মনোয়ার হোসেন
বলতে গেলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মূল ঠিকানাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা থেকে শিশু চত্বর, লিটল ম্যাগ কর্নার, মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ কিংবা লেখক বলছি মঞ্চ-সবটাই পড়েছে উদ্যানে। সেই সুবাদে মেলার এই ক্যানভাসটি ঘিরেই পাঠকের বিপুল আনাগোনা। তাই বলে পাঠকের জন্য বিরানভূমি হয়ে ওঠেনি মেলার আরেক ক্যানভাস বাংলা একাডেমি আঙ্গিনা। শুধুমাত্র প্রদর্শনীমূলক অনেক স্টল থাকলেও গ্রন্থানুরাগীদের জন্য এখানেও আছে অনেক কিছু। আছে বিচিত্র বিষয়ের নানা বই। নানা শ্রেণীর বইপ্রেমীর চাহিদা মেটানো সেসব বই ও বই বিতানের কথা মেলে ধরা হলো এ লেখায়।
একাডেমি আঙ্গিনায় সবচেয়ে বেশি মুখর থাকে শিশু একাডেমির স্টলটি। রকমারি বিষয়ে শিশুতোষ বইয়ের জন্য বিশেষভাবে নজর কাড়ে এই বই বিতানটি। তাই সব সময়ই এখানে থাকে পাঠকের সমাগম। রবিবার মেলার অষ্টম দিনের বিকেলে এই স্টল থেকে ‘শিশু বিশ্বকোষ’ সংগ্রহ করছিলেন ধানমন্ডির বাসিন্দা সামেরা জামাল। কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমার স্কুলপড়ুয়া ছেলের জন্য বইটি সংগ্রহ করলাম। বর্ণমালার ক্রমঅনুসারে বিভিন্ন বিষয়ে জানার জন্য গ্রন্থটি চমৎকার। স্টলটির বিপণনকর্মী নজরুল ইসলাম জানান, ফয়েজ আহ্্মদের ছড়ার বই ‘মৌ মৌ’, ‘বাংলা অভিধান’, ছবির মাধ্যমে ছোটদের অক্ষর পরিচয়মূলক ‘এ বি সি’ ও ‘অ আ ই’, শেখ হাসিনার লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প’, ‘ছোটদের বিজ্ঞানকোষ’ শীর্ষক বইগুলোর ব্যাপক পাঠকচাহিদা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সিরিজ, কমিক্স ও জীবনীভিত্তিক বইগুলো ভাল কাটতি আছে।
একাডেমির আরেক পাঠকপ্রিয় স্টল সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে ‘গ্রাফিক নভেল মুজিব’ নিয়ে আছে শিশুদের দারুণ কৌতূহল। কার্টুনের মাধ্যমে সহজ ভাষায় লেখা বইটির ‘এ্যাকশন ডে’ শিরোনামের সপ্তম সংস্করণ এসেছে মেলায়। স্টলটির বিক্রয়কর্মী মনীষা জানান, ছোটরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সহজভাবে জানতে চায়। তাই এই গ্রাফিক নভেলের প্রতি তারা বিশেষ আগ্রহী। যারা আগের পর্বগুলো পড়েছে তারা এসে নতুন সংস্করণটি সংগ্রহ করছে।
জাতীয় জাদুঘরের স্টলটি থেকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আলোকচিত্র চিত্রকর্মে সজ্জিত ‘মাস্টার আর্টিস্ট অব বাংলাদেশ জয়নুল আবেদিন’ বইটির প্রতি রয়েছে পাঠকের বিশেষ আগ্রহ। এছাড়া ‘ট্র্যাডিশনাল জামদানি’, ‘আলোকচিত্রে সেকালের ঢাকা’, ‘ইসলামিক আর্ট হেরিটেজ অব বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশের দারুশিল্প’ শীর্ষক গ্রন্থগুলোর পাঠক-কাটতির কথা জানান স্টলটির বিক্রয়কর্মী সাইফুর রহমান।
একাডেমিতে থাকা স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশ করেছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল সংস্করণে নতুন ১৫টি বই। এখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা মেলা চলাকালীন সময়ে যেকোন সময়ে এসে বই পড়তে পারে। নিবন্ধনের মাধ্যমে মাসব্যাপী মেলার যে কোন একদিন দৃষ্টিহীনদের বিনামূল বই উপহার দেয়া হ-বে বলে স্টলটির বিক্রয়কর্মী।
ধর্মীয়বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের খোঁজে অনেকেই আসেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্টলে। এখানে বেশি বিক্রীত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘বুখারী শরিফ’, ‘আখলাকুল নবী’, ‘আল কোরআনুল করিম’ ও ‘নক্ষত্রতুল্য সাহাবায়ে কারাম’ বইগুলো বেশি চলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্টলে আছে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডের পরিসংখ্যানবিষয়ক নানা বই। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের স্টলের আছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক নানা বই। মাসিক রম্য পত্রিকা উন্মাদ-এর স্টলটিও থাকের পাঠকের আনাগোনা। মেলা উপলক্ষে এসেছে রম্য ম্যাগাজিনটির ৩৫০তম সংখ্যা। কবি নজরুল ইস্টটিউটে দেখা মেলে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিচিত্র বিষয়ে রচনাসম্ভারসহ তাকে নিয়ে লেখা নানা বই। ডাক বিভাগের স্টলে রয়েছে হরেক রকমের ডাকটিকেট, পোস্টকার্ড ও বিশেষ খাম। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থায় রয়েছে মূলত গবেষণা বিষয়ক বই। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতেও রয়েছে গবেষণাধর্মী গুরুত্বপূর্ণ সব বই। তাদের প্রকাশিত পাঠক আকৃষ্ট করা বইয়ের মধ্যে আছে ‘বাংলা পিডিয়া’, ‘জুনিয়র বাংলা পিডিয়া’, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, ‘চারু ও কারুকলা’, ‘ঢাকাই খাবার’, ‘প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্য’ ও ‘স্থাপত্য’। এছাড়া একাডেমির বহেরা তলায় বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে চায়না বুক হাউস। এখানে চীনের উৎসব, নববর্ষ, শিক্ষাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থের চৈনিক ভাষা থেকে বাংলা অনুবাদের বইগুলোও আকৃষ্ট করছে পাঠককে।
অষ্টম দিনের নতুন বইয়ের খবর
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, রবিবার বইমেলায় নতুন বই এসেছে ১১৬টি। উল্লেখযোগ্য নতুন বইয়ের মধ্যে অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘তারুণ্যের আলোয়’। অন্বেষা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে দীপন নন্দীর ভাষা আন্দোলনবিষয়ক গ্রন্থ ‘একুশের স্মৃতি’। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে মোনায়েম সরকারের ‘লাইফ এ্যান্ড টাইমস অব দি ফাদার অব দি ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। রোদেলা প্রকাশনী এনেছে স্বকৃত নোমানের সুফিদর্শনের বই ‘মুসলিম মনন ও দর্শন অগ্রনায়কেরা’। অবসর থেকে এসেছে গোলাম মুরশিদের ‘রবীন্দ্রনাথের নারী-ভাবনা’। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই মিল্টন বিশ্বাসের বই ‘উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু’। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে শরীফুল হাসানের শিশুতোষ গ্রন্থ ‘জোজোর কান্ড’। মিজান পাবলিশার্স এনেছে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক কবীর চৌধুরীর লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালী জাতীয়তাবাদ’। কথা প্রকাশ এনেছে সনৎকুমার সাহার ইতিহাসবিষয়ক বই ‘ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে: রেনেসাঁ থেকে সমাজতন্ত্র’। আগামী থেকে এসেছে ড. মোহাম্মদ আমীনের ‘বাংলা সাহিত্য ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ ও আল মাসুমের ‘আপত্তি সত্ত্বেও’। অবসর এনেছে আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘দশ দিগন্তের স্রষ্টা’। সময় প্রকাশন এনেছে ধ্রুব এষের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ‘অনু ও ছয় দফা খাতা’।
মেলামঞ্চের আলোচনা
বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় মিল্টন বিশ্বাস রচিত উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রশান্ত মৃধা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন পাপড়ি রহমান ও মোজাফ্ফর হোসেন। লেখকের বক্তব্য দেন মিল্টন বিশ্বাস। সভাপতিত্ব করেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। সন্ধ্যায় ছিল কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখিত উপন্যাসগুলোকে শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক দুটি দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখার অবকাশ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস সমার্থক। তিনি হলেন সেই মহামানব যার মধ্যদিয়ে আমরা স্বদেশকে উপলব্ধি করতে পারি। বাংলার ইতিহাসের এই মহান নেতাকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রেখে উপন্যাসের ভাষ্য নির্মাণ এবং সব ধরনের শিল্প মাধ্যমে তাঁর গৌরবগাঁথা তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন।
সভাপতির বক্তব্যে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী হৃদয়ের এত কাছের একজন মানুষ যে তাকে নিয়ে সাহিত্য রচনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঔপন্যাসিককে এই আবেগের স্রোত এড়িয়ে নির্মোহভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে হবে এবং আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর কীর্তিময় জীবনগাঁথা সাহিত্য ও শিল্পের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে হবে। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি হালিম আজাদ, শাকিরা পারভীন, বায়তুল্লাহ কাদেরী এবং নাজমুল হুসাইন বিদ্যুৎ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী রফিকুল ইসলাম, ডালিয়া আহমেদ, শুচিতা সপর্যা। সংগীত পরিবেশন করেন ফকির আজমল শাহ, মোঃ আনোয়ার হোসেন, কাঙালিনী সুফিয়া, আমজাদ দেওয়ান, মমতা দাসী বাউল এবং প্রশান্ত সরকার। লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন পারভেজ হোসেন, ওবায়েদ আকাশ, মোস্তফা হোসেইন ও খায়রুল বাবুই।
আজকের মেলা
আজ সোমবার একুশে গ্রন্থমেলার নবম দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে দিব্যদ্যুতি সরকার রচিত বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রাশিদ আসকারী। আলোচনায় অংশ নেবেন সাহিদা বেগম ও আশফাক হোসেন। সভাপতিত্ব করবেন আবুল মোমেন।