ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিনুর ছবি জীবনের গল্প বলে

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ৩ মার্চ ২০২০

পিনুর ছবি জীবনের গল্প বলে

পিনু রহমান। শুরুটা তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে করা যাক। পিনুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মফস্বল শহর পিরোজপুরে। মধ্যবিত্ত পরিবারে। পিনুরা দুই ভাই। ছোট ভাই পানু। পরিবারের বড় সন্তান এবং মানুষ হিসেবে পিনু শৈশব থেকে আলাদা। নিভৃতচারী। ঘরমুখো। স্কুলের সিরিয়াস লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার মধ্যে পিনু তার নিজস্ব পৃথিবীতে বড় হয়। উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ছেড়ে আসেন তার স্বপ্নের শহর। পাড়ি জমান রাজধানী শহর ঢাকায়। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে। পরিবারের ইচ্ছা ছিল তাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ানোর। কিন্তু কোন বিজ্ঞানই পিনুকে টানেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহ তার চিন্তার জগতকে আরও উন্মুক্ত করে। ধীরে ধীরে পিনু হয়ে ওঠে শিল্পের সারথী। কবিতাচর্চা, নাট্যশিল্প কিংবা চারুকলার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজানো- এসব পিনুর হৃদয় তুষ্ট করতে থাকে। একই সঙ্গে নিজের জন্য পথ খঁজতে থাকেন। পথিমধ্যে দেখা হয় ছায়ানটের শিক্ষার্থী ফাহমিদা পম্পার সঙ্গে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া দুটি জীবনকে এক করে ফেলে। মূলত পিনুর স্বপ্নের ডানা মেলতে এই মানুষটি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। আবিষ্কার করেন প্রেমিকের ভালবাসার চোখ। যে চোখ ‘মানুষের জীবন খোঁজা’র তৃষ্ণায় ব্যাকুল। যে তৃষ্ণা ছিল তার মধ্যে শৈশব থেকে লুকানো... ‘সময়ের ওপর আলো ফেলে, সময় বন্দী করা’ সহজ কথায় যাকে বলে চিত্রগ্রহণ বা ফটোগ্রাফি। পিনুর অন্যান্য শিল্পচিন্তার মধ্যে ফটোগ্রাফি কবে থেকে ঢুকে বসল এমন কৌতূহলী প্রশ্নে লাজুক পিনু মিষ্টি হেসে বলেন, যেদিন থেকে ক্যামেরার সাটারের শব্দ এবং আলো আমাকে ভেদ করে যায় সে দিন থেকে, তার মানে সেই শৈশবকাল থেকে! সে সময় ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ ছিল না। ও বয়সে ক্যামেরা কিনে শখ পূরণ করার কোন অবস্থাই আমার ছিল না। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় আমাদের রীতি অনুযায়ী শুভাকাক্সক্ষীদের থেকে আশিষ পাওয়ার রেওয়াজ ছিল। ওই সময় আমার মোটা অঙ্কের টাকা জোগাড় হয়ে যায়। দেরি না করে, সেই টাকা দিয়ে কিনে ফেলি জীবনের প্রথম ক্যামেরা। বন্ধু-বান্ধবের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি তুলতে আমার ভীষণ ভাল লাগত। পরবর্তীতে আমার এই ‘তৃতীয় নয়ন’ আবিষ্কার করে ফাহমিদা। যেদিন আমাদের বিয়ের আলোচনার চূড়ান্ত পর্ব সেদিন ওদের বাড়ি থেকে আমাকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ হিসেবে একটা দামী ক্যামেরা উপহার দিয়েছিল। ওই উপহার পাবার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। নতুন ক্যামেরা পেয়ে আমার ছবি তোলার তৃষ্ণা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। যেখানেই যেতাম সঙ্গে ক্যামেরা থাকত। প্রকৃতি এবং মানুষের জীবন ক্যামেরা বন্দী করতে আমি ভীষণভাবে উপভোগ করতাম। মাঝে একদিন বেড়াতে গিয়ে বাসের মধ্যে ভুল করে ক্যামেরা ফেলে আসি। ক্যামেরা হারানোর ব্যথা আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। সে ব্যথা কোনভাবেই ভোলার ছিল না। তবে ভুলেছি, যখন খবর পাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রূপালীতে আমার সিনিয়র অফিসার পদে চাকরি হয়েছে। খবর নিশ্চিত হয়ে মনে মনে ঠিক করেছিলাম চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথমে আমাকে লোন নিতে হবে, ক্যামেরা কিনতে হবে তারপর অন্যসব। কিন্তু চাকরির শুরুতে সে সুযোগ আমার হয়নি। ভোলা থেকে যখন খুলনায় বদলি হয়ে যাই সেখানকার ব্রাঞ্চটা বড় হওয়াতে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আমি লোনের সুযোগটা পেয়ে যাই। ৭৫ হাজার টাকা লোন নেই এবং ক্যামেরা কিনি। আবার ছবি তুলেতে শুরু করি, সেই থেকে আজ অবধি ছবি তোলার প্রেম আমাকে দগ্ধ করে চলেছে। বিশেষ করে, অফিস ছুটির দুটো দিন আমাকে প্রেমপিয়াসী করে তোলে। আমার স্ত্রী-সন্তানের কাক্সিক্ষত সঙ্গ ছবি তোলার প্রেমে বিসর্জন দিয়ে আসছি। ফাহমিদার কৃতিত্ব এখানে! ওঁ সব আগলে রাখছে। এমনও অনেক দিন গেছে বৃহস্পতিবার অফিস করে খুলনা থেকে সোজা রওনা হয়েছি আটঘর কুড়িয়ানার মতো বহু দুর্গম এলাকায়। আপনার আলোকচিত্র শিল্পের জীবনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল কীভাবে? মূলত ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় একটু-আধটু করে অংশগ্রহণ করতে শুরু করি। ২০১৩ সালে লন্ডনভিত্তিক ‘উইজডেন ক্রিকেট ফটো কন্টেস্ট’-এ শর্ট লিস্টে নিজের নাম থাকা এবং পরের বছর ‘ইউএনএফপিএ টপটেন ফটোগ্রাফার্স এ্যাওয়ার্ড’ ছবি তোলার প্রতি আমার আত্মবিশ্বাস কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। একই বছর ডেইলি স্টার ‘ইন পিক্সেল ফটো কন্টেস্ট এ্যাওয়ার্ড’ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্তি আমাকে নিয়ে আলোচনার একটা অবস্থা তৈরি করে। এরপর ধরাবাহিকভাবে চল্লিশটিরও বেশি দেশী-বিদেশী আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা এবং গ্রুপভিত্তিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছি। দেশী এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কারপ্রাপ্তি আমার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সব শেষে ‘ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফিক কাপ’ প্রতিযোগিতায় ‘বেস্ট অব নেশন এ্যাওয়ার্ডস’প্রাপ্তি আমাকে তৃপ্ত করেছে। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পেছনে একটা নাটকীয় ঘটনা আছে। অনেকে হয়ত জানেন না। ক্রিকেট-ফুটবলের মতো সারা পৃথিবীর আলোকচিত্রীদের নিয়ে একটা বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। ‘দ্য ফেডারেশন অব ইউরোপিয়ান ফটোগ্রাফার্স’ ও ‘প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার্স অব আমেরিকা’ ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী আলোকচিত্র শিল্পীদের জন্য এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। আলোকচিত্রী মাহমুদ হাসান শুভর নেতৃত্বে ষষ্ঠ আসরে প্রথমবারের মতো অংশ নেয় ১৮ সদস্যের বাংলাদেশ দল। ৩২টি দেশের জাতীয় পর্যায়ে বাছাই করা ৬০০ আলোকচিত্রীর ৬০০টি ছবি জমা পড়ে ৬টি ক্যাটাগরিতে। এর মধ্য থেকে ‘বেস্ট অব ন্যাশন এ্যাওয়ার্ডস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় আমার নাম। এ্যাওয়ার্ড জয়ী ছবির শিরোনাম ছিল ‘লস্ট চাইল্ডহুড।’ প্রথমে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আমার জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। আয়োজকদের শর্ত এবং মোটা অঙ্কের এন্ট্রি ফি, আমাকে নিরুৎসাহিত করে। স্বাভাবিকভাবে আমার ছবি বাদ পড়ে। পরে যখন ছবি বাছাইয়ের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে একজন বিচারক আসেন এবং পরবর্তীতে বাদ পড়া ছবি দেখতে চাইলেন। সেখান থেকে জনাব ম্যাথিউ ট্যান আমার ছবিটা বিশ্বকাপের জন্য নির্বাচিত করেন। অনেকটা ছেড়ে যাওয়া প্রমদতরীর টিকেট পাওয়ার মতো। আর একটা কথা, আমদের দেশে অনেক প্রতিভাবান আলোকচিত্র শিল্পী আছেন তাদের জন্য এই ‘বিশ্বকাপ’ বড় প্ল্যাটর্ফম। প্রয়োজন কেবল যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা। এক্ষেত্রে আমি বলবো আমাদের সরকার যদি এগিয়ে আসে তা হলে ‘ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি’তে আমাদের দেশ আরও এগিয়ে যাবে। আলোকচিত্রের ওপর আপনার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা? না, আমার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। একবার এক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ওয়ার্কশপের জন্য গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে তুষ্ট হতে পারিনি। অসম্পূর্ণ রেখে চলে আসি। নিজ উদ্যোগ্যে আলোকচিত্র নিয়ে অগাধ পড়াশোনা করেছি। বিশেষ করে, ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েব পেজে। কাজেই কেউ যদি জানতে চায়, বুঝতে চায় তার জন্য অনেক পথ খোলা আছে। স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার। বর্তমানে কি নিয়ে কাজ করছেন? আমার কাছে এখন খুব ভাল একটা ড্রোন আছে। এটা দিয়ে আমার শৈশবের শহর পিরোজপুরের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলো ক্যামেরা বন্দী করে একটা ডকুমেনটরি তৈরির কাজ করছি। অনেক দূর এগিয়েছে। আপনার ভবিষ্যতের ইচ্ছা? নিজ শহরে একটা শিল্পভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
×