ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিনে দুবার লোনা পানিতে ডুবছে কয়রা

প্রকাশিত: ২১:১৮, ৩১ মে ২০২০

দিনে দুবার লোনা পানিতে ডুবছে কয়রা

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ সম্প্রতি আমফানের আঘাতে বিধ্বস্ত খুলনার উপকূলীয় উপজেলার কয়রার মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন দুবার জোয়ার-ভাটার লবণাক্ত পানির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের। এই উপজেলার অধিকাংশ এলাকার এ দৃশ্য এখন প্রতিদিনের। প্রয়োজনীয় খাবার নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁইও হারিয়েছে বহু মানুষ। এই দুরবস্থার মধ্যেও এলাকাবাসীর সুপেয় পানির সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। চারদিকে শুধু অথৈ পানি আর পানি, অথচ সুপেয় পানি নেই এক ফোঁটাও। পানির সঙ্গে বসবাস করে সুপেয় পানির জন্য ‘লড়াই’ করতে হচ্ছে কয়রা উপজেলার অন্তত ৪টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষকে। তাছাড়া ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা যাওয়া হাঁস-মুরগি, মাছ, পাখি ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর পচা দুর্গন্ধে এলাকার পরিবেশও দূষিত হয়ে উঠেছে। জানা যায়, আমফান ও জলোচ্ছ্বাসে খুলনার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কয়রা উপজেলার। জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এই উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের ৫২টি গ্রাম প্লাবিত হয়। অন্য তিনটি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও এলাকার কয়েক হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। অসংখ্য বাড়িঘর, এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত হয়। ‘আমফান’ কয়েকদিন আগে চলে গেলেও রেখে গেছে এর রেশ। ঘূর্ণিঝড় আইলার ক্ষত এই এলাকার জনগণকে কয়েক বছর ধরে ভোগাচ্ছিল। এর মধ্যে আমফানের আঘাতে এই উপজেলাকে আর এক বার তছনছ করে দিয়ে গেল। এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সঙ্কট হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত সমগ্র এলাকাই প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি নেই। বাঁধ ভেঙ্গে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় এলাকার সুপেয় পানির সকল উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আমফান ও বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে জলোচ্ছ্বসের কারণে কয়রায় তাদের ৯০০ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে কয়রা সদরে দুটি ভ্রাম্যমাণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এ প্ল্যান্টের মাধ্যমে পানিকে সুপেয় করা হচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় একটি প্ল্যান্ট থেকে ২ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। পিরোজপুরে জোয়ার-ভাটার খেলা নিজস্ব সংবাদদাতা পিরোজপুর থেকে জানান, আমফানের আঘাত এখনও সামলে উঠতে পারেনি দুটি উপজেলার নদীর পাড়ের মানুষেরা। আমফানের পর থেকে জোয়ারের সময় ভাঙ্গা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে ভাটার সময় বের হয়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে উঁচু জোয়ার আর বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্দশার শেষ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার কচা ও বলেশ্বর নদের তীরে টগরা গ্রাম এবং মঠবাড়িয়া ও ইন্দুরকানি উপজেলায় আমফানের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে ১৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আমফানের জলোচ্ছ্বাসে ইন্দুরকানী গ্রামটির সোয়া তিন কিলোমিটার বাঁধের এক কিলোমিটার ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে গ্রাম। আবার ভাটায় পানি নেমে যায়। প্রায় সাড়ে তিনশ পরিবার জোয়ার-ভাটার এই খেলায় বিপর্যস্ত। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে ভাঙ্গা বাঁধ নিয়ে বছরের পর বছর ধুঁকছে এই গ্রামের মানুষ। জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যেত। এক বছর আগে নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ঘূর্ণিঝড় আমফানে বাঁধটি আবার ভেঙ্গে গেল। এখন জোয়ারে ভাঙ্গা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে। টগরা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ সুমন তালুকদার বলেন, ‘বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় চলাফেরা করতে কষ্ট হচ্ছে। আমরা ত্রাণ চাই না, বাঁধ চাই।’ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার মঠবাড়িয়া ও ইন্দুরকানি উপজেলায় আমফানের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে ১৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে জেলার উপকূলীয় ১২টি গ্রামে জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢোকে। এরপর থেকে জোয়ারের পানিতে গ্রামগুলো প্লাবিত হচ্ছে। এ ছাড়া জলোচ্ছ্বাসে ৬ হাজার ৪৩০টি পুকুর ও ৩২৪টি ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। রবিশস্য, কলার বাগান, আউশের বীজতলারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জেলায় ২৯৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে মঠবাড়িয়ায় ১৪০ কিলোমিটার ও ইন্দুরকানি উপজেলায় ৯৪ কিলোমিটার রয়েছে। মঠবাড়িয়ার খেজুরবাড়িয়া থেকে বড়মাছুয়া লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৫০০ মিটার বাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া চর ভোলমারা, কচুবাড়িয়া ও খেতাছিড়া গ্রামের বাঁধ আমফানের জলোচ্ছ্বাসে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইন্দুরকানির চন্ডীপুর গ্রামের দেড় কিলোমিটার ও টগরা গ্রামের এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
×