচনা করতে পারেন বাইডেন। সার্বিকভাবে বাইডেন শাসনে চীনের সঙ্গে কৌশলগত বৈরিতার মধ্যেও এক ধরনের কাজের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। আর করোনা-উত্তর সময়ে চীনবিরোধী সর্বাত্মক লড়াইয়ের যে ডংকা ট্রাম্প বাজাচ্ছিলেন, সেটি কিছুটা স্তিমিত হতে পারে। তবে করোনা বিস্তারে চীনের পরিকল্পিত সম্পৃক্ততার ব্যাপারে বৈশ্বিক নীতি প্রণেতারা নিশ্চিত হলে অন্য এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেও পারে চীনের ব্যাপারে। ইউরোপের এক সেনাপ্রধানের আরেক মহাযুদ্ধের হুঁশিয়ারিতে সে ধরনের ইঙ্গিতই পাওয়া যায়। মোদির সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও তারা আফগানিস্তানে শান্তি-প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে একপর্যায়ের সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল। এ ক্ষেত্রে চীনের অতি ঘনিষ্ঠতাকে বাধা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছিল পেন্টাগন থেকে। এমনকি নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার একটি উদ্যোগের সঙ্গেও ট্রাম্প প্রশাসনের গোপন সম্পর্ক রয়েছে বলে বলা হচ্ছিল। বাইডেন ক্ষমতায় চলে এলে সে এজেন্ডা এবার আর সামনে এগোবে বলে মনে হয় না। ডেমোক্রেট শাসনের সঙ্গে নতুন পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের সম্পর্কের উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। এখন গণতান্ত্রিক বিশ্বের সবার দৃষ্টি থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। বিশ্ব দেখতে চায় আগামী দিনগুলোতে কিভাবে জো বাইডেনের গণপ্রশাসন এগিয়ে যাবে। তাছাড়া সারা বিশ্বেই বাইডেনের একটা ইতিবাচক ইমেজ আছে। পাশাপাশি বাংলাদেশেও তার প্রচুর জনসমর্থন আছে। আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও গভীর হবে এবং এ সম্পর্কের নতুন একটা উন্নয়নসূচক আমরা দেখতে পাব। লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী
×