ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইউএনওর স্বাক্ষর জালিয়াতি

কাজ না করেই এক কোটি ১২ লাখ টাকা তুলে নিল ঠিকাদার

প্রকাশিত: ১৯:৫৯, ২০ জুলাই ২০২০

কাজ না করেই এক কোটি ১২ লাখ টাকা তুলে নিল ঠিকাদার

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ১৯ জুলাই ॥ কোন ধরনের কাজ শুরুই করা হয়নি। অথচ কলাপাড়ায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ১০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ছয়টি ঘাটলা নির্মাণের বিল বাবদ এক কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার তিন শ’ পঁয়ত্রিশ টাকার বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার মেসার্স সারিকা ট্রেডার্স। ৭ এপ্রিল বিপুল অংকের সরকারী অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি গলাচিপা সোনালী ব্যাংকে তার হিসাব নম্বরে (চলতি- ৪৩১০২০০০০১৫০৫) এ টাকা হস্তান্তর হয়েছে। কলাপাড়া হিসাব রক্ষণ অফিসের ব্যয় বরাদ্দ বিলের ভাউচারের মাধ্যমে এ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যদিও বা সকল বিল ভাউচারের সাত নম্বর কলামে চেক ইস্যু করার জন্য আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প, কলাপাড়া উপজেলা, চলতি হিসাব নম্বর-৫০৭০৯০১০০১১৩৬, পূবালী ব্যাংক লিঃ কলাপাড়া শাখার কথা কম্পোজ করে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই লাইনটি কেটে মেসার্স সারিকা এন্টারপ্রাইজ গলাচিপা শাখা সোনালী ব্যাংক হাতে লিখে উপরোক্ত একাউন্টে সরাসরি সমুদয় টাকা স্থানান্তর হয়েছে। কেটে হাতের লেখার স্থানে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সিল স্বাক্ষর দেয়া রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প তেজগাঁও ঢাকার স্মারক নম্বর-০৩.০২.০০০০.৭০১.০২.০৯৬.১৯.১৩১৪ তারিখ ৩১ ডিসেম্বর-২০১৯ চিঠিতে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ ব্যয় নির্বাহের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। বিভিন্ন এলাকার মতো কলাপাড়ার খাজুরা, চালিতাবুনিয়া, গোড়া আমখোলা, ছোট বালিয়াতলী, ফতেপুর, লক্ষ্মীবাজার, নিশানবাড়িয়া, গামুরিবুনিয়া, নীলগঞ্জ ও নিজ শিববাড়িয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প একটি করে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রত্যেক কমিউনিটি সেন্টান ব্যয়-বরাদ্দ দেয়া হয় নয় লাখ ৮০ হাজার ১১৩ টাকা। এছাড়া নিশানবাড়িয়া ও গামুরি বুনিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুটি ঘাটলা নির্মাণে চার লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা। নীলগঞ্জ ও গোড়া আমখোলা পাড়া আশ্রয়নে দুটি ঘাটলা নির্মাণে চার লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা এবং খাজুরা ও ফাসিপাড়া দুটি ঘাটলা নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয় চার লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা। বাস্তবে এ ১০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ছয়টি ঘাটলার কোনটির কাজ শুরু পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ ১০টি কমিউনিটি সেন্টার এবং ছয়টি ঘাটলা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে সমুদয় বিল বাবদ এক কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার তিন শ’ পঁয়ত্রিশ টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সারিকা এন্টারপ্রাইজ তুলে নেয়। এসব বিলে মার্চ মাসের ২২ তারিখে বদলি হওয়া কলাপাড়ার ইউএনও মোঃ মুনিবুর রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তপন কুমার ঘোষের স্বাক্ষরও রয়েছে। ইউএনও মুনিবুর রহমান জানান, আমার যেসব সই দেখান আছে তা জাল। কারণ আমার কলাপাড়ার চাকরিকালীন সই-স্বাক্ষর অফিসে রক্ষিত রয়েছে। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কোন চিঠিপত্র তিনি কলাপাড়ায় থাকাকালীন রিসিভ বরেননি। কাজকর্ম তো দূরের কথা। এ ধরনের কোন ফাইল চালু তথা এ প্রকল্পের কোন ব্যাংক হিসাব পর্যন্ত খোলা হয়নি। তার সকল স্বাক্ষর জাল করে হিসাব রক্ষণ অফিসে বিল দাখিল করা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে এখন কলাপাড়ায় তোলপাড় চলছে। চম্পাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিন্টু তালুকদার এবং লতাচাপলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা জানান, তার ইউনিয়নে কমিউনিটি সেন্টার ও ঘাটলার কাজ করার জন্য কোন বরাদ্দ আছে তাও জানা নেই। এ ধরনের কোন কাজ করা হয়নি। অপরদিকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে যেসব চিঠি ইস্যু করা হয়েছে তার সব মেমো উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের। কবে টেন্ডার দেয়া হয়েছে, কিভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে এবং একইদিনে ব্যাংক হিসাব ব্যতিরেকে বিলের সমুদয় টাকা ঠিকাদারের হিসেবে সরাসরি গেল এ প্রসঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তপন কুমার ঘোষ জানান, তিনিও বিষয়টি জেনে অবাক হয়েছেন। ওই ফাইলটিও তার অফিসে নেই বলে জানান। তার সই-স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। কলাপাড়ার বর্তমান ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক শনিবার জানান, বিষয়টি জেনে আমি মাঠপর্যায়ে গিয়ে নিশ্চিত হয়েছি। ১০টি কমিউনিটি সেন্টার এবং ছয়টি ঘাটলা নির্মাণের কোন কাজ করা হয়নি। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় পূবালী ব্যাংকের হিসাব খোলার বিষয়টিও একটি অনিয়মের মধ্য দিয়ে করা হয়েছে। যেখানে যৌথ হিসাব সেখানে শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সই থাকলেও ইউএনওর সই নেই। অথচ ওই একাউন্টে সরকারী টাকা জমা হয়েছে। সারিকা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী, ঠিকাদার মোঃ শামীম জানান, আমাকে কলাপাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস থেকে ফোন করে বিল রেডি করার কথা বলা হয়েছে। আমি গিয়ে টাকা তুলেছি। তবে করোনার কারণে কোন কাজ করতে পারেননি। পরে করে দিবেন বলেও জানান। কলাপাড়া হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের অডিটর মংখেলা জানান, তারা সঠিকভাবে কাজ করেছেন। অনিয়ম করেননি। ঠিকাদারকে তাদের চেনার কথা নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
×