ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজেই স্বস্তি খোঁজে নিম্ন আয়ের মানুষ

অহর্নিশ যুদ্ধের জীবন, করোনার ভয় যেন বিলাসিতা!

প্রকাশিত: ২২:০২, ৫ জুলাই ২০২০

অহর্নিশ যুদ্ধের জীবন, করোনার ভয় যেন বিলাসিতা!

মোরসালিন মিজান ॥ করোনার ভয়ে সবাই ঘরে। কাজে বের হচ্ছেন যারা তারাও স্বস্তিতে নেই। বুক ধুকপুক করছে। নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে কর্মজীবী মানুষ। মুখে বেশি দাম দিয়ে কেনা ডাবল মাস্ক। চোখের ওপর সেফটি গ্লাস বসানো। হাতে পরা সার্জিক্যাল গ্লাভস। পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। পিপিই পরেও বের হচ্ছেন অনেকে। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বেলায় দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। সংক্রমণ বা সুরক্ষা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে একদমই যেন রাজি নন তারা। সে সময় নেই। বরং অঘোষিত লকডাউন তুলে নেয়ার পর আয় রোজগারের সুযোগ হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যস্ত তারা। সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহারেও আগ্রহ নেই। মাস্ক পরা, সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া তাদের কাছে বিলাসিতা! কারণও আছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন মানেই সংগ্রাম। এ সংগ্রাম কখনোই সহজ ছিল না। তবে এখন এই করোনার কালে টিকে থাকার সংগ্রামটা আরও কঠিন হয়েছে। নি¤œ আয়ের মানুষের মাঝে ভাইরাস সংক্রমণের কোন আশঙ্কা নেই- এমন নয়। তবে আরও বহু শঙ্কা নিয়ে প্রতিদিন পথ চলতে হয় তাদের। শত্রুর কোন শেষ নেই। ক্ষুধা দারিদ্র্যসহ অসংখ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া মানুষ করোনা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে রাজি নন। হকাররা ফুটপাথে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। জামা কাপড় বিক্রি করছেন কেউ। কেউ সবজি। ভ্যানে করে অনেকে মৌসুমি ফলমূল বিক্রি করছেন। ভবন নির্মাণ রাস্তা কাটাচেড়ার কাজও শুরু হয়ে গেছে। নির্মাণ শ্রমিকরা দিন রাত কাজ করছেন। দা বটি ধার করার লোকটিও ফিরে এসেছে। ছাই বিক্রি করে চলে যার, সেই নারী কণ্ঠটি কানে আসছে আবার। ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি থামতেই ‘ফুল নিবেন আপা’ বলে ছুটে আসছে পথশিশু। এই ভাগ্যবঞ্চিতদের কাছে কাজে ফিরতে পারাই বড় কথা। কাজ না থাকলে খাওয়াও নেই। এখন কাজ আছে। তিন বেলা তাই কিছু না কিছু পেটে পড়ছে। বারডেম হাসপাতাল সংলগ্ন ফুটপাথে ভ্যানে করে আম বিক্রি করছিল সোহাগ নামের এক কিশোর। ‘হাড়িভাঙ্গা’, ‘কড়া মিষ্টি’ ইত্যাদি বলে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু কণ্ঠে তেমন জোর নেই। অনভ্যস্ত শুনাচ্ছিল। কাছে গিয়ে কিছু সময় কথা বলতেই বের হয়ে এলো প্রকৃত সত্য। জানা গেল, ছেলেটি আসলে স্কুল পড়ুয়া। ক্লাস সেভেন। বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। মা বাসায় বসে সেলাই ও বুটিক বাটিকের কাজ করেন। তাই দিয়ে কোনরকমে চলছিল তিন সদস্যের পরিবার। কিন্তু করোনাকাল দীর্ঘ হওয়ায় মায়ের হাতে কোন কাজ নেই। থাকা খাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অগত্যা ফল বিক্রির কাজে নামতে বাধ্য হয় সোহাগ। কিশোরটি বলছিল, একটু একটু লজ্জা লাগে। তাই নিজের এলাকায় ভ্যান নিয়ে যাই না। অন্য এলাকায় বিক্রি করি। তবে বিক্রি করে সামান্য যে টাকা পাওয়া যাচ্ছে তাতেও সংসারের বড় উপকার হচ্ছে বলে জানায় সে। মার্কেট শপিংমলগুলোও খুলেছে। দোকানগুলোতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে বহু কর্মচারী। শাহবাগে অবস্থিত আজিজ সুপার মার্কেটে কয়েক শ’ দোকান। ফ্যাশন হাউস ‘কাপড়-ই বাংলা’র কর্ণধার বিথুন বলছিলেন, আমরা সরকারী নিদের্শনা মেনে দোকান খোলা রেখেছি। কাস্টমার একেবারেই কম। দোকান খুললে আমাদের প্রতিদিন যা খরচ হয় তাও উঠছে না। এরপরও দোকান খোলা রাখায় কর্মচারীদের কিছু উপকার হচ্ছে। তারা বেতন পাচ্ছে। দোকান বন্ধ থাকলে হয়ত এই বেতনটা তারা পেত না। শনিবার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে নির্মাণাধীন একটি ভবনে কাজ করছিলেন একদল শ্রমিক। তাদের দুজন ব্যস্ত ছিলেন বহুতল ভবনের বাইরের অংশে। রশি ধরে শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় গ্লাস বসানোর কাজ করছিলেন তারা। নেমে আসার পর মুর্শেদ নামের এক শ্রমিক বললেন, ‘নিজেই তো দেখলেন জীবনের রিস্ক নিয়া কাজ করতেছি। করোনা হইলেও তো বাঁচা যায়। এইখান থাইকা পরলে শেষ। তাইলে করোনারে ডরায়া লাভ কী?’ ইস্কাটনের ফুটপাথে একটি চায়ের দোকান চালান হাবিব। অনেকদিন দোকানটি বন্ধ ছিল। এখন বেশ জমজমাট। দিনে প্রায় ৬০০ কাপ চা বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বিক্রেতার মুখে কোন মাস্ক নেই। দুই ভ্যান চালক বসে চা পান করছিলেন। করোনা সুরক্ষা সামগ্রীর কথা তারা জানেন বটে। পাত্তা দিতে রাজি নন। কেন? উত্তরে বাশার নামক ভ্যানচালকটি যা বলেন তার মানে দাঁড়ায়, মাস্ক ব্যবহার, সাবান পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া তাদের কাছে বিলাসিতা। তিনি বলতে চাইলেন, আমরা তো অসুস্থ হলেও ভাল ডাক্তার দেখাতে পারি না। ওষুধ কিনে খেতে পারি না। ফার্মেসিতে গিয়ে রোগের কথা বললে এক সপ্তাহ খাওয়ার জন্য ট্যাবলেট দেয়। দুই তিন দিন খেয়ে বাদ দিতে হয়। কারণ পয়সা দিয়ে কুলাতে পারি না। আর এখন করোনা হবে এই ভয়ে খরচ করব? এখানেই শেষ নয়। সরকারী নির্দেশনায় বার বার বলা হচ্ছে, ঘরে থাকুন বলা হচ্ছে। কিন্তু এমন অগণিত মানুষ আছে যাদের কোন ঘর নেই। যার ঘর নেই তার ঘরে থাকা বিলাসিতা নয় আর কী!
×