ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসকদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের শেষ কোথায়?

প্রকাশিত: ১৬:২২, ২৬ এপ্রিল ২০২০

চিকিৎসকদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের শেষ কোথায়?

চিকিৎসা মহান পেশা।এই পেশায় প্রান্তীক জনোগোষ্ঠীর কাছাকাছি থেকে সরাসরি সেবাদানের সুযোগ রয়েছে। জাতীয় কিংবা বৈশ্বিক যে কোন স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ মোকাবেলায় চিকিৎসকেরা আলোকবর্তিতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। চলামান বৈশ্বিক কোডিড-১৯ পেন্ডিমিক মোকাবেলায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাজীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্রন্ট লাইনার হিসেবে অবিরত কাজ করে যাচ্ছে। পেশাজীবী চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) হিসাব অনুযায়ী ২২ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে চিকিৎসকসহ মোট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ছিল ৪৩০ জন । বাংলাদেশ চিকিৎসক ফাউন্ডেশন নামে আরেকটি সংগঠনের তথ্য মতে, ২১ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ২০৫ জন চিকিৎসক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও আক্রান্ত হয়েছেন ১০০ জনের বেশি নার্স। আক্রান্তদের প্রায় ১৫ শতাংশ চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী। সংগঠটির তথ্যমতে, বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে ৭৫ হাজার চিকিৎসক ও ৩২ হাজারের মতো নার্স রয়েছে।এদের প্রায় প্রত্যকেই করোনা আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যা এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। রাষ্ট্র কি তাঁদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে পেরেছে? রাষ্ট্র কি তাদের প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ সুবিধাগুলো প্রদান করছে? আজকের আলোচনায় মূলত সরকারি চিকিৎসকরা যেসকল পেশাগত ও সামাজিক বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্ট করব। ডাঃ মঈন ও একটি বৈষম্যমূলক সমাজেত প্রতিচিত্র ডা. মঈন উদ্দিন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক গত ১৫ এপ্রিল ২০২০ ঢাকার কুর্মিটোলা জেলারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। দেশের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করা প্রথম চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়েথাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও মানুষের হৃদয়েতাঁর ত্যাগ ও অবদানের কথা থেকে যাবে। গত ৫ এপ্রিল ২০২০করোনা পজিটিভ হওয়ার পর স্বাস্থ্যের অবনতি হলেও তাঁর জীবনরক্ষায় সংশ্লিষ্ট কেউই সময়মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। ডা. মঈনের জন্য একটা এয়ার এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। সিলেটের মতো বিভাগীয় শহরে তাঁর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। এতেইবুঝা যায়, স্বাস্থ্যখাতে আমাদের অবস্থা কতটুকু নাজুক। অন্যদিকে অতিসম্প্রতি যশোরের ঝিকরগাছায় হোম কোয়ারেন্টাইন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে অভিযানকালে সড়ক দুর্যটনায় গুরুতর আহত হওয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডা. কাজী নাজিব হাসানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়। দুইজনের মধ্যে পার্থক্য হলো একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং আরেকজন স্বাস্থ্য ক্যাডারের সহাকারী অধ্যাপক। ডা. কাজী নাজিব হাসান ৩৫তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। প্রশাসন ক্যাডারে যোগদানের পূর্বে তিনি সম্ভবত ৩৩তম বিসিএসের স্বাস্থ্য ক্যাডারেও নিয়োগ পেয়েছিলেন। একবার ভেবে দেখুন, স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসক ডা. কাজী নাজিব হাসান গুরুতর আহত হয়েছেন।জরুরী চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকায় আনা প্রয়োজন। তখন তিনি কি হেলিকপ্টার সেবা পেতেন? পদোন্নতি প্রাপ্তির বৈষম্য ও পেশাগত হতাশা চিকিৎসা পেশায় একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের পর পদোন্নতির জন্য আর বিবেচিত হন না। যার কারণে স্বাস্থ্য সচিবের মতো পদগুলো চলে যায় প্রশাসনের ব্যক্তিদের দখলে। এর ফলে তৈরি হয় পেশাগত হতাশা। কিছুদিন আগে ৩৩ তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের এক চিকিৎসকের সাথে কথা হলো বেশ কিছুক্ষণ। আলোচনার এক পর্যায়ে, অনেকেটা আপেক্ষ নিয়েই বললেন, ২০১৮ সালের আগস্টের সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাশ করেও এখনো তাঁর পদোন্নতি হয়নি, পড়ে রয়েছেন নবম গ্রেডে। অথচ তাঁর একই ব্যাচের (৩৩ তম বিসিএস) অন্য ক্যাডারে যোগদান করা সহকর্মীরা অনেকেইইতোমধ্যে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পেয়েছে। স্বাস্থ্যক্যাডারে ক্লিনিকাল বিষয়ে পদোন্নতির জন্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন স¤পূর্ণ করতে হয় । উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কেউ যদি কনসালটেন্ট, সহযোগী অধ্যাপক হতে চায়, তাকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা লাগবেই। যেহেতু তাঁর পোস্ট গ্রাজুয়েশন নেই,পদোন্নতিও থেমে আছে।পাশাপাশি, প্রশাসনিক পদে যেতে হলে সময়টা নির্ধারিত না, একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। কিন্তু তাদের পদোন্নতি সময়মত হবে না, বিষয়টা অনেকটা অলিখিতভাবে একপ্রকার নির্ধারিত। ডাক্তারি পড়াশুনা স¤পর্কে যাদের একটুকুও ধারণা আছে, তারা অন্ততঅবগত আছেন, যে ডাক্তারদের পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা অন্যান্যদের মতো এতো সহজ না। সুযোগ খুব সীমিত, প্রতিযোগিতা অনেক বেশি।পাশাপাশি উচ্চ পর্যায়ে পদের সংকটতো আছেই। কিন্তু ক্যাডার সার্ভিসের অন্য আর কোন ক্যাডারের ক্ষেত্রে এমন অদ্ভুত নিয়ম নেই। অন্য ক্যাডারে পদোন্নতির জন্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন আবশ্যিক না। একসাথে একই বিসিএসে ক্যাডার হয়ে অন্যরা বেতন পাচ্ছে ষষ্ঠ গ্রেডে আর স্বাস্থ্য ক্যাডার হওয়ার কারণে সে পাচ্ছে নবম গ্রেডে বেতন। বৈষম্য কতটা প্রকট ভাবা যায়। আমরা জানি পদোন্নতির সাথে অন্যান্য সুযোগ সুবিধার স¤পর্ক বিদ্যামান। তাই সরকারি ডাক্তাররা প্রতিনিয়ত নানাবিধ সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেখা যাবে আপেক্ষকরা চিকিৎসকযতদিনে পদোন্নতি পেয়ে ষষ্ঠ গ্রেডে যাবে, ততদিনে তাঁর অন্য ক্যাডারের ব্যাচমেটদের সেলারি স্কেল চতুর্থ বা তৃতীয় গ্রেড হয়ে যাবে।একই ব্যাচে যোগদান করা সহকর্মীরাই হয়ে যাবে স্যার। হয়ত, তাদের টেবিলেফাইল সাইন করা জন্য সেই ডাক্তারকেই ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হবে । বিষয়টা যথেষ্ট বেশ কষ্টকর হলেও বাস্তব। ডাক্তারদের দুই বছর গ্রামে থাকা বাধ্যতামূলক কিন্তু দুই বছর পরেই যে সে শহরে বা একটু অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গায় পোস্টিং পাবে সেই ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। দেখা যাচ্ছে অনেক ডাক্তারকে ৪-৬ বছর বা তার বেশি অধিক সময় উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স এ থাকতে হচ্ছে। পোস্ট গ্রাজুয়েশনে করার সুযোগ না পেলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনী, অর্থোপেডিক্স, চর্ম, শিশু, কার্ডিওলোজি,অপথালমোলোজি, এনেস্থিসিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পোস্টিং আছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু এইসব বিশেষজ্ঞদের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত লজিস্টিক নেই। অনেকেরই এফসিপিএস, এমডি মত পোস্ট গ্রাজেশন করে আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য উপজেলায় পোস্টিং হয়। স্বাস্থ্য ক্যাডারই এটা সম্ভব। অন্য ক্যাডারে নয়। এসবের প্রধান কারণ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আরো সহজ করে বললে স্বাস্থ্য সচিব পদে টেকনিক্যাল পার্সন না রাখা। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চকে সার্ভিস দেয়, কোন প্রকার আলাদা সুযোগ সুবিধা কিংবা মূল্যায়ন ছাড়াই। এ বিষয়গুলো কখনোই সামনে আসে না। ফলে চিকিৎসকের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করাটাই স্বাভাবিক। পরিপাতের বিষয় সরাকারি ডাক্তারা নিয়মিত বেতন পর্যন্ত পায় না। গত ডিসেম্বরে নিয়োগ পাওয়া ৩৯তম বিসিএসের চিকিৎসকদের অনেকেরই দুই থেকে তিন মাসের বেতন বকেয়া পড়ে রয়েছে। পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় তাদের বেতন দেরিতে হচ্ছে।এমন অদ্ভুত সব বৈষম্য শুধুমাত্র স্বাস্থ্যক্যাডারের চিকিৎসদের সাথেই দেখা যায়। চিকিৎসকদের শুধু বলা হয় কতজন ডাক্তার লাগবে, কি কি পোস্ট খালির লিস্ট দেন।কিন্তু লিস্ট দিলে মন্ত্রণালয়ে বছরের পর বছর পরে থাকে। একটা উদাহরণ দেই, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের মতো জায়গায় ডাক্তারদের জন্য কোন পোস্ট ক্রিয়েট করা হয়নি। সব ডাক্তার অন্য সব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এটাচমেন্টে এনে কাজ করানো হচ্ছে। ৫ জনের কাজ ১ জনকে দিয়ে করানো গেলে অসুবিধা থাকার কথা না। সম্ভবত সেই টাকা দিয়ে কিভাবে খাল-পুকুর খনন করতে হয় এই বিষয়ে আমলাদের বিদেশ ভ্রমণ কাজে ব্যয় করা অধিকতক কার্যকরি মনে করা হয়। নতুন নতুন দামি গাড়ি ক্রয়ের ব্যবস্থা করা যাবে। সেটাই ভালো না? সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির বৈষম্য সরকারের প্রথম শ্রেনির কর্মকর্তা হয়েও যারা একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষজ্ঞ সেবা প্রাদন করেন তারা হলো সরকারি চিকিৎসগণ। কিন্তু প্রতিদানে মাস শেষে বেতন ছাড়া আর উদাহরণ দেয়ার মতো আহামরি কিছুই সরকারি ডাক্তারগণ পায় না। ডাক্তারদের আবাসন, নিরপত্তা, যাতায়েতের সুযোগের বৈষম্যের কথা বিশেষ ভাবে বলা যায়। খুব বেশি উপরের লেভেলে না, উপজেলা পর্যায়ে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মতার প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার দিকেই তাকালেই বৈষম্য সু¯পষ্ট হয়। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের জন্য বরাদ্দ থাকে সুন্দর বাড়ি, দামি গাড়ি। অফিসিয়াল নিরাপত্তার কোন সমস্যা থাকে না। অফিস থাকে সুজজ্জিত এবং আধুনিক সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার জন্য নেই আহামরি কোন আবাসনের ব্যবস্থা,উপজেলার হাসপাতালগুলোতে থাকে না পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা। যাতায়াতের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গাড়ির সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারে না বললেই চলে। চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যাপারটা কেমন তা দেখা যাক। চিকিৎসকের ইভিনিং এবং নাইট ডিউটি থাকে। এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন নিরাপত্তাকর্মী দেয়া হয় না, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রসঙ্গ তো অনেক দূরের ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাজনিত সমস্যার থাকে নারী চিকিৎসকগণ। অন্যদিকে একজন প্রশাসনের কর্মকর্তা কোন অভিযানে কিংবা অফিসের যেকোন কাজে বের হলেই তার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। বিসিএস পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াত পর একজন ডাক্তারকে তার চাকুরীর স্থায়ীকরণের পরীক্ষা পাশ করতে হয়। ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করতে হয়। বেশ কয়েকজন ডাক্তারের সাথে আলাপ করে জানলাম যে, সরকারি ডাক্তারদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে ডিরেক্টর জেলারেল এওয়ার্ড পাওয়া মানে হলো সর্বোচ্চ স্কোরারদের মধ্যে একজন হওয়া। কিন্তু এর জন্য তাদের কোন ধরনের ফরেন ট্যুর বা বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় না। অন্যদিকে অন্যান্য অনেক ক্যাডারে এইসব ট্রেনিংয়ে ১-১৫ তম হয়েও ফরেন ট্যুর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং এ সর্বোচ্চ স্কোরারদের কোন ধরনের ফরেন ট্যুর বা ট্রেনিং দেয়া হয় না। ডাক্তারদের ইভিনিং/ নাইট শিফট ডিইউটির জন্য আলাদা কোন সম্মানীর ব্যবস্থা নাই। অনেকেই যারা মিডলেভেলের ডাক্তার তারা এক্সটা এডমিশ ডে, পোস্ট এডমিশন ডে-তে ইভিনিং রাউন্ড দেয়। নিয়মিত ৩য়,৪র্থ, ৫ম বর্ষের সন্ধ্যা কিংবা সকালের রাউন্ডে ক্লাস নেয়, কিন্তু তার জন্য আলাদা কোন পেমেন্ট নেই। প্রফেসরদের মূল দায়িত্ব মেডিক্যাল কলেজের কেন্দ্রীক; হাসপাতালে রোগী দেখা না।ছাত্র পড়ানো কাজ হলেও তারা কিন্তু নিয়মিত হাসপাতালে রাউন্ড দেন। বরাবরের মতো এটাও এক্সট্রা এবং ফ্রি। কিন্তু একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করলে তাঁর বেতনের বাইরে আলাদা একটা ভালো এমাউন্টের সম্মানী পেয়ে থাকেন।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাক্তারদের যাতায়াতের জন্য আলাদা ট্রান্সপোর্ট দেয়া হয় না। চিকিৎসা সেবা টিকওয়ার্ক হলেওদায়ভার সব চিকিৎসকদের কেন? চিকিৎসা সেবা একটা টিমওয়ার্ক। ডাক্তার এই টিমের একটি ইলিমেন্ট মাত্র। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একমাত্র ইলিমেন্ট না। ডাক্তার রোগী দেখে, রোগ ধরার চেষ্টা করে, প্রয়োজনে টেস্ট দেয়, টেস্টের রিপোর্ট দেখে রোগ ডায়াগনোসিস করে এবং চিকিৎসাপত্র লিখে দেয়। একজন রোগী হাসপাতালে আসলে তাঁর আরো বিভিন্ন ধরনের সার্ভিসের প্রয়োজন হয়। অসুস্থ রোগীকে আনা নেয়া, টেস্ট করাতে নেয়া, নিয়মিত বিছানাপত্র ঠিক করা, ক্লিনিংসহ আরো নানাবিধ কাজ। এসবের কাজের সাথে জড়িত থাকে নার্স, ওয়ার্ড বয়, আয়া, ক্লিনার। কিন্তু এসকল সার্ভিস প্রাপ্তির কোনটিতে সমস্যা হলে অথবা সেবা পাওয়া না গেলে দোষ হয় চিকিৎসকদের। চিকিৎসকগণ চিকিৎসা দেয়ার পরেও এই তাদেরকেই জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়। অথচ মানুষ জানেই না কার কাজ কোনটা। টিম লিডার হিসেবে চিকিৎসকের ঘাড়েই পরে সকল দোষ কিন্তু প্রকৃত সমস্যা অন্য জায়গায়। নার্সদের অধিদপ্তর কোন এক অদ্ভুত কারণে ডাক্তারদের থেকে আলাদা রাখা হয়েছে । তাই দেখা যায়, ওয়ার্ডের নার্স ডাক্তারদের কথা শুনতে বাধ্য না। তাদের অথোরিটি আলাদা। যেহেতু নার্সদের কারণ দর্শানো বা দায়িত্ব অবহেলার কারণে শাস্তি প্রদান করার ক্ষমতা ডাক্তারদের হাতে নেই, তাই দেখা যায় প্রায়ই নার্সরা ডাক্তারের নির্দেশনা মতে চলে না। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর নিয়োগ প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বেশ কয়েক বছর যাবত বন্ধ রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অনেক কম। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের মধ্যে স্থানীয় ক্ষমতাবানদের মাধ্যমেএকটা সিন্ডিকেট ব্যবস্থা তৈরি হয় । ফলে দেখা যায় তারা কাজ করুক বা না করুক, ডাক্তারদের নাম ভাঙিয়ে অন্যেদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিলেও ডাক্তাররা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না, যেহেতু তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নেই। ফলে দেখা যায়, ডাক্তাররা নামমাত্র টিম লিডার থাকলেও, কার্যত এইসব দুষ্টচক্র ভাঙ্গার ক্ষমতা তাদের দেয়া হয়নি। করোনা পরিস্থিতি ও ডাক্তারদের প্রতি অবহেলা দৃশ্যমান ডাক্তারদের পর্যাপ্ত মানসম্মত পিপিই সরবরাহের অবহেলার জন্য যখন রাষ্ট্রের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ক্ষোপ প্রকাশ করেন, তখন বুঝতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ডাক্তারদের সুরক্ষা প্রদানে কতটা উদাসীন। প্রতিদিন গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারছি, করোনার এই সংকটকালে ডাক্তারগণ পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত পিপিই পাচ্ছে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। এন-৯৫মাস্কের প্যাকেটে দেয়া হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা দামের মাস্ক। কোথাও কোথাও কাপড়ের মাস্কও দেয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও গ্রাউন দেয়া হচ্ছে রেইটকোট টাইপের। কিছু অসাধু লোক এই পরিস্থিতিতেও রমরমা ব্যবসা করেছে , দুর্নীতি করে লাক্ষ লাক্ষকোটি কোটি টাকা আয় করছে তা বলা অপেক্ষা রাখে না। ডাক্তাররা অবশ্যই কাজ করতে চায়। চিকিৎসা বলতে শুধু প্রেসক্রিপশন লেখা বুঝায় না, এর সাথে আরো অনেক কিছু জড়িত যেগুলো ডাক্তারদের হাতে নাই। মানুষ যেনো ভালো সার্ভিস পায় ডাক্তাররাও তা অবশ্যই চায়।লাইফ সাপোর্ট অনেক পরের কথা বেশির ভাগ হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন নেই। ইনটুবেশনের ব্যবস্থা নাই। ডাক্তারদের প্রোপার ট্রেনিং গাইড লাইন দেয়া হয়নি। পিপিই দেয়া হয় নাই। আচ্ছা, ক্রিটিক্যাল পেসেন্ট অক্সিজেন ছাড়া কিভাবে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব?অনেক ওয়ার্ডেই অক্সিজেন লাইন পর্যন্ত নাই। প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা না পেয়ে, দিনশেষে সাধারণ জনগণকিন্তু ডাক্তারদের প্রতিমারমুখী হয়ে ওঠে ।আমলারা বরাবরই ধরা ছোয়ার বাইরেই থেকে যায়। অন্যদিকে, আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়ে খবর, ডাক্তার চিকিৎসা দেয় নাই। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কয়জনই বা জানা চেষ্টা করে। একটা করোনা প্রেসেন্ট যখন আসে তার জন্য সাপোর্টিভ চিকিৎসা ছাড়া কিছু করা যায় না। সাপোর্ট মানে শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন, নেবুলাইজার দেয়া, যেটা অধিকাংশ ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত নাই। এতে কাজ না হলে ইনকিউবেশন লাগে। গলায় নল ঢুকিয়ে অক্সিজেন ঢোকানার জন্য এক্সপার্ট ম্যান পাওয়ার লাগে। এনাস্থেশিয়া আইসিইউ এক্সপার্ট প্রয়োজন , পর্যাপ্ত ম্যাটেরিয়ালস প্রয়োজন । অধিকাংশ হাসপাতালগুলোতে এইসকল সুযোগ সুবিধা নেই। স্বাস্থ্য সচিব কেন স্বাস্থ্য ক্যাডার থেকে নয়? বর্তমানে করোনা পরিস্থিতে বলায় অপেক্ষা রাখে না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়লের তাদের উপর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সময় এসেছে চিন্তা করার, কেন ডাক্তাররা তাদের পেশার শীর্ষতম প্রশাসনিক পদগুলোয় নিযুক্ত হবেন না? একজন আমলার পক্ষে সব বিষয়ে খুঁটিনাটি জানা অসম্ভব, আর চিকিৎসার মতো চরম বিশেষায়িত পেশায় তো তা বলাই বাহুল্য। ফলে দেখা যায়, ক্রয় থেকে শুরু করে কোন খাতে কি অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন সেই বিষয়ে একধরনের অসামাঞ্জস্য বিরাজ করে। মাঝে মাঝে দেখা যায় , হাসপাতালগুলোতে কল্পনাতীত অর্থব্যয়ে যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। অনেক জায়গায় পিসিআর মেশিন আছে, টেকনিশিয়ান নেই।স্বাস্থ্য সচিব হয়, প্রশাসনের ব্যক্তিরা। ফলে দেখা যায়, যায় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন আমলাররা। যদিও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের জ্ঞান পর্যাপ্ত নেই বা নেই বললেই চলে। সুতরাং স্বাস্থ্য সচিব যদি পেশাদার চিকিৎস হন, যার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও আছে, তাহলেই সবচেয়ে চালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কে বা কারা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনা করে। নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের শীর্ষমেধাবীরাই চিকিৎসা পেশায় আসে। বিসিএস পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, এক বুক আশা নিয়ে সার্ভিসে যোগদান করে। কিন্তু পদে পদে বৈষম্যের স্বীকার হওয়ার ফলে একটা সময় পরে অধিকাংশদের মাঝে হতাশা দেয়া দেয়। ডাক্তারদের সাথে চলমান এইসকল বৈষম্য নিয়ে ভাবার সময় চলে এসেছে। এই বৈষম্য অনুধাবন এবং প্রশমন করার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত দরকার। চিকিৎসকদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্যাডার বৈষ্যম্যএভাবে বিদ্যমান থাকলে ভবিষ্যতে কোন পিতা মাতা তার সন্তানকে মেডিক্যাল কলেজে পড়ানোর মতো ঝুঁকি নিতে সাহস করবে না। শিক্ষার্থীরা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনা করায় আগ্রহ পাবে না। দেশে মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও শিক্ষার্থী সংকটে পড়বে। শিক্ষার্থীরা ডাক্তারি পাশ করেও স্বপ্ন দেখবে প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার কিংবা পশ্চিমা দেশুগুলোতে মাইগ্রেশন করার। রাষ্ট্র আর কত বিমাতাসুলভ আচরণ করবে চিকিৎকদের প্রতি? আর কত পেশাগত বৈষম্যের স্বীকার হবে চিকিৎসক সমাজ? লেখক: উন্নয়নকর্মী
×