ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের একটি স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৮:১১, ১৭ এপ্রিল ২০২০

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের একটি স্মৃতি

১৭ এপ্রিল। বাঙালীর স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ১৯৭১ সালের এই দিনে। শত বছরের পরাধীনতার শেষে বাঙালীর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার মরণপণ আনুষ্ঠানিক লড়াই শুরু হয়েছিল এই দিনে। সেই লড়াইয়ের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধুর আজীবনের চার সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানের ওপর। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াই শেষে এসেছিল পরিপূর্ণ বিজয়ের ১৬ ডিসেম্বর। জাতির জনকের আজীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এর রূপকার এই চার নেতা জীবনের শেষ দিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও বাঙালীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকে গিয়েছেন। মৃত্যুভয়কে তারা জয় করেছিলেন। ১৭ এপ্রিল যখন বাংলার প্রথম স্বাধীন সরকার জন্মগ্রহণ করে তখন ওই বৈদ্যনাথতলার নাম দেয়া হয়েছিল মুজিবনগর। সেই মুজিবনগর সরকার নয় মাস বন্ধুপ্রতিম ভারতের কাছ থেকে অর্থ অস্ত্র ও লাখ লাখ মানুষের ভারতের মাটিতে নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করেছিল। আমি শহীদ মনসুর আলীর সন্তান হিসেবে কাছ থেকে দেখেছি কিভাবে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে থেকে চার নেতা এক কাপড়ে দিনরাতের বিশ্রামকে উপেক্ষা করে সীমান্ত এলাকায় প্রতিনিয়ত ছুটে গিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে। অর্থ অস্ত্র জোগাড় করে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প সংগঠিত করেছেন। মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে সরাসরি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। দুঃখ কষ্টের খবর নিয়েছেন। এই চার নেতা প্রতিনিয়ত ভারতে পালিয়ে আসা লাখ লাখ উদ্বাস্তুর আশ্রয় ও খাদ্য নিশ্চিত করেছেন। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব দীর্ঘ নয় মাসে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে রণাঙ্গনে বিভিন্ন ফ্রন্ট খুলেছেন। তাদের অস্ত্র ও যুদ্ধের রণকৌশল প্রস্তুত করে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সঙ্গে পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছেন। বেসামরিক কর্মকর্তাদের দিয়ে মুজিবনগর সরকারের আপৎকালীন প্রশাসন সাজিয়েছেন। এই চার নেতার নেতৃত্ব দেশে বিদেশে স্বাধীনতার পক্ষে এবং কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার অবিরাম প্রচারণা চালিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সকল পর্যায়ে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও অনুপ্রাণিত করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে অবরুদ্ধ বাঙালীর মনে প্রতিনিয়ত সাহস যুগিয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিনের খবর প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন। খন্দকার মোস্তাকের মতো একজন বেইমান বিশ্বাসঘাতক মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে থেকেও চক্রান্ত করে ব্যর্থ হয়েছে এই চার নেতার দৃঢ় প্রত্যয় এবং বিচক্ষণতার কারণে। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সম্পন্ন করেনি, বঙ্গবন্ধুকেও সুস্থ দেহে দেশে ফিরিয়ে আনতে সফল হয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের চার সহচরকে শুধু মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা দিয়ে যাননি, আজীবন তিনি তার এই চার বিশ্বস্ত সহচরের কাছ থেকে বিভিন্ন দুর্যোগ ও সঙ্কটকালে সহায়তা ও পরামর্শ নিয়েছেন। ১৭ এপ্রিল আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর যে প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল ৭০ সালের বঙ্গবন্ধুর নিরঙ্কুশ বিজয় এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই সরকারের সফল পথ চলার মধ্য দিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ রূপ অর্জিত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। এই মুহূর্তে আমার একটি অনুরাধ থাকবে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে। মুজিবনগর সরকারের অনেক স্মৃতি গাথা এবং দলিল-দস্তাবেজ, অজানা ইতিহাস দেশের অভ্যন্তরে এবং ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ও সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। সেগুলো অনুসন্ধান করে বের করা হোক। ইতিহাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুজিবনগর সরকারের সঠিক ইতিহাস প্রস্তুত করে নতুন প্রজন্মকে জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করুন। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই ইতিহাসটি হারিয়ে যাবে। এদেশে বার বার স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত এবং ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। এটি আর হতে দেয়া যেতে পারে না। তাই আমাদের প্রধান কর্তব্য, মুক্তিযুদ্ধের সকল পর্যায়ের ইতিহাস সংরক্ষিত করতে হবে। আজকের এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ লাখ লাখ শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। শ্রদ্ধা জানাই প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতবাসীকে, যারা আমাদের সেই মহা দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছে এবং সবধরনের সহযোগিতা করেছে। করোনাভাইরাসের এই মহা দুর্যোগের সময় আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইনশাআল্লাহ এই দুঃসময়কে অতিক্রম করব, যেমন করেছিলাম ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। আমি গভীর শোক জানাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যে সকল ভাই-বোনকে আমরা হারিয়েছি তাদের জন্য। কায়মনোবাক্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি, যারা অসুস্থ আছেন তারা যেন দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় ১৪ দল
×