ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

করোনা সঙ্কট ॥ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার পথে

প্রকাশিত: ২৩:২১, ১০ মে ২০২০

করোনা সঙ্কট ॥ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার পথে

গত ২ মে তারিখে পরিবেশিত একটি সংবাদ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান নাজুক দশায় দেশের মানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে। বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ‘ফোরাম ফর দি স্টাডি অব দি লিভার বাংলাদেশ’ দেশের লিভার রোগীদের চিকিৎসায় নিয়েছে নতুন উদ্যোগ। সংগঠনের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, এখন থেকে বাংলাদেশের লিভার রোগীরা মোবাইলে ফোন করে ৩০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন। সংগঠনের সম্মানী চেয়ারম্যান শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের এই দুর্যোগ মুহূর্তে লিভার রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ গ্রহণের সুবিধার্থে দেশের ৩০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি পরামর্শক দল গঠন করা হয়েছে। লিভার রোগে আক্রান্ত যে কোন রোগী তাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নিতে পারবেন। একই সংবাদে উক্ত ৩০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম, মোবাইল নম্বর ও সময়সূচী দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান দুর্যোগময় মুহূর্তে দেশের নামী দামী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ যারা লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ রোগের নিরাময়ের জন্য কাজ করেন, তাঁরা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে টেলিফোনে পরামর্শ দেবেন এই তথ্য ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত উৎসাহব্যাঞ্জক। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এই ভাইরাসের প্রাথমিক প্রাদুর্ভাবের পরবর্তীকালের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভবিষ্যত পরিকল্পনা নির্ধারণ এখন জরুরী হয়ে পড়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই মারাত্মক ছোঁয়াচে ভাইরাস মানুষের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে এক ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মানুষকে ভবিষ্যত দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হবে। কারণ বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, এই ভাইরাস, মানুষের ও পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে সহ-অবস্থান এখনও সুদূরপ্রসারী গবেষণার বিষয়। কারণ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে এন্টিবডি নিশ্চিত হতে, টিকা আবিষ্কার ও তার প্রয়োগের যথার্থ ফল পেতে ও চিকিৎসা কৌশল হাতে পেতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হবে। ফলে জীবন ও জীবিকা এখন এক বড় রকমের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছে যে পৃথিবীব্যাপী চিকিৎসা বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীগণ এর প্রতিকার খুঁজছেন। কেউ কেউ মনে করছেন প্রাথমিক প্রতিবিধানে এমনকি জটিল স্বাস্থ্য সেবায়ও ইন্টারনেট ব্যবহারই সামনের দিনগুলোয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য এটাই হবে অন্যতম সুযোগ, যাতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। এ কথা দুনিয়ার প্রায় সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। অনেক দেশ ইতোমধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে স্বাস্থ্য সেবায় ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যদিও প্রযুক্তিখাতে এগিয়ে থাকা সেরা দেশগুলো এবারের করোনা যুদ্ধে স্বাস্থ্য সেবায় প্রায় এক প্রকার ব্যর্থই হয়েছে। অপরদিকে স্বাস্থ্য গবেষণায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এতে করে অনেক বিশেষজ্ঞই ভাবছেন স্বাস্থ্য পরিষেবা আর কেন্দ্রমুখী না থেকে সম্ভবত সমাজভিত্তিক হতে যাচ্ছে। আর সেখানে প্রাথমিক সেবায় ও চিকিৎসায় রোগী ও ডাক্তারের সম্ভাব্য যোগাযোগের অন্যতম বাহন হবে ইন্টারনেট। প্রাথমিক প্রতিবিধানে ও দ্বিতীয় ধাপে রোগ নির্ণয় ও মোকাবেলায় মানুষ হয়তো প্রতিরোধেই জোর দেবে বেশি। আর কেন্দ্রগুলো হয়তো তৃতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশেষায়িত সেবায় নিয়োজিত থাকবে ও গবেষণা কাজে ব্যবহার হবে বেশি। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে স্বাস্থ্য পরিষেবা উপাত্তভিত্তিক নয়। বহুকাল যাবত গড়ে ওঠা এই সেবাখাতটি মুখ্যত হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জনসমাগমের মাধ্যমে বা ব্যক্তিগত উপস্থিতির মাধ্যমে তাৎক্ষণিক চেম্বার সেবায় নিয়োজিত। অতি সাধারণ উপসর্গের সেবা নিতেও মানুষকে কেন্দ্রে যেতে হয় ও এই ‘জড়ো উপস্থিতি’র পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। ফলে তার সম্পূর্ণ চাপ পড়ে চিকিৎসকের ওপরে। এতে মানসম্মত চিকিৎসা যে ব্যাহত হওয়া স্বাভাবিক যে কেউ তা স্বীকার করবেন। উপরন্তু চিকিৎসকের অন্যতম যে অনুষঙ্গ গবেষণা তারও সুযোগ হয় খুবই সীমিত। স্বাস্থ্য সেবায় উপাত্ত আর গবেষণার যে গুরুত্ব বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তা আমরা খুব ভাল করেই অনুধাবন করেছি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সেবার প্রচলিত সংস্কৃতি এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। নিতান্ত জরুরী না হলে মুখোমুখি সেবা সংঘটনের কাজ এখন আর এতদিনের মতো হবে কী না সন্দেহ। লিভার বিশেষজ্ঞদের উপরোল্লিখিত উদ্যোগ একটি সূচনা হলেও আমার বিশ্বাস এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। টেলিসিনার্জির বদৌলতে আমরা জানি স্মার্ট ডিভাইস কেমন করে দূরবর্তী স্বাস্থ্য সেবায় ব্যবহার হয়ে আসছে। বিশেষ করে ক্যান্সার চিকিৎসায় আইপিভিত্তিক ভিডিও চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকরী ও জনপ্রিয়। আজকাল ইন্টারনেট সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত নানারকম মেডিক্যাল ডিভাইস খুব সহজে ও অল্প খরচে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। প্রচলিত চিকিৎসা কৌশলগুলোর সঙ্গে যতটা সম্ভব তার চেয়ে আরও নির্ভুল উপায়ে অনেক ধরনের জটিল প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে এইসব প্রযুক্তিনির্ভর উপকরণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের জ্ঞানের সংমিশ্রণ সামনের দিনে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য। সরকারী হিসেবে প্রতিবছর দেশে প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিস রোগে মৃত্যুবরণ করে এবং আরও ৩ লক্ষাধিক লোক এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থের অভাবে ক্যান্সার, কিডনি এবং লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত রোগীরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। তেমনি তার পরিবার ব্যয় বহন করে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে লিভারের ক্যান্সার বাংলাদেশে পুরুষদের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞদের অনুমিত হিসেবে সাধারণত মানুষ ৫৫ থেকে ৬০ বছর বয়সে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকলেও বাংলাদেশের বেলায় লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার গড় বয়স মাত্র ৩৫-৪৫ বছর। অর্থাৎ, এদেশে একজন মানুষ তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনশীল সময়েই এই জটিল রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকেন। আশার কথা বাংলাদেশে লিভারের চিকিৎসায় ‘আর এফ এ’ ও ‘টেইস’ পদ্ধতির ব্যবহার এখন সুগম হয়েছে ও উল্লিখিত লিভার ডাক্তারগণের অনেকেই সে চিকিৎসা দিতে বিশেষ পারদর্শী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার চিকিৎসকদের গবেষণা ও উদ্ভাবনও আছে, যা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তাঁদের উদ্ভাবিত ‘স্টেম সেল থেরাপি’ এবং ‘বিলিরুবিন ডায়ালাইসিসে’র পদ্ধতিতে প্রচলিত যন্ত্রপাতিকেই নতুনভাবে ব্যবহার করা হয়েছেÑ যাতে অনেক কম খরচে অকার্যকর লিভার বা হেপাটাইটিসের চিকিৎসা করা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো চিকিৎসা সেবা, গবেষণায় আমাদের অন্যান্য সকল বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণও এগিয়ে আসবেন কিনা এবং আমরা এই আশা আমরা করতে পারি কিনা। করোনা পরিস্থিতির কারণে সারাদেশে স্বাস্থ্য সেবা ও ব্যবস্থাপনার যে দুর্বলতাগুলো আমরা এখন অনুধাবন করতে পারছি, সেখানে নতুন উদ্ভাবন ও নতুন চিন্তার সংমিশ্রণ ছাড়া আমরা এই সেবাকে কল্যাণমুখী রেখে ধরে রাখতে পারবো না। দুনিয়া জুড়ে ‘চিকিৎসা কূটনীতি’ আমাদের পরাস্ত করতে তৈরি হয়ে আছে। সেখানে নিশ্চয়ই আমরা ওষুধের বিশ্ব বাণিজ্য চিন্তার কাছে দেশের ১৭ কোটি মানুষকে দুর্গতির মুখে ঠেলে দিতে পারব না। আমাদের তাই আহ্বান থাকবে, দেশের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত সকলেই লিভার চিকিৎসকদের এই উদ্যোগ অনুসরণ করে নিজেদের জ্ঞান ও লব্ধ দক্ষতা নিয়ে সমাজের কাছে ফিরে যাবেন। মানুষকে টেনে না এনে যদি আমরা মানুষের কাছে যাই, তা হবে ব্যাপক সমর্থনযোগ্য। বড় শহরে যত বড় চিকিৎসা কেন্দ্রই আমরা গড়ে তুলি না কেন, দুর্গতিরকালে সেগুলো যে আমাদের ব্যাপক হতাশ করে আশাভঙ্গের কারণ হয়েছে, সে তো আমরা এই মহামারী আক্রান্তেরকালেই দেখতে পাচ্ছি। শরীরের কোন উপসর্গ নিয়ে কোথায় যাব তার কোন কূল কিনারা করে ওঠা কঠিন। আমরা জানি না কোথায় কে নিরাপদ। আমাদের অজ্ঞতায় আমরা একদিকে যেমন চিকিৎসাসেবা কর্মীদের আক্রান্ত করতে পারি, অপরদিকে আমিও আক্রান্ত হতে পারি। এক অদ্ভুত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে আমরা ও স্বাস্থ্য সেবা উভয়েই ভুগছি। সেখান থেকে আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে। আমরা এ-ও জানি দেশের মানুষকে উপযুক্ত স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়া একদিকে আমাদের যেমন কর্তব্য, অপরদিকে সরকারেরও রয়েছে নিবিড় অঙ্গীকার। সেক্ষেত্রে আমাদের সমাজভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার উদ্ভাবনী চিন্তা ও ডিজিটাল প্রযুক্তির অন্তরঙ্গ কৌশল মিলে মিশে এক নতুন স্বাস্থ্যসেবার মডেল নির্মাণের দিকে যাত্রা শুরু হোক। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×