ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার মধ্যে বন্যা মোকাবেলায় মানুষ হিমশিম

প্রকাশিত: ২২:০৭, ৪ জুলাই ২০২০

করোনার মধ্যে বন্যা মোকাবেলায় মানুষ হিমশিম

সমুদ্র হক ॥ বন্যা খরা শীত-নিত্যসঙ্গী উত্তরবঙ্গের মানুষের। প্রকৃতির এই তিন দুর্যোগে কাহিল মানুষ। এই কাহিলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের অতিমহামারী করোনার থাবা। এ যেন ডাঙায় বাঘের ভয়, জলে কুমিরের ভয়, বাতাসে করোনার ভয়। কোন দিকে সামলাবে মানুষ। এরই মধ্যে বর্ষার ভর মৌসুম শুরু না হতেই উজানের পাহাড়ী ঢল আর অতিবৃষ্টিতে সবগুলো নদ নদীর পানি বেড়েছে। নদী ভরে উঠছে। স্রোতের তোড়ে নদী তীরবর্তী এলাকা ও চরগ্রামের মানুষের এখন নাভিশ্বাস। নিজে বাঁচবে, পরিবারকে বাঁচাবে না ঘরবাড়ি বসতভিটা রক্ষা করবে, গবাদি পশুপাখিগুলোই বা যাবে কোথায়! ব্রহ্মপুত্র যমুনা তিস্তা ধরলা বাঙালী নদীর পানি নিত্যদিনই বেড়ে চলেছে সঙ্গে উত্তাল ঢেউ নিয়। এ যেন ভয়ঙ্কর ঢেউ। এই ঢেউয়ের তীব্রতায় মুহূর্তেই তীর ভেঙ্গে শুকনো ভূমি গিলে নদী প্রসারিত করে তার সীমানা। বসতভিটা জমি জিরাত সব চলে যায় নদীগর্ভে। ভাঙ্গন ও বন্যা দুইই এক সঙ্গে আঘাত করে। বন্যার এই থাবায় একজন গবেষক লিখেছেন ‘মানুষ ভাবে এত জল কেন এলি, জল বলে মানুষ তো আমার জায়গায় থাকার কথা নয়’। এভাবেই বর্ষায় নদী রুদ্ররূপ ধারণ করে। এই দৃশ্যগুলো নদী পাড়ের ও চর গ্রামের মানুষের অতি চেনা। ঈশান কোণে বর্ষার ঘন কালো মেঘ দেখেই বুঝতে পারে ঢেউ কতটা তীব্র হবে। নদীর পানি কতটা বেড়ে তাদের ঘর ছাড়া করার জন্য তেড়ে আসবে। এই সময়ে বগুড়ার যমুনা ও বাঙালী তীরবর্তী সারিয়াকান্দি সোনাতলা ও ধুনট এলাকায় চোখে পড়ে মানুষের দুর্দশা ও ভোগান্তির দৃশ্য। লোকজন ঘরের আসবাবপত্র, তোশক বালিশ, ঘর গেরস্তালির সকল জিনিস নৌকায় তুলে স্রোতের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে বৈঠা বেয়ে ছুটছে উঁচু শুকনো ভূমির সন্ধানে। তারপর কোন ভূমির সন্ধান পেলে তীরে নোঙর করে। প্রথমে আকাশের নিচে গাছতলায় আশ্রয় নেয়। লোকজন এখন আর তাদের বাধা দেয় না। তারা জানেই পানি নেমে গেলেই ফিরে যাবে। এর আগে তাদের সংগ্রহে রাখতে হয় ধান চাল। বিশুদ্ধ পানির সন্ধান করতে হয়। চুলা জ্বালানোর কাঠ খড়ি নানা কিছু। গৃহপালিত পশু পাখি রাখার ব্যবস্থা। এই সময়ে কাজের অভাব থাকে। দুর্দশা ও দুর্ভোগের ভাবনায় তারা কাহিল। তারওপর করোনার থাবার ভয় তো আছেই। কিছু হলে চিকিৎসা কোথায় নেবে। কেউ নদী ভাঙ্গনের থাবায় বসত ভিটা জমি জিরাত হারালে তারা চলে যায় নিকট দূরের কোন আত্নীয় ও পরিচিত ঠিকানায়। সেখানে ঘর তুলে বসতির মতো গড়ে তোলে। এভাবে বগুড়ার ধুনটের গোসাইবাড়ি ভান্ডারবাড়ি চিথুলিয়া এলাকায় যমুনা তীরের ভাঙ্গন কবলিত সারিয়াকান্দি এলাকার অনেক মানুষ আশ্রয় গড়েছে। কি ভাবে তারা আশ্রয় নিয়ে থাকে এই বিষয়ে ধুনটের চিথুলিয়া এলাকার সমাজসেবী জিয়া শাহীন জানালেন, তারা চরে বড় গৃহস্থের জমি বন্দোবস্ত নিয়ে প্রতি মাসে অথবা বছরে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ অথবা বর্গায় জমি চাষ করে ফসলের একটা অংশ তুলে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আশ্রয় হয় চরগ্রামে। এভাবে গৃহস্থের চরের জমিও দেখাশোনা করে আশ্রয় নিয়ে থাকে। একটা সময় পুরানো ঠিকানা মুছে ফেলে নতুন ঠিকানা যোগ হয়। তবে ভোটার তালিকায় নাম থাকে পুরানো ঠিকানায়। যমুনা কখনও ভাঙ্গনে কেড়ে নেয়া এলাকা চর বানিয়ে ফিরে দিলে ওই লোকেরা ফিরে গিয়ে নিজের ঠিকানা খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে। নদী এই অধ্যায়কে স্থানীয় কথায় বলা হয় ‘বোরাকোল’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পুরনো এলাকা দখল করে নেয় নব্য প্রভাবশালীরা। তখন কেউ সেখানে চাইলে প্রজা হতে হয়। বর্ষায় বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের এই খেলা নিরন্তর। উত্তরের নদী তীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙ্গনের থাবা থেকে মুক্ত করতে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বহু কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ড পয়েন্ট নির্মিত হয়। এর সঙ্গে দীর্ঘ রিভেটমেন্ট নির্মিত হয় বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে। এই শক্ত কাঠামো নির্মাণের পরও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙ্গন রোধ না হলে কয়েকটি বাঁধ নির্মিত হয়। এই বাঁধেও একসময় ধস নামে। নদীর ব্যাকফ্লো নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আরও কয়েকটি শক্ত কাঠামো ও রিভেটমেন্ট নির্মিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাগণ জানান, এইসব অবকাঠামো নির্মাণের পর যমুনার পশ্চিম তীরে বন্যা ও ভাঙ্গন আঘাত করে না। হার্ড পয়েন্টের ভিতরের পূর্বের এলাকায় বর্ষায় নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়। অতিরিক্ত পাহাড়ী ঢল ও অতি বৃষ্টিতে যমুনার পানি ফুলে ফেঁপে উঠলে বড় বন্যা হলে মানুষের দুর্ভোগ নেমে আসে। বন্যার শুরুতে ও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার এই দুই সময়ে ভাঙ্গন দেখা দেয়। গত ক’বছর ধরে বর্ষা মৌসুম ছাড়াও অসময়ে নদী ভাঙ্গনের প্রবণতা বেড়েছে। বর্ষার এই অবস্থায় নদী ড্রেজিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন পানি বিজ্ঞানীগণ। তারা বলছেন বঙ্গীয় এই বদ্বীপে হিমালয় থেকে নেমে আসা পলি জমে তৈরি হয়েছে একেটি বিশাল অংশ। যা এখনও নিচু। যে কারণে বলা হয় প্লাবনভূমি। বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টি ও হিমালয়ের বরফ গলে পানির ঢল নামলে নদী তা ধরে রাখতে পারে না। দুকূল ছাপিয়ে উপচে ওঠে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙ্গন ঠেকাতে ১৯৫৭ সাল থেকে নানা পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে বহু কোটি টাকা ব্যয়ে শক্ত কাঠামো নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সর্বশেষ সুদূরপ্রসারী ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান। যা ২১শ’ সাল পর্যন্ত পানি সম্পদ ব্যবহারের রূপরেখা। এই পরিকল্পনায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী ভাঙ্গন রোধে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে নদী ড্রেজিংয়ের ওপর।
×