ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাম কমিয়েও কোন কোন খামারি গরু বিক্রি করতে পারছেন না অনলাইনে কেনাকাটা শুরু প্রতারণা ঠেকাতে যাচাই-বাছাই করে পশু কেনার পরামর্শ অনলাইন বিক্রেতাদের

কোরবানির হাটে ক্রেতা নেই

প্রকাশিত: ২২:১০, ২৫ জুলাই ২০২০

কোরবানির হাটে ক্রেতা নেই

কাওসার রহমান ॥ ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে খামার পর্যায়ে গরুর দামেও দরপতন ঘটছে। করোনা মহামারীর কারণে কোরবানি দাতার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় কোরবানির পশুর চাহিদাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে দাম কমিয়েও কোন কোন খামারি গরু বিক্রি করতে পারছেন না। আসন্ন ঈদ উল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন হাটে পশু উঠতে শুরু করেছে। হাটগুলোতে দেখা মিলছে প্রচুর গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার। তবে পশুর সমাগম বেশ হলেও ক্রেতার অভাব লক্ষ্য করা গেছে হাটগুলোতে। এ সময়টাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন হাটে বড় বড় ব্যাপারীরা গিয়ে ১০, ১৫ এমনকি ২০ ট্রাক পর্যন্ত পশু কিনে আনেন। কিন্তু গত কয়েকদিনে কোন হাটেই এ ধরনের কোন ক্রেতার খোঁজ মেলেনি। তাছাড়া স্থানীয় ক্রেতারও দেখা মিলছে না বলে জানাচ্ছেন ব্যাপারীরা। তারা বলছেন, হাটে কোন ক্রেতাই নেই বলতে গেলে। করোনাভাইরাসের কারণে গরুর হাটে যেতে অনেকের অনীহা রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরে যাতে কোন ধরনের পশুর হাট বসানো না হয়- সেজন্য জোরালো পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠিত। বয়স্ক, শিশু ও অসুস্থদের হাটে না যাওয়ার জন্যেও পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছে অনলাইন শপ। কিন্তু প্রতারণা নানা কাহিনীর কারণে এসব অনলাইনের ওপরও আস্থা রাখতে পারছেন না ক্রেতারা। আবার দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি মন্থর হয়ে পড়ায় দেশের মানুষের আয়ও কমে গেছে। আবার ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে ঢাকার অনেক ফ্ল্যাটেই গরু রাখা ও কোরবানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে এ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা আশঙ্কাজনক হ্রাস পেয়েছে। এদিকে, আস্থা অনাস্থার মধ্যেই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (মার্কেটপ্লেস), ই-কমার্স সাইট, ওয়েবসাইট, ফেসবুকভিত্তিক সাইটগুলোতে এরইমধ্যে কোরবানির পশুর বুকিং ও বিক্রি শুরু হয়েছে। দেশের ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও ক্রেতারা কোরবানির পশুর বুকিং দিতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের এক বা দু’দিন আগে ক্রেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে কোরবানির পশু পৌঁছে দেবে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে অনলাইনে বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি এবার সরকারও এগিয়ে এসেছে। রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশে বসিয়েছে ডিজিটাল হাট। ‘ফুড ফর নেশন’ ও ‘একশপ’-এর মাধ্যমে এবার সরকারীভাবে কোরবানি পশু বিক্রি করা হচ্ছে। বিভাগীয় কমিশনার, অনেক জেলার জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এবার স্থানীয়ভাবেও অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য তৈরি করা হয়েছে ওয়েবসাইট, এ্যাপস ইত্যাদি। অন্যদিকে ফেসবুকনির্ভর পেজ তো আছেই। এ বিষয়ে আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘আমরা (আইসিটি বিভাগ) এটুআই, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও ই-ক্যাবের সহযোগিতায় অনলাইন পশুর হাট ‘ডিজিটাল পশুর হাট’ চালু করেছি। ভাল সাড়াও মিলেছে। দেশব্যাপী চালু করা আমাদের ফুড ফর নেশন সাইটের মাধ্যমে কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে চার হাজারের বেশি গরু বিক্রি হয়েছে। আরও চার হাজার গরু সাইটে নিবন্ধিত হয়েছে। আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে (এটুআই) ‘একশপ’ এরই মধ্যে দুই হাজার গরু নিবন্ধিত হয়েছে। এখনও হাতে সময় আছে। কোরবানির আরও পশু এ সাইটে নিবন্ধিত হবে।’ হাট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত যেখানে যেখানে হাট শুরু হয়েছে, সেখানে শুধু পশু বিক্রেতারাই উঠছেন। হাজার হাজার পশু উঠছে হাটে, কিন্তু ক্রেতা নেই। ব্যাপারী-খামারি সবাই এক সুরেই বলছেন, ‘এবার লাভ চাই না, চালান নিয়ে ঘরে যেতে পারলেই বাঁচি।’ সংবাদদাতারা জানান, ঢাকার বাইরের কোন হাটই এখন পর্যন্ত জমেনি। কোরবানির হাটগুলোতে পশু আমদানি থাকলেও ক্রেতার উপস্থিতি নেই। পাবনা সদরের আরিফপুর হাজিরহাট, টেবুনিয়া, পুষ্পপাড়া, ঈশ্বরদীর আওতাপাড়া, অরনকোলা, বেড়ার চতুর হাট, কাশিনাথপুর, চাটমোহরের রেলবাজার, ভাঙ্গুড়ার শরৎনগরসহ বিভিন্ন হাটে দেখা গেছে, নানা দামের নানা রঙের কোরবানির পশু উঠেছে। কিন্তু বিক্রেতারা ক্রেতা সঙ্কটে দিশেহারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাটে অবস্থানের পর বিক্রি না হওয়ায় পশু নিয়ে আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। সুজানগরের সাতবাড়িয়া পদ্মাপাড়ের আশু শিকদার জানান, প্রতিবারই তিনি দুটি করে গরু লালন-পালন করেন। ঈদের আগে বাইরের ব্যাপারী এসে কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু এবার করোনার কারণে বাইরের ব্যাপারী না আসায় তিনি গরু দুটি নিয়ে বিপাকে আছেন। হাজিরহাটের বাদশা মিয়া বলেন, বাড়িতে ১৫টি করে গরু পালন করে কোরবানির সময় বিক্রি করি। কিন্তু এবার বাড়িতে কোন ক্রেতা না যাওয়ায় হাটে এনেছি। কিন্তু লোকই নেই, গরুর দাম বলবে কে? মেহেরপুরের খামারি মহির উদ্দিন বলেন, ‘করোনার আগে যে গরুর দাম ব্যাপারীরা তিন লাখ টাকা বলেছেন, এখন সেই গরুর দুই লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারছি না। গরুর দাম কমে যাওয়ায় আমার মতো অনেকেই চরম বিপাকে পড়েছেন।’ প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের খামারি কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘করোনার আগে আমরা একটি গরুর দাম ব্যাপারীরা ৬৫ হাজার টাকা বলেছিলেন। কোরবানির ঈদের আগে আরও বেশি দাম পাওয়া যাবে, এই আশায় তখন বিক্রি করিনি। এখন সেই গরু ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।’ গত কয়েক বছর ধরেই কোরবানির পশু কেনাবেচায় যুক্ত হয়েছে অনলাইন হাট। এবারও ফেসবুক পেজসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কোরবানির পশু বেচাকেনার বিষয়টি নতুন করে সামনে এলেও সেটার সেবা প্রান্তিকে পৌঁছাতে পারছে না। সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে অনেকেই অনলাইনে ছবি পোস্ট করে এমনকি লাইভ ভিডিও দেখিয়ে কোরবানির পশু বেচাকেনা শুরু করেছে। এরইমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পশুর হাট বসবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ‘ডিজিটাল হাট’ নামের এই প্লাটফর্মের সঙ্গে রয়েছে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম এ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু কোরবানির পশু অনলাইনে কেনার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা কতটুকু এ নিয়ে গ্রাহকদের প্রশ্ন রয়েছে। এমনিতেই দেশজুড়ে প্রতারণা এখন শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। সরকার অবশ্য এখন বড় বড় প্রতারকদের ধর-পাকড় করছে। তাছাড়া অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণাও এখন নিয়মিত ব্যাপার। এক পণ্য দেখিয়ে নিম্ন মানের পণ্য দেয়া, পণ্যের বদলে অন্য কিছু দেয়া, পণ্যের দাম বেশি নেয়া- এগুলো নিয়ে হরহামেশাই অভিযোগ আসছে। এই অবস্থায় কোন আস্থায় ক্রেতারা অনলাইনে গরু কিনতে যাবেন? করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এ বছর বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কায় আছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা। সারাবছর কসাই খানায় গরু বিক্রির সুযোগ থাকলেও ক্ষুদ্র খামারিদের লক্ষ্য থাকে কোরবানির হাটে বেশি লাভে পশু বিক্রি করার। বিশেষ করে যারা কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে একটি বা হাতে গোনা কয়েকটি গরু লালন পালন করছেন, তারা এ বছর আকর্ষণীয় দামে গরু বিক্রি করতে পারবেন কিনা, সেটা নিয়ে সংশয়ে আছেন। মানিকগঞ্জ জেলার ফোর্ডনগর গ্রামের বাসিন্দা আফরোজা আক্তার গত সাত মাস ধরে দুটি গরু লালন পালন করে আসছেন। গরু দুটি তিনি কিনেছিলেন ৭০ হাজার টাকায়। প্রতিমাসে এই গরুর পেছনে তার খরচ হয়েছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তিনি ভেবেছিলেন এবারের কোরবানির ঈদে ঢাকার পশুর হাটে ভাল দামে তার গরু দুটি বিক্রি করে লাভ তুলে নেবেন। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে লাভ তো দূরে থাক, এই গরু বিক্রি করে সারা বছরের খরচটাও তুলতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহে আছেন। তিনি বলছেন, আমার তো ইচ্ছা ছিল অন্তত দেড় লাখ টাকায় গরু দুটো বেচব। আগের বছরগুলায় এমন দামেই বিক্রি করেছি। কিন্তু করোনার কারণে এবারে ওই দাম পাব না। কিন্তু বিক্রি তো করতেই হবে। আরও এক বছর এই গরুর খাওয়া চালানো সম্ভব না। আবার ক্রেতারাও অনলাইনে পশু কেনার ব্যাপারে অভ্যস্ত নন। আবার অনলাইনে সঠিক দাম বলা হলেও, কয়েকটি অনলাইনে গরুর দাম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দাম অনেক বেশি। বড়জোর ৪০ হাজার টাকা হওয়ার মতো গরুর দাম লিখা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। ৬০ হাজার টাকার গরুর দাম লিখা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। এবার এমনিতেই গরুর দাম কম। ঢাকার বাইরে এখন মাইকিং করে ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করা হচ্ছে। এই অবস্থায় ক্রেতা কতটা বেশি দামে গরু কিনবেন সেটাও সামনে উঠে এসেছে অনলাইন শপিংয়ের ক্ষেত্রে। প্রতারণার কারণে এবার অবশ্য অনলাইনে কোরবানি পশু কেনা-বেচার ধরন পাল্টিয়েছে অনলাইন শপগুলো। তারা নিজেরা দায়িত্ব না নিয়ে খামারিদের সঙ্গে ক্রেতাদের সংযোগ করিয়ে দিচ্ছে। অনলাইন শপগুলো শুধু মধ্যস্থতা করছে। এক্ষেত্রে দায় দায়িত্ব ক্রেতা-বিক্রেতার। এক্ষেত্রে ক্রেতা ভিডিওতে গরু দেখেও কিনতে পারেন। তবে ভিডিওতে দেখা আর বাস্তবে দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আবার যে গরু দেখলেন বিক্রেতা যে সেই গরুই আপনার বাসায় পৌঁছে দেবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রতারণার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তারপরও কেউ কেউ অনলাইনে গরু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান মহসিনউজ্জামান খান বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বাইরে বের হওয়া কঠিন, নিরাপত্তার একটা ঝুঁকি আছে। গরুর হাটে যাওয়াও অসুবিধাজনক। তাই সবকিছু মিলে এবার অনলাইনে গরু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরেকজন সম্ভাব্য ক্রেতা ব্যবসায়ী ইব্রাহিম মুন্সী বলেছেন, এই বছর গরুর হাটে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এমনিতেই তো সেখানে অনেক ভিড় হয়, বৃষ্টিবাদলে কাঁদাও হয়। তাই এবার অনলাইনে গরু কেনার কথা ভাবছি। তবে এখনও যাচাই-বাছাই করছি। কয়েকদিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেব। আবার অনেক পরিচিত খামারিই দায়িত্ব নিচ্ছেন ক্রেতার নামে গরু কোরবানি দিয়ে বাসায় মাংস পৌঁছে দেয়ার। মধুপুরের এক খামারি প্রতিকেজি গরুর মাংসের দাম ৩৬০ টাকা ধরে গরুর দাম নির্ধারণ করছেন। তার ওপর গরু জবাই ও গোস্ত তৈরি বাবদ একটি চার্জ ধরছেন এবং মাংস বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য আরেকটি চার্জ ধরছেন। এবার ঈদে এভাবেও কোরবানির আয়োজন চলছে। এটি অবশ্য পরিচিত খামারি ও আত্মীয় স্বজনের বেলায় ঘটছে। আবার অনলাইনে গরু কেনাকাটা নিয়ে ব্যাপক প্রচার দেখা গেলেও এ পদ্ধতিতে কোরবানির পশু বেচাকেনার বিষয়ে একেবারেই পরিচিত নন প্রান্তিক খামারিরা। এমন অবস্থায় ওই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যারা কাজ করেন, তারা চেষ্টা করছেন ক্ষুদ্র খামারিদের বোঝাতে কিভাবে তারা হাটে না গিয়েই পশু বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব থাকায় তারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও ভরসা করতে পারছেন না। এমনই এক অনলাইনে গরু বেচাকেনা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী টিটো রহমান বলেন, ‘আমরা যখন মাঠপর্যায়ের কৃষকদের বলি হাটে না গিয়ে ঘরে বসেই গরু বিক্রি করতে পারবেন, ওরা হাসাহাসি করে, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। তাদের কথা হলো, এটা কিভাবে সম্ভব? আবার হাটে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেশিরভাগ মানুষ বের হয়ে না আসায় অনলাইনে পশু বিক্রি করতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ হাটে গিয়ে দশটা গরু নেড়ে চেড়ে একটা গরু কিনতে চায়। অনলাইনে পশুর বিস্তারিত সব তথ্য দেয়া সত্ত্বেও ন্যায্য দাম রাখা সত্ত্বেও কেউ সেভাবে কিনতে আসছে না। চলমান পরিস্থিতিতে অনেক মানুষের আয় কমে যাওয়ায় কোরবানির পশুর চাহিদাও আগের চাইতে কমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। অনেকে আবার স্বাস্থ্যবিধির কারণে পশু কেনা থেকে বিরত থাকবেন। সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র খামারিরা এবার সমস্যায় পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলছেন, বেশিরভাগ খামারি যেন ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেন, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, ক্ষুদ্র খামারিরা যেন তাদের বাড়িতে বসেই অনলাইনে পশু বিক্রি করতে পারে। আমরা সেটাই চেষ্টা করছি। মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার। যেটা কখনোই তাদের ফেরত দিতে হবে না। অনলাইনে গরু বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানাচ্ছে, প্রথমেই বিক্রেতার সঙ্গে ভাল করে আলাপ করে বুঝে নেয়া উচিত, তারা ভাল অফার দিচ্ছে কিনা। বিক্রেতার কাছ থেকে গরুর ছবি বেশি করে চেয়ে নিয়ে ভাল করে যাচাই করতে হবে, প্রয়োজনে ভিডিও কল করে দেখা যেতে পারে। আরও ভালভাবে দেখার জন্য সরাসরি বিক্রেতার সঙ্গে দেখা করে বাস্তবে গরু যাচাই করা যেতে পারে। কোন বিক্রেতা যদি গরু স্পষ্ট করে দেখাতে না চান, তাহলে সেরকম বিক্রেতাদের কাছ থেকে গরু না কেনাই ভাল। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, গরুর দাম চূড়ান্ত করার আগে লোকাল হাট ও অনলাইন মার্কেট যাচাই করে দাম ঠিক করা উচিত। অতিরিক্ত কম দাম হলে যেমন সন্দেহজনক, তেমনি অতিরিক্ত দাম দিয়ে ঠকা থেকেও নিরাপদ থাকতে হবে। শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরেই দাম পরিশোধ করতে হবে। সবচেয়ে ভাল গরুটি হাতে পাওয়ার পর নগদে দাম পরিশোধ করা। তারা আরও বলছেন, ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে ক্রেতারা বিভিন্ন আকারের ও দামের গরুর ছবি দেখে প্রাথমিকভাবে পছন্দ করতে পারবেন। এরপর প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাবে। ক্রেতা চাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমেও গরুর ভিডিও দেখতে পারবেন এবং গরু পালনকারীর সঙ্গে কথাও বলতে পারবেন। পছন্দ হলে প্রথমে অর্ধেক টাকা পরিশোধ করতে হবে। ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে এই টাকা জমা করা যাবে। তাহলে গরুটি বুকিং হয়ে যাবে। ঈদের এক-দুইদিন আগে গরুটি সরবরাহ করা হবে। তখন নগদ বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বাকি টাকা পরিশোধ করতে হবে। অনলাইনে গরুর দাম অর্ধলক্ষ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। উল্লেখ্য, দেশের বিভিন্ন স্থানে খামারে গরু লালনপালন করা হচ্ছে। খামার মালিকদের কাছ থেকে গরু নিয়ে এসব অনলাইন প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করে। এ প্রসঙ্গে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান দেশী গরুবিডি ডটকমের প্রধান নির্বাহী টিটো রহমান বলেন, আমরা আসলে খামারিদের সঙ্গে ক্রেতাদের সমন্বয়ের কাজটি করছি। এতে একদিকে যেমন খামারিদের সহায়তা করা হচ্ছে, তেমনি ক্রেতারাও প্রচলিত হাটের ঝামেলা এড়িয়ে নিরাপদে গরু কিনতে পারছেন। এর আগে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গরু কেনার পর, প্রতিশ্রুতি মাফিক কাক্সিক্ষত গরু না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন কোন কোন গ্রাহক। এ প্রসঙ্গে টিটো রহমান বলেন, গরুর দাম পরিশোধ থেকে শুরু করে গরু সরবরাহ করা পর্যন্ত সবকিছুর দায়িত্ব আমাদের অনলাইন শপের থাকবে। খামারিদের কাছ থেকে আমরা গরু সংগ্রহ করলেও, পুরো দায়িত্ব থাকবে আমাদেরই। যদি গরুর কান বা লেজ কাটা থাকে, রং ঠিক না থাকে, তাহলে ক্রেতা গরুটি বদলে নিতে বা রিফান্ড নিতে পারবেন। তিনি বলেন, গরুটি সুস্থ আছে কিনা, ওয়েবসাইটটি কতটা নির্ভরযোগ্য, সরকার অনুমোদিত কিনা ইত্যাদি বিষয় দাম পরিশোধের আগেই যাচাই করে দেখা উচিত। সেজন্য দরকার হলে একটু সময় নিয়ে যাচাই-বাছাই করা ভাল। অনেক সময় ফেসবুকে অস্বাভাবিক কম দামের গরু বিক্রির অফার পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলোয় পা দিয়ে প্রতারিত না হওয়াই ভাল। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলছেন, ‘ডিজিটাল হাটে যেসব সদস্যরা অংশ নিয়েছে, তাদের দায়িত্ব আমাদের সংগঠন নিচ্ছে। কারণ এখানে সব জেনুইন খামার ও গরুই বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে। ফলে তাদের পেমেন্ট এবং ডেলিভারির গ্যারান্টি আমাদের এ্যাসোসিয়েশন নিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তার পরামর্শ হচ্ছে, শুধুমাত্র ফেসবুকভিত্তিক বা অপরিচিত ওয়েবসাইট থেকে গরু কেনার আগে ভাল করে যাচাই-বাছাই করে নেয়া উচিত। বিশেষ করে তারা যেন বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে গরু কেনেন। তিনি বলেন, কোন ওয়েবসাইট থেকে কেনার আগে সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে দেখা উচিত। প্রয়োজনে আগের ক্রেতাদের রিভিউ দেখা যেতে পারে। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কিনা সেটাও দেখা উচিত। আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলছেন, পেমেন্ট করার আগে শর্তগুলো ভাল করে দেখা উচিত, বুঝে নেয়া উচিত যে, তারা সুস্থ গরু পাবেন কিনা। কি শর্তে কীভাবে গরু সরবরাহ করা হবে, সেগুলো বিশেষভাবে বুঝে নেয়া উচিত। প্রয়োজনে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলে পরিষ্কার করে নিতে হবে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান গরু সরবরাহের ক্ষেত্রে আলাদা ডেলিভারি চার্জ ধরে থাকে। আগেই সে বিষয়ে কথা বলে নেয়া ভাল। কেনার সময়ের তুলনায় ডেলিভারির মধ্যে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধান থাকায় গরুর ওজনের কম বেশি হতে পারে। এসব বিষয়ে বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার করে নিতে হবে। তিনি বলেন, ই-ক্যাবভুক্ত কোন সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেক্ষেত্রে তাদের এ্যাসোসিয়েশন ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু ই-ক্যাবভুক্ত নয়, এ রকম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাদের করার কিছু থাকবে না।
×