ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৩৬ দফা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ সালাউদ্দিনের

প্রকাশিত: ২৩:২২, ৬ অক্টোবর ২০২০

৩৬ দফা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ সালাউদ্দিনের

রুমেল খান ॥ প্রতিশ্রুতি দেয়া যতটা সহজ তা বাস্তবায়ন করা ততটাই কঠিন। এই বিষয়টি কাজী মোঃ সালাউদ্দিনের চেয়ে ভাল আর কে জানে। যে কোন নির্বাচনের সময় নেতারা ভোটারদের উদ্দেশে কিছু প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি নিয়ে হাজির হন। সেগুলো দিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করেন যেসব ভোটার এই প্রতিশ্রুতিতে মজে যান এবং সেই নেতাকে বিশ্বাস করেন, তারাই তাকে ভোট দেন এবং নির্বাচনে পাশ করিয়ে দেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেটা বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়- ক্ষমতায় এসে ধীরে ধীরে সেসব প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যান নেতারা। অথবা মনে থাকলেও সেগুলোর খুব কমই বাস্তবে রূপ দেন। সেক্ষেত্রে এসব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয়গুলো ভোটাররা মনে রাখেন এং পরবর্তী নির্বাচনে সেই নেতাকে ভোট না দিয়ে এবং ফেল করিয়ে দিয়ে সমুচিত জবাব দেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক ক্রীড়ামোদীর মতে এই সূত্রটি সালাউদ্দিনের বেলাতে একদমই খাটে না! তিনি কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে, কথার মায়াজালে সবাইকে বিভোর করে রাখেন। চমক দেখিয়ে কোন কাজ শুরু করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেসব কাজের কোন শেষ থাকে না। কিছু কিছু কাজ অবশ্য করেন। আর এভাবেই পার করে দেন মেয়াদের চারটি বছর এবং প্রস্তুতি নেন পরবর্তী মেয়াদে আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য। ২০০৮, ২০১২, ২০১৬’র পর ২০২০ ... টানা চার মেয়াদেই সালাউদ্দিন নাকি এভাবেই বারবার নির্বাচিত হয়েছেন দেশীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফের) সভাপতি হিসেবে। এর মধ্যে শুধু একবারই বাফুফের মসনদে বসেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় (২০১২ নির্বাচনে), বাকি তিনবারই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে, তাও বিপুলভাবে। আবার এর বিপরীত মতও আছে অনেক ক্রীড়ামোদীর। তাদের মতেÑ সালাউদ্দিনের আমলেই দেশের ফুটবল তলানিতে চলে যায়নি। চলে গিয়েছিল তারও বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। সালাউদ্দিন বরং দায়িত্ব নিয়ে মৃতপায় ফুটবলকে অক্সিজেন দিয়ে কোনমতে বাঁচিয়ে তুলেছেন। এর প্রমাণ প্রতি বছর বিপিএল, বিসিএল এবং অন্যান্য স্তরের লীগগুলো নিয়মিত আয়োজিত হওয়া, ফুটবলাররা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছে, বেশি ম্যাচ খেলে তারা ক্লান্ত, জাতীয় দলের জয়ের হার সালাউদ্দিনের আগের আমলের চেয়ে পাঁচ শতাংশ বেড়েছে, মহিলা ও পুরুষদের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলগুলোর ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে ... এমন আরও অনেক আছে। কাজেই সালাউদ্দিন ব্যর্থ নন বলেই প্রতিবারই তাকে ভোট দিয়ে পাস করিয়ে আনে ভোটাররা। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার, প্রতি নির্বাচনেই সভাপতি হওয়ার পথে আগেরবারের চেয়ে ভোট বেশি পেয়েছেন সাবেক তারকা জাতীয় ফুটবলার এবং এই কোচ, যেটিকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘জনপ্রিয়তার ফলাফল’ হিসেবে। সালাউদ্দিন বিরোধীরা প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশের ফুটবলের এই অধঃপতনের দায়ভার কোনভাবেই এড়াতে পারে না বাফুফে। তাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং অদূরদর্শিতায় দেশের ফুটবলের এই অবস্থা। কাজেই ফুটবল উন্নয়নে তৃণমূলে যেতে হবে, নতুন খেলোয়াড় তুলে আনতে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে জোর দিতে হবে। এটা ঠিক যে সালাউদ্দিনের আমলে তৃণমূল ফুটবল বলতে গেলে নির্বাসনেই চলে গিয়েছিল। তিনি মজেছিলেন জাতীয় দল এবং পেশাদার লীগ নিয়েই। পাইপলাইনে দক্ষ ফুটবলার না থাকার পরিণাম টের পাওয়া গেছে হাড়ে হাড়ে। এই বিপর্যয়ের পর হুঁশ ফিরে বাফুফের। প্রণয়ন করে একটি ৪ বছর মেয়াদী (২০১৭-২০২০) পূর্ণাঙ্গ ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো বিশ্বের সব ফুটবল ফেডারেশন যেমনটা পালন করে। যেমন লীগ এবং বিভিন্ন টুর্নামেন্ট। অন্যটি হলো সার্বিক ফুটবলের উন্নয়নের দায়িত্ব নেয়া। বাফুফের ঘরোয়া ফুটবলের সূচী প্রশ্নবিদ্ধ থাকে প্রতি বছরই। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় যখন মৌসুম শেষ হয়ে যায় তখনও খেলাই শুরু করতে পারে না লীগ কমিটি। ফলে জটিলতা তৈরি হয় ক্লাবগুলোর আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। বিষয়টি বিবেচনায় এনেই এবার তারা মৌসুমের সূচী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবারের নির্বাচনের আগে ৩৬ দফা (২০১৬’র নির্বাচনে ছিল ২৫ দফা) ইশতেহার ঘোষণা করেছিল সালাউদ্দিনের নেতৃত্বধীন সম্মিলিত পরিষদ। সেখানে ২০২৪ সালের মধ্যে জাতীয় পুরুষ ও মহিলা দলের র‌্যাঙ্কিংয়ের উন্নতি ঘটনো, জাতীয় দল নিয়ে ৬টি পরিকল্পনা, ঘরোয়া ফুটবলের সুনির্দিষ্ট পঞ্জিকা তৈরি করা, নারী ফুটবল দল নিয়ে আলাদা ৪ দফা পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল স্টেডিয়ামের সংখ্যা বৃদ্ধি, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ নিয়মিত আয়োজন, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও এসএ গেমসের শিরোপা পুনরুদ্ধার, জেলা ফুটবল লীগগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয়োজন, প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বিভাগ লীগে অংশ নেয়া দলগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনা, টার্ফগুলোর পুনঃউন্নয়ন, ঘরোয়া ফুটবলের দলগুলোর হোম ভেন্যুর প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, আন্তর্জাতিক মানের জিমনেশিয়াম তৈরি ও বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলো আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। সালাউদ্দিন দাবি করেছিলেন, ২০১৬ নির্বাচনের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতির ৭৫ ভাগই পূরণ করতে পেরেছেন তিনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ নতুন মেয়াদে ৩৬ প্রতিশ্রুতির কয়টা বাস্তবায়ন করতে পারবেন তিনি? অনেকেই বলেন, সালাউদ্দিন যে কোন কাজই শুরু করেন ঢাকঢোল পিটিয়ে, মহাসমারোহে। কিন্তু তার কাজের শেষটা আর দেখা যায় না। এখন দেখার বিষয় তার নতুন এই পরিকল্পনা দিয়ে দেশের ফুটবলের আদৌ কোন উন্নয়ন ঘটাতে পারেন কি না, নাকি এটাও হয়ে থাকবে নিছকই তার আরেকটা স্টান্টবাজি! এখন দেখার বিষয়, নির্বাচনের আগে তিনি যে ৩৬ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো তিনি পরের চার বছরের মধ্যে পূরণ করতে পারেন কি না।
×