ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

এক সময়ের জমিদার কন্যা আক্তারী বেগম প্রাণ নিয়ে শঙ্কায়

প্রকাশিত: ২৩:১০, ৩০ আগস্ট ২০২০

এক সময়ের জমিদার কন্যা আক্তারী বেগম প্রাণ নিয়ে শঙ্কায়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বগুড়ার এক সময়কার প্রতাপশালী জমিদার খান বাহাদুর মোতাহার হোসেন খানের ছোট মেয়ে জৌলস মহল আক্তারী বেগম এখন সাধারণ নারী। এক সময় জমিদার কন্যা হিসেবে সম্মান পেলেও কালের আবর্তে তা আর নেই। চোখের সামনেই সেই যশ খ্যাতি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সমাজের আর দশটা নারীর মতোই এখন চলাফেরা করতে হয় তাকে। বসবাস করেন ঢাকার খিলগাঁওয়ের একটি বাড়িতে। আশপাশের অনেকেই জানেন না তিনি এক সময়কার প্রতাপশালী জমিদার কন্যা। এ নিয়ে কোন আফসোসও নেই তার। তবে মনে আতঙ্ক কাজ করে। সহায় সম্পত্তির জন্য ভূমিদস্যুরা হয়ত একদিন তার প্রাণটাই কেড়ে নেবে। সেই ভয়ে তিনি শঙ্কিত। এজন্য পরিচয় গোপন রেখে সাধারণভাবেই চলাফেরা করেন। তাতেও স্বস্তি নেই। জানা শোনা লোকজন তার ওপর নজর রাখে। ইতিপূর্বে কয়েকবার গাড়ি চাপা দিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সহায়তা চেয়েও তেমন কোন সাড়া মেলেনি। ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসায় বসে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বগুড়া জেলার দুপচাচিয়া উপজেলার গুনাহার ইউনিয়নের জমিদার মরহুম খান বাহাদুর মোতাহার হোসেন খানের ছোট মেয়ে জৌলস মহল আক্তারী বেগম (৭২)। বলছিলেন, আমার মায়ের নাম জয়নাব বানু রাবেয়া খানম। আমরা পাঁচ বোন। এক ভাই। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে তৎকালীন ভারতের মুর্শিদাবাদের জমিদার বাড়িতে। পরে আরও এক বোনের বিয়ে হয় মুর্শিদাবাদের জমিদারদের এক আত্মীয়র কাছে। বিয়ের মধ্যস্থতাকারী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। আমরা তিন বোন জীবিত আছি। বাকিরা মারা গেছেন। আমি সবার ছোট। আমার বড় বোনদের যখন বিয়ে হয় তখন জমিদারি প্রথা ছিল। ১৯৬২ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর আস্তে আস্তে সব জৌলুস হারাতে থাকে। এক সময় লোকে জমিদার কন্যা বলত। এখনও জমিদার কন্যাই আছি। তবে সেই জৌলুস আর নেই। কত সুনাম আর সম্মান ছিল আমাদের। জমিদার কন্যা বলে কত মানুষ সম্মান করত। কালের আবর্তে তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তারপরেও চোখ বন্ধ করলে সেইসব দিনের কথা ভেসে ওঠে। হাতি ঘোড়া পাইক পেয়াদা কিছুই নেই আর। এখন আমি সাধারণ নারী। সমাজের অন্য আট দশটা নারীর মতোই আমি। সেসব দিনের কথা মনে পড়ে। আমি ১৯৭৩ সালে বিএ পাস করি। তার কিছুদিন আগেই আমার বিয়ে হয়। ইচ্ছে ছিল এম এ পাস করব। বিলেতে গিয়ে আইনের ওপর পড়াশোনা করব। সে জন্য বইপত্র কিনে ছিলাম। বিয়ের পর তার আর কিছুই হলো না। আমার শ্বশুর বললেন, বউ যদি আরও পড়াশোনা করে তাহলে তিনি আর আমার মুখ দেখবেন না। এমনকি আমার স্বামীর মুখও না। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিলাম। আমার স্বামী ডাঃ মোঃ আব্দুল মজিদ। ধুমধাম করে বিয়ে হয়। ১৯৭৭ সালে আমার স্বামী লিবিয়া সরকারের অধীনে সেদেশে যান। এরপর স্বামীর ভালবাসার টানে আর এদেশে থাকতে পারিনি। দশ বছর পর ১৯৮৭ সালে স্বামীর কর্মস্থল লিবিয়া চলে যাই। প্রবাসে বসবাসের সময় আমাদের সহায় সম্পত্তি আমার শ^শুর মরহুম মহির উদ্দিন আহমেদ বগুড়ার দুপচাপিয়ার আমঝুপি এলাকার মৃত কোরবান আলীর ছেলে সোলায়মান আলীকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। আমি ২০০৪ সালে দেশে ফিরে আসি। এসে দেখি কিছুই নেই। সেই জমিদার বাড়িও নেই। সবই প্রায় বেদখল হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িটি রাজ বাড়ি, জমিদার বাড়ি ও খান বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। একেক জন একেক নামে বাড়িটির পরিচয় দিতেন। আমাদের পরিবারের কিছু লোকজন আর যাদের বিশ^াস করে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে ছিলাম, তারাই দখল করে নিয়েছে। এমনকি তারা অনেক জমি বিক্রি করে দিয়েছে। হালনাগাদ হিসেব অনুযায়ী ৮৬ বিঘা জমি বেদখল হয়ে গেছে। আমার তিন ছেলে এক মেয়ে। দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। এক ছেলে ও এক মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী। লিবিয়ায় গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর ২০১১ সাল থেকে আমার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমি লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করি। দূতাবাসের তখনকার ফার্স্ট সেক্রেটারি কিবরিয়া সাহেব জানান, তার স্বামীর কোন হদিস মিলছে না। অনেক দিন পর দূতাবাসের তরফ থেকে আমার স্বামীর হদিস মিলেছে বলে জানায়। এরপর ৩/৪ বার টেলিফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়। গত প্রায় ছয় বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে আমি আর কোন যোগাযোগ করতে পারছি না। তিনি কোথায় আছেন নাকি নেই তাও অজানা। সেই থেকে আমি একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। আগে মনকে স্বামী বিদেশে আছে বলে সান্ত¡না দিতে পারতাম। এখন আর সেই সান্ত¡নাটুকুও দিতে পারছি না। সরকারের কাছে আমি আমার স্বামীর সন্ধান দিতে অনুরোধ করছি। বলছিলেন, অনেকবার ছেলে-মেয়েরা আমেরিকায় চলে যেতে বলেছে। কিন্তু জীবনের শেষ বেলায় এসে আর মন চায় না। যে দেশে জন্ম নিলাম বড় হলাম। বিয়ে হলো সংসার হলো, সেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছে না। তাই আর যাওয়া হয়নি। জীবনের কত স্মৃতি এই দেশে। কত সুঃখ-দুঃখ হাসি-কান্না মাখানো সেই জীবন। তাই জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত এই দেশে থেকেই সাধারণ মানুষ হয়ে হলেও মরে যেতে চাই। নাই বা জানল কেউ, আমি জমিদার কন্যা। তাতে কোন দুঃখ নেই। তবুও মনের মধ্যে একটা সুখ অনুভব করি। মাঝে মধ্যে বগুড়ায় যাই। পিতৃগৃহে স্বামীর গৃহে গেলে চোখের পানিতে বুক ভেসে যায়। অনেকেই আমাকে দেখতে আসেন। অনেকে আগের মতো সম্মানও করেন। আবার অনেকে দেখে অবাক হন। এক সময়কার প্রতাপশালী জমিদারের কন্যা এখন সাধারণ নারী। আমিও তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশি। ভাল লাগে। অনেকে আদর যতœও করেন। জীবনের শেষ বেলায় এসে দাঁড়িয়েছি। বগুড়ায় গেলে ভালও যেমন লাগে, তেমনই একটি অজানা আতঙ্ক কাজ করে। ভূমিদস্যুরা আমাকে নানাভাবে হয়রানি করে। যাতে আমি বগুড়ায় না যাই। আমি বগুড়ায় গেলে এমনকি ঢাকাতেও নিরাপত্তাহীন অনুভব করি। ইতিপূর্বে বগুড়ায় তিন বার এবং ঢাকা একবার আমাকে বহনকারী গাড়িটিকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকায় বিশ^ রোডের কাছে গাড়ি চাপা দিয়েছিল। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছি। গাড়িটি সোজা রাস্তা থেকে ঢালুতে নামিয়ে দেয়ার কারণে প্রাণে রক্ষা পাই। সেই থেকে সারাক্ষণ মনে একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করে। তাই খুব একটা বাসার বাইরে যাই না। মানুষকে আমার পরিচয়ও দেই না। বগুড়া ও ঢাকায় একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হয়েছি, তেমন কোন সাড়া মেলেনি। শুধু বলে, যান বিষয়টি দেখব। জীবনের শেষ বয়সে যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, আল্লাহর কাছে তাই সারাক্ষণ কান্নাকাটি করি। এ ব্যাপারে বগুড়ার জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ওই জমিদার কন্যা যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে পুলিশ সুপার বা দায়িত্বশীল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবর আবেদন করেন, সে ক্ষেত্রে তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা হবে।
×