নীল রঙের ছোট্ট পাখি। বুক-পেটে কমলা রং। কিন্তু লাল ঠোঁটটা বেশ বড়। ঝিম ধরে বসে থাকে পানির কাছাকাছি কোন গাছে। কিংবা খুঁটিতে। ঠিক ধরেছ, পাখিটির নাম মাছরাঙা।
পাখিটির সঙ্গে ভাব হয় মননের। মাছরাঙা বসে থাকে মাছ ধরার জন্য। মনন বসে থাকে তা দেখার জন্য। মননদের বাসা মান্ডার ঝিলপাড়ে। দুই তলার বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে মনন। আর ভাব জমায় মাছরাঙার সঙ্গে।
- মাছরাঙা পাখি, মাছরাঙা পাখি, তুমি কি মাছ ধরে খাও? কে মাছ রেঁধে দেয় তোমাকে? তোমার আম্মু আছে? মাছের কাঁটা বেছে দেয় কে? তুমি কি একা একা পানি খেতে পারো?
মাছরাঙা কোন জবাব দেয় না। থির হয়ে সে বসে থাকে। তার চোখ কেবলই পানিতে। মন খারাপ হয়ে যায় মননের। আবারো উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকে সে।
- মাছরাঙা পাখি, আমি না একা একা ভাত খেতে পারি। গ্লাসে করে পানি খেতে পারি। জুতা পরতে পারি। গোসল করতে পারি। আমার ঘর গুছিয়ে রাখতে পারি। আমি আরও অনেক কিছু পারি। যেমন কাগজ নিয়ে নৌকা বানাতে পারি। এরোপ্লেন বানাতে পারি। ছোট মামা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। আরও কি পারি জানো? ছড়া বলতে পারি আমি। তোমাকে একটা ছড়া শোনাই-
ছোট্ট পাখি নীল সে
বেড়ায় চষে ঝিল সে
ঝিলে তো নেই মাছ আর
উপায় তো নেই বাঁচার।
জল থৈ থৈ মাছের খেলা
কোথায় গেল হারিয়ে
নোংরা পানি বিষে ভরা
মাছকে দিল তাড়িয়ে।
মননের কথায় একটুও মনোযোগ নেই মাছরাঙার। একা একা বকবক করতে আর কত ভাল লাগে? রাগে গাল ফুলে ওঠে তার। জানালা ছেড়ে এসে খাটে শুয়ে পড়ে। পাখিটার খুব অহঙ্কার হয়েছে। সুন্দর পাখি তো, এ জন্য। রাগে হাত ঘষতে থাকে মনন। একটু পরেই তার কান্না পেয়ে বসে। চোখ ভিজে ছলছল করে ওঠে। ঝাপসা চোখে সে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। দূর আকাশে কয়েকটা চিল উড়ছে। হঠাৎ ঝাপসা চোখেই সে দেখতে পায় মাছরাঙা পাখিটি তার জানালার গ্রিলে এসে বসেছে। চোখে হাতের ডলা দিয়ে পানি মোছে মনন। পাখিটা কথা বলে ওঠে।
- কি ব্যাপার বন্ধু, তুমি কান্না করছ কেন? আমার ওপর খুব রাগ হয়েছে তোমার তাই না? তুমি যে আমাকে ডেকেছ, আমি ঠিক শুনেছি। কিন্তু জবাব দেয়া সম্ভব হয়নি।
- কেন দিতে পারোনি? আমি একাই শুধু বকবক করে গেলাম। একা একা কথা বলতে কি ভাল লাগে?
- কেন জবাব দিতে পারিনি জানো? আমি মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমার চোখ শুধু মাছের দিকেই ছিল। অন্যকিছু কানে নিলেই মাছ হারিয়ে যেত। এটাকেই বলে একাগ্রতা। মনযোগ। তোমার আম্মু যেমন তোমাকে কতকিছু শিখিয়েছে। আমার আম্মুও আমাকে মাছ ধরার কৌশল শিখিয়েছে। শুধু মাছ ধরা কেন? যে কোন কাজেই একাগ্রতা, মনোযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন তুমি যখন খেলবে, খেলাতেই মনযোগ দিতে হবে। তুমি যখন খাবে তখন, কিন্তু খেলায় মন দিলে চলবে না। যথন যে কাজ তখন সেই কাজে মন।
- হুম বুঝলাম।
- তবে তুমি যে ছড়াটা বলেছো, ওটা আবার বলো তো।
মনন আবারো তার ছোট মামার লেখা ছড়াটা বলে। মাছরাঙা মনোযোগ দিয়ে শোনে।
- তুমি ছড়ায় ছড়ায় ঠিকই বলেছো বন্ধু। এই ঝিলে মাছ নেই বললেই চলে। এই বর্ষাকালে দুই-একটা পাওয়া যায়। আর মাছ থাকবেই বা কী করে? চারদিক থেকে পচা পানি এসে ঢুকছে এখানে।
সেদিনের মতো বিদায় নেয় মাছরাঙা। ওদিকে খাবার রেডি করে ডাকছে মা। দৌড়ে সেদিকে যায় মনন।
আরেকদিন সকালের ঘটনা। স্কুল বন্ধ। ওহ, তোমাদের জানানো হয়নি। মনন এবারই প্রথম স্কুুলে ভর্তি হয়েছে। নার্সারিতে। তো, সেদিন ছুটির দিন জানালায় দাঁড়িয়েছিল মনন। এক পশলা বৃষ্টির পর মিষ্টি রোদে চকচক করছে চারদিক। মাছরাঙা পাখিও এক মনে পানির দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ ঝিলের পাড়ে একটা দুষ্টু ছেলের দেখা পেল মনন। ছেলেটার হাতে গুলতি। মনন ছোট মামার কাছ থেকে জেনেছে, ওটা দিয়ে পাখি মারা হয়। বুক কেঁপে ওঠে মননের। মাছরাঙা পাখিকে মারবে না তো সে? ছেলেটা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। এরপর একটা গাছের গোড়ায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। পকেট থেকে কাচের মার্বেল বের করে গুলতিতে ভরায়। এরপর মার্বেলসহ গুলতির রাবার পেছনে টানতে থাকে। আস্তে আস্তে। আর এক চোখ বন্ধ করে তাক করতে থাকে মাছরাঙার দিকে।
হঠাৎ নিজের বন্দুকের কথা মনে পড়ে যায় মননের। হোকনা সে খেলনা। প্লাস্টিকের গুলি তো ছোড়া যায়। দৌড়ে গিয়ে আলমিরা থেকে বন্দুক বের করে মনন। বন্দুকে গুলি ভরানোই ছিল। জানালার ফাঁক গলে বন্দুক তাক করে দুষ্টু ছেলেটার দিকে।
ফট্টাস... করে একটা শব্দ হলো। সেই শব্দে মাছরাঙা পাখিটি ফুড়–ত করে উড়ে অনেক দূরে চলে গেল। কিছুই বুঝতে পারল না দুষ্টু ছেলে টা। মাথায় হাত দিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।
মনন কোনমতে নিজের হাসিকে দমে রাখল। আর আড়াল থেকে ছেলেটার বোকা বোকা মুখ দেখে খুব মজা পেল।
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার