ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইপিএলকে কেন্দ্র করে এবার ‘ডিজিটাল জুয়া’

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ৪ অক্টোবর ২০২০

আইপিএলকে কেন্দ্র করে এবার ‘ডিজিটাল জুয়া’

শংকর কুমার দে ॥ এবার বসেছে ‘ডিজিটাল জুয়া’। এই ধরনের জুয়ার আসর বসেছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ আইপিএল-এর ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে। ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড আয়োজিত আইপিএল অনুষ্ঠিত হচ্ছে আরব আমিরাতে। আইপিএলকে সামনে রেখে বসেছে বিশ্বের তাবত জুয়াড়ির মিলন মেলা। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশী জুয়াড়িরাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়েই চলছে ডিজিটাল জুয়া। ডিজিটাল জুয়া বা জুয়ার আসর ধরার জন্য শুরু করা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি এড়াতেই করোনা মহামারীর মধ্যে আইপিএল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজনের সাহস দেখিয়েছে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড। বিশ্বজুড়ে সব ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলোর জন্যই অধীর আগ্রহে বসে থাকে জুয়াড়িরা। কেননা এই সময়টাতেই যে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার সুযোগটি আসে জুয়াড়িগোষ্ঠীর। কিন্তু জুয়া খেলা তো নিষিদ্ধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর থাকে তীক্ষ দৃষ্টি। ধরা পড়লেই জেল জরিমানা, কঠোর শাস্তি। জুয়াড়িরাও কম যায় না। সময় পাল্টেছে, যুগ বদলেছে- বদলেছে তাদের জুয়া খেলার ধরন। একটা সময় থ্রি কার্ড, ফ্লাশ, হাউজি ইত্যাদি খেলায় বা ক্যাসিনো অথবা নানা ধরনের লোকাল খেলায় মানুষ ধরে আসছে বাজি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রিকেট খেলায় জুয়া বা বাজি ধরাটা খ্যাতি লাভ করেছে। দেশের সীমানার গ-ি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও ক্রিকেট জুয়া এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, অনেক সময় খেলোয়াড়রাও অজান্তেই জুয়াড়িদের খপ্পরে পড়ে নিষিদ্ধ হওয়া, জরিমানা দান, ক্ষমা প্রার্থনাসহ নানা ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আছে দীর্ঘ ইতিহাস। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিতেই নানা কৌশলের মধ্যে এখন ডিজিটাল জুয়ার পথ বেছে নিয়েছে জুয়াড়িরা। আইপিএল খেলায়ও চলছে জুয়া। জুয়া ধরছে ক্রিকেটের প্রতিটি ব্যাটে-বলে। এখন ডিজিটাল যুগ। ডিজিটাল যুগের খেলায় ধরন পাল্টে হয়েছে ডিজিটালাইজেশন। জুয়ার ধরন পাল্টিয়ে চলছে এখন ডিজিটাল জুয়া। ডিজিটাল জুয়ার খেলার জন্য মুঠোফোন-টেলিভিশন-ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন খুব সহজেই যে কেউ আপডেট রাখতে পারছে যে কোন ম্যাচের। কোন ক্রিকেট ম্যাচ মানেই পাড়া-মহল্লায় দোকানের সামনে ভিড়। সেই ভিড় যত না ক্রিকেট উৎসুকদের, তারচেয়ে বেশি জুয়াড়িদের। প্রতিটি বলে ধরা হয় বাজি। এতে একপক্ষ হয়তো অল্প সময়েই বিশাল অঙ্কের অর্থ পকেটে পুরছে, তবে আরেক পক্ষ হচ্ছে নিঃশেষ। মহামারী করোনার মাঝেও যেন প্রাণের ভয় নেই। জটলা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে। যেখানে টেলিভিশন সেখানেই মানুষ। সেটা টেলিভিশনের শো-রুম হোক, হোক চায়ের দোকান কিংবা সেলুন। সবার দৃষ্টি মুঠোফোন (মোবাইল) ও টেলিভিশনে। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে হাতে হাতে যেমন জুয়া খেলা হয় তেমনি হচ্ছে অনলাইনেও। ‘বেট ৩৬৫ লাইভ’ বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত একটি বেটিং সাইট। এর একটি এ্যাপসও আছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও এই প্রতিবেদক অন্তত ১০ জনের মুঠোফোনে দেখতে পেয়েছেন এ্যাপসটি ইন্সটল করা। সেখানে প্রায় সবাই খেলা দেখছিল বাজি ধরতে। ভিপিএন-প্রক্সি অথবা ডেভেলপারদের সাহায্য নিয়ে তারা অবৈধ এ্যাপসটি মুঠোফোনে ইন্সটল করে জুয়া খেলছেন। একদল ফ্রিল্যান্সার আছে যাদের কাজই হচ্ছে অবৈধ কাগজপত্র বানিয়ে বেট ৩৬৫ লাইভে এ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া। সাধারণত এখানে এ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বাড়ির বিদ্যুত বিল থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু তারা মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে জাল কাগজপত্রে এ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছে। কিন্তু এই সাইট বা এ্যাপসে বাংলাদেশী মুদ্রায় বাজি ধরা যায় না। বাজি ধরতে প্রয়োজন হয় ডলার বা ইউরোর। এ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড হওয়ার পর এবং নিজের এ্যাকাউন্টে অর্থ জমা করার পর বাজি ধরা যায়। বেটিং সাইটে লেনদেন হয় মূলতÑপেপাল, মাস্টার কার্ড, ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। তবে যাদের এই কার্ড নেই তাদের ঘিরে গড়ে উঠেছে আরও একটি অসাধু ‘ব্যবসায়ী’ চক্র। এরা ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট, ডিবিবিএলের মাধ্যমে বাংলাদেশী মুদ্রার বিনিময়ে ডলার বা ইউরো গ্রাহকের এ্যাকাউন্টে ডিপোজিট করে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। বিশাল অঙ্কের একটা লাভও আছে এখানে। ধরুন, বাজার দর অনুসারে প্রতি এক ডলার বাংলাদেশী মুদ্রায় দাম ৮৫ টাকা ০৫ পয়সা। অথচ এক এজেন্টের সঙ্গে দেন-দরবার করে উনি প্রতি ডলার বিক্রি করছেন ১১০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি ডলারে ২৫ টাকা করে লাভ করছেন তিনি। ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবল, টেনিস, গলফ, ঘোড়দৌড়সহ আন্তর্জাতিক সবধরনের খেলাই বেটিং সাইটের অন্তর্ভুক্ত। গ্রাহকদের সহায়তা করতে সাইটটিতে থাকে ২৪ ঘণ্টার হেল্পডেস্ক। করা যায় লাইভ চ্যাট। আবার এ সাইটটির এ্যাকাউন্টও বিক্রি হয়। দেখা গেছে ১৮ বছরের নিচের কোন শিক্ষার্থী এই সাইটটিতে এ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। ফলে ওই ছাত্ররা বাজি খেলতে দুই থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্যের কাছ থেকে এ্যাকাউন্ট কিনেও নেয়। শুধু ছাত্র নয়, তরুণ-যুবক এমনকি বৃদ্ধ- কমবেশি অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে এ রকম ডিজিটাল জুয়ার আসরে। ধরা যাক, কেউ মুম্বাইয়ের জন্য এক হাজার টাকা বাজি ধরল। জিতলে সে পাবে এক হাজার ৮০০ টাকা। অনুরূপভাবে চেন্নাইয়ের হয়ে কেউ এক হাজার টাকা বাজি ধরলে পাবে দুই হাজার টাকা। অর্থাৎ পয়েন্টের সঙ্গে বাজি লাগানোর অর্থ গুণ হয়-এভাবেই ডিজিটাল জুয়ায় আকর্ষণ করানো হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে বেট ৩৬৫ সাইট বন্ধ। কিন্তু এটাও নিয়ন্ত্রণ করে ওই এজেন্টরা। এখনও প্রায় ১০-১২টা সচল লিংক আছে। ওই লিংক দিয়ে ঢুকলেই সরাসরি এ্যাকটিভ সাইটে ঢুকে যাওয়া যায়। এসব এজেন্ট বাদে আরও একটি চক্র আছে যারা অন্যকে বাজি লাগাতে সাহায্য করে। যাদের বেট ৩৬৫ লাইভে এ্যাকাউন্ট নেই বা বাংলাদেশ থেকে ঢোকার পন্থা যার জানা নেই- তারাই এই চক্রের খপ্পরে পড়ে। তবে নিষিদ্ধ বেট ৩৬৫ সাইট বন্ধ হলেও সেখানে বাংলাদেশের যারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জুয়া খেলছে তাদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে অনেক পুলিশ বা সাইবার ক্রাইম কর্মকর্তারই পর্যাপ্ত দক্ষতা বা সক্ষমতা নেই। এই সুযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতোই বাংলাদেশের জুয়াড়িরাও ডিজিটাল জুয়ার আসরে মেতে উঠেছে। আরব আমিরাতে আয়োজিত আইপিএলকে টার্গেট করেই এখন চলছে ডিজিটাল জুয়া বা জুয়ার আসর।
×