ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার নিরাপদ ভ্যাকসিন কত দূর?

প্রকাশিত: ২২:২১, ১০ অক্টোবর ২০২০

করোনার নিরাপদ ভ্যাকসিন কত দূর?

রশিদ মামুন ॥ কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারকরা ঘোষণা করেছিলেন সেপ্টেম্বরেই তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ হবে। এই ট্রায়াল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে আসবে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন। সেপ্টেম্বর চলে গেছে এখনও উৎপাদনকারীরা ভ্যাকসিনের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। বিশ্বের প্রায় ৬০০ কোটি মানুষই একটি নিরাপদ কার্যকর ভ্যাকসিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। বছরের শেষ দিকের সময়টি যতই দ্রুত ফুরাচ্ছে ততই একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে ভ্যাকসিন মিলবে তো এ বছর। বিশ্বে কার্যকর একটি ভ্যাকসিন এলেও দেশের মানুষের কাছে তা কবে পৌঁছবে তা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে এগিয়ে থাকা চার দেশ যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত এখন তাতে ভাটা পড়েছে। তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ না করেই জরুরী ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে রাশিয়া এবং চীন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে এসে ভ্যাকসিনের পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়েছে। এই সব জটিলতার কারণে চলতি বছরের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য ভ্যাকসিন উন্মুক্ত করা সম্ভব কি না তা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। ব্লুমবার্গ এক প্রতিবেদনে বলছে, আগামী এক বা দু সপ্তাহের মধ্যে বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি এ্যাস্ট্রাজেনেকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ভ্যাকসিনের যে পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেটি আবার শুরু করতে পারবে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভ্যাকসিনটি বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের পরীক্ষাগুলোই যথেষ্ট। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। ভ্যাকসিনের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে মার্কিন খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) অনুমোদনকে সারাবিশ্বেই বিশেষ গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। তবে মার্কিন ট্রায়াল শেষ না হলে এফডিএ’র অনুমোদনের বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যদিও ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভ্যাকসিনটির প্রথম উৎপাদিত ১০০ কোটি ডোজের এক তৃতীয়াংশ এর মধ্যে কিনে নিয়েছে মার্কিন সরকার। বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যানসেট এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিজয় শঙ্কর বালাকৃষ্ণ জানিয়েছেন রাশিয়ার ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি নিয়ে সমালোচনা থামছে না। দ্য ল্যানসেট ভ্যাকসিনটির প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করা সত্ত্বেও ভ্যাকসিনটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা চলছে। তবে এই সমালোচনার মধ্যেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার রাশিয়াও জোর দিয়ে বলছে এই ভ্যাকসিন গ্রহণে কারও কোন ক্ষতি হলে তার দায় নেবে তারা। কিন্তু তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাকসিনটিতে পুরাপুরি মানবদেহের জন্য নিরাপদ এ কথা বলা সম্ভব নয়। স্পুটনিক ভি’য়ের বিষয়ে রাশিয়া যে ওয়েবসাইট প্রকাশ করেছে তাতে বলা হচ্ছে এখন তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে। রাশিয়া ছাড়াও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ফিলিপাইনে গত ২৪ আগস্ট থেকে এই ট্রায়াল শুরু হয়েছে। সম্ভব হলে তারা ভারত এবং ব্রাজিলে ট্রায়াল চালাতে চায়। রাশিয়ার ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (আরডিএফ) ফান্ড এই ভ্যাকসিন তৈরিতে অর্থায়ন করছে। আরডিএফের তরফ থেকে বার কয়েক বলা হয়েছে তারা সেপ্টেম্বরেই ভ্যাকসিনের বিপুল পরিমাণ উৎপাদনে যাবে। তবে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ না হলে ভ্যাকসিনটির নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় দূর হওয়া সম্ভব নয়। আর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ করতে অন্তত ছয় মাস সময় প্রয়োজন হয়ে থাকে। সেই হিসেবে সব দিক ঠিক রেখে এই ট্রায়ালের ফলাফল পেতে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যদিও লাইফ সেভিং ড্রাগের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়ে দ্রুত অনুমোদন দেয়ার জন্য সব ধাপ অনুসরণ করা হয় না। সেক্ষেত্রে আরও আগেই এই ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। তবে তা চলতি বছরের মধ্যে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনের দশাও রাশিয়ার মতোই তারাও একাধিক ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিলেও কোনটিরই তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শেষ করেনি। প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের যে ট্রায়াল চালানো হয়েছিল সেগুলোর বিশ্লেষণ চলছে এখনও। মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মরডার্না, ফাইজার এবং জার্মানির এনবায়োটেক এর উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনগুলোর তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল এখনও শেষ হয়নি। বছরের শেষনাগাদ এসব ট্রায়ালের ফলাফল হাতে আসলেও ভ্যাকসিন তৈরি এবং সরবরাহ চলতি বছরের মধ্যে করাটা দুরূহ হয়ে উঠবে। সংক্রমণের আধিক্য রয়েছে এমন দেশগুলো নিজেরা আগ্রহী হয়ে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান সবার আগে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করেছে। চীনের তৈরি একটি ভ্যাকসিন সেখানে আট থেকে ১০ হাজার স্বেচ্ছা সেবকের ওপর প্রয়োগ করা হবে। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগকে উদ্ধৃত করে ভয়েজ অব আমেরিকা এ খবর জানিয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে তাদের দেশে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চলছে। ভারতের পুনের সেরাম ইনস্টিটিউট এই ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য এ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করেছে। অন্যদিকে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে ট্রায়ালের সুযোগ দিতে চাইলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা ভেস্তে গেছে। সব শেষ প্রতিষ্ঠানটি ট্রায়ালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছে। যদিও শুরুতে একেবারে ফ্রি ট্রায়াল দেয়ার সঙ্গে এক লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিতেও চেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। সঙ্গত কারণে দেশে কোন ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হওয়াটা এখন অনেকটা অনিশ্চিত। ব্রিটেনের অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগ্রহ দেখালেও এ্যাস্ট্রাজেনেকা এতে সাড়া দেয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের স্বাস্থ্য এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভ্যাকসিন দূতিয়ালিতে এখনও পর্যন্ত কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি। উল্টো চীনের সেধে দেয়া সুযোগটাও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে ভ্যাকসিন এলেই কি দেশের মানুষ তা পেয়ে যাবে, নাকি অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেক দিন এমন আলোচনা চলছেই।
×