ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত তৈরি থাকতে হবে

করোনা দ্বিতীয় পর্যায়েও মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে

প্রকাশিত: ২২:০৯, ৯ জুন ২০২০

করোনা দ্বিতীয় পর্যায়েও মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কোভিড-১৯ এর বিশ্বজোড়া মহামারীর মধ্যে অনেক দেশই লকডাউন শিথিল করেছে। কেউ কেউ পুরোপুরি করোনা মুক্ত বলেও দাবি করেছে। কিন্তু এমন দাবি খুব বেশি ফলপ্রসূ হওয়ার আশা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন ভাইরাসটি আবার ফিরে আসতে পারে। হতে পারে দ্বিতীয় পর্যায়ের মহামারী। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা ফিরে আসতে দেখা গেছে। সঙ্গত কারণে বিশ্লেষকরা মনে করছেন কার্যকর টিকা আবিষ্কারের আগে করোনা থেকে নিরাপদ নয় গোটা বিশ্ব। বিধি নিষেধ তুলে নিলে সংক্রমণের হার বাড়তেই থাকবে। তবে এজন্য বিকল্প কিছু পন্থা ভেবে রাখতে হবে। যা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নাওকো ইশিকাওয়ার বলেছেন, লকডাউন শিথিল করলে মানুষের মধ্যে স্বভাবতই সংক্রমণ বাড়বে। জনগণের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা নেই। কার্যকর এবং সবার হাতে পৌঁছানোর মতো টিকা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা সবাই ঝুঁকিতেই থাকব। উহানের সংক্রমণে চীন তার নিজের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি। তবে করোনায় সারা বিশ্বব্যাপী যে তান্ডবলীলা সে দিনের বিচারে করোনা সামাল দিতে চীনা সাফল্য মনে রাখার মতো। জানুয়ারির শুরু থেকে চীন ব্যাপকভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করার পর করোনার উৎপত্তিস্থল হুবেই এর উহান স্বাভাবিক হয়ে আসে মার্চের শেষ নাগাদ। এরপর করোনার জন্য নির্মিত হাসপাতালও বন্ধ করে দেয় চীন। কিন্তু গত ১১ মে এবং ২৭ মে চীনে ফের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সন্ধান মেলে। অর্থাৎ চীন করোনা মুক্ত হয়নি বলেই এই খবরে প্রমাণ মেলে। অর্থাৎ বিপত্তি থেকে বাঁচতে সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিলে আবারও মহামারী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। বিবিসি গত ১১ মে জানায়, ওইদিন ১৭ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে উহানের ছিল পাঁচজন আর দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় জিলিন প্রদেশের শুলান শহরে ১২ জনের দেহে করেনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে ২৭ মে’র খবরে বলা হয় আরও ৩৬ জনের দেহে তারা করোনা পেয়েছে। দ্বিতীয় দফায় করোনা সংক্রমণের এই চিত্র বলে দিচ্ছে করোনাকে নির্মূল করা খুব সহজসাধ্য কোন কাজ নয়। একজনও করোনা আক্রান্ত থাকলে সেখান থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। অথবা অন্যকোন উপায়েও করোনার সংক্রমণ হতে পারে। এবার চীনের এই চিত্র থেকে দেশের দিকে নজর দিলেও একই অবস্থা পাওয়া যায়। যেদিন করোনার জন্য সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় ওইদিন পর্যন্ত দেশে ৩৮ জন করোনা রোগী ছিল। সাধারণ ছুটি দিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার মধ্যে সংক্রমণ দৈনিক এক হাজার ৫০০ জনের মতো ছিল। এখন বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার পর তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ভয়ঙ্কর এই পরিস্থতির জন্য মানুষের সচেতনতাকে সব থেকে বড় করে দেখা হচ্ছে। মানুষ সচেতন হলেই কেবল এই ভারাস প্রতিরোধ সম্ভব। তবে ভাইরাসটির দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সংক্রমণ নিয়ে সারাবিশ্ব এখন শঙ্কিত। অতীতে যেসব মহামারী দেখা গেছে সেখানেও দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সংক্রমণ দেখা গেছে। চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় সেকেন্ড ওয়েভ বলতে মহামারী একবার কমে যাওয়ার পর আবার নতুন করে ছড়ানোকে বোঝায়। অতীতে মহামারীগুলোর ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গিয়েছিল। এশিয়াতে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন এলাকায় যেমন আবার করোনাভাইরাস ফিরে এসেছে। আবার কোথাও পুরো অঞ্চলে হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও আছে। তবে সেগুলো দ্বিতীয় পর্যায়ের মহামারী কিনা সেটা অনুমান করা কঠিন। শুধু চীন বা বাংলাদেশ নয় এই অভিজ্ঞতা এর মধ্যেই দেখা গেছে জাপানেও। জাপানের হোক্কাইডো অঞ্চলে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কঠোর লকডাউন ছিল। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা দিনে এক-দুটিতে কমে এসেছিল। ব্যবস্থাগুলো এত ভাল কাজ করেছিল যে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছিল এবং এপ্রিলের মধ্যে স্কুলগুলো আবার খুলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মে মাসে এসেই হোক্কাইডো সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়াতে আবার জরুরী অবস্থা জারি করতে হয়েছিল। দ্বীপটিতে আকস্মিকভাবে সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ দেখা দেয়। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে ব্রুনাই এর করোনাভাইরাস বিস্তারের অবস্থা যদি দেখা যায় সেখানে ১৩৮ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে দুজন মাত্র মারা গেছেন আর ১৩৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন অন্যদিকে একজন মাত্র এখন হাসপাতালে রয়েছেন। নিউজিল্যান্ড দাবি করেছে তারা করোনা নিয়ন্ত্রণ করেই ফিরেছে। আর ভিয়েতনামতো করোনা নিয়ন্ত্রণের সব থেকে বড় মহড়া দিয়েছে গ্যালারি ভরা দর্শক নিয়ে ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করে। কিন্তু এখানেও যে করোনাভাইরাস ফিরে আসবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের জীববিজ্ঞানী জেনিফার রন এক স্বাক্ষাতকারে বলেছেন করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় আসবে কিনা সেটা নিয়ে আর সংশয় নেই। তবে কখন আসবে আর তা কেমন ধ্বংসাত্মক হবে সেটাই দেখার বিষয়। একই বিষয়ে হুঁশিয়ার করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তারা বলছে ভাইরাসটি কখনও নির্মূল হবে না। হয়তো সাধারণ ফ্লুর মতো এটি আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। এটিকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ের যে ধাক্কা অর্থাৎ মহামারী সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভাইরাসটি মোকাবেলা করতে হবে। তবে অন্যান্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থার সঙ্গে ভাইরাসটির জন্য একটি কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কারের দিকেও নজর রাখা হচ্ছে। বিদেশ থেকে আগতদের কোয়ারেন্টাইনে রাখাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। আকস্মিকভাবে চীনের জিলিন এবং হেইলংজিয়াং প্রদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর দেখা গেল এসব নাগরিকরা রাশিয়া থেকে এসেছিলেন। এক পরীক্ষায় রাশিয়া থেকে আসা আটজন চীনা নাগরিকের মধ্যে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওই সময়ে রাশিয়া ভ্রমণ করা ৩০০ চীনাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। এটি একটি বড় শিক্ষা হতে পারে। আমাদের এখানে বিদেশ ফেরতদের গণহারে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলা হয়। হোম কোয়ারেনটাইনে থাকবে তারা। এরপর আর কোন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকতে এসব নাগরিকরা করোনা ছড়িয়ে বেড়িয়েছেন। শুধু পরীক্ষা এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করেই করোনা থামানো যাবে না দক্ষিণ কোরিয়া সংক্রমণের শুরুর দিকে প্রতিদিন ১০ হাজার পরীক্ষা বিনামূল্যে চালানোর ব্যবস্থা করেছিল। একইসঙ্গে এ্যাপস এবং জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে আক্রান্তদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছিল। ফলে নতুন প্রাদুর্ভাব দ্রুত নির্মূল করার কাঠামো তারা গড়ে তুলতে পেরেছিল। এটি কোরিয়ার করোনা নিয়ন্ত্রণে খুব কার্যকর ছিল। কয়েক সপ্তাহ নতুন কোন অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ না পাওয়ার পর ১২ মে নতুন একটি ক্লাস্টারের খোঁজ পাওয়া যায়। যারা রাজধানী শিউলের একটি নাইট ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্রুতই তাদের পৃথক করা সম্ভব হয়। এছাড়া একবারের পরিবর্তে দুবার পরীক্ষা করার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন একবার করোনা আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়। সঙ্গত কারণে স্বল্পমেয়াদে তিনি আর আক্রান্ত নাও হতে পারেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তিনি আক্রান্ত হবেন না এমনটি নিশ্চিত নয়। এ কারণে একবারের পরিবর্তে দুবার পরীক্ষা করা যেতে পারে। এছাড়াও খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো জনস্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়। সারাবিশ্বেই স্বাস্থ্য সেবার নাজুক অবস্থা দেখা গেছে। এর মধ্যে কেবল ব্যতিক্রম ছিল চীন। তবে সেখানেও শুরুর দিকে অতি সংক্রামক এই ভাইরাসে প্রাণ দিতে হয়েছে চিকিৎসকদের। সঙ্গত কারণে এমন একটি স্বাস্থ্য সেবাখাত গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে যা মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারে।
×