ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বইয়ের টানে এক আঙিনায় প্রবাসী ও বিদেশী

প্রকাশিত: ১১:০১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বইয়ের টানে এক আঙিনায় প্রবাসী ও বিদেশী

মনোয়ার হোসেন ॥ মনন বিকাশের এক অপার সাগর অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তাই তো জ্ঞানের সমুদ্র শুধু স্বদেশীদেরই টানে না। দেশ ছেড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পাড়ি জমানো প্রবাসীরাও ছুটে আসেন বিচিত্র বিষয়ক বইয়ের সাম্রাজ্যে। প্রবাসের কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে ছুটে নেন তারা। সেই ছুটিটা উপভোগ করেন মনভোলানো বইমেলায়। শুধু কি তাই? বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার প্রতি ক্রমাগত বাড়তে থাকা আগ্রহ থেকে অনেক বিদেশী ছুটে আসেন গ্রন্থমেলায়। সেই সুবাদে বুধবার বইমেলার এক ক্যানভাস সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবাসীদের সঙ্গে দেখা মিলল বিদেশী পাঠকের। রোদ ঝলমলে দুপুরের বইমেলায় ঘুরছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন প্রবাসী রাফি আহমেদ। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে সংগ্রহ করছিলেন কিছু শিশুতোষ গ্রন্থ। সেই তালিকায় ছিল আলম তালুকদারের ‘রূপকথার রাজা’, সঙ্গীতা ইমামের ‘তুলতুলের সারাবেলা’, শাহরিয়ার খানের ‘বেসিক আলী’সহ বেশ কিছু বই। কথা প্রসঙ্গে বললেন, সন্তানের জন্য বইগুলো কিনলাম। বিদেশে বাংলা বই তেমন একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার ছেলের বাংলা ভাষার বইয়ের প্রতি রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। তাই বইমেলাকে উদ্দেশ করে ছুটি নিয়ে দেশে আসার আগেই সে বলে দিয়েছে তার চাহিদার কথা। তার জন্য বই নিয়ে গিয়ে আমিও সেই আগ্রহটাকে উস্কে দিতে চাই। এর ফলে বাংলাভাষা চর্চার পাশাপাশি মাতৃভাষার টানটাও ঠিক থাকবে। এদিন বইমেলায় দেখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রবাসী শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। হাত ভর্তি বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ঘুরছিলেন মেলায়। কী বই কিনলেনÑ জানতে চাইলে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞানবিষয়ক বই ‘ব্ল্যাক হোল রহস্য’, নাসরীন জাহানের কাব্যগ্রন্থ ‘মদের গেলাসে নাচে বরফের ওম’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘আমার দেখা নয়াচীন’, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘একই সূত্রে গাঁথা’, শামসুজ্জামান খানের ‘আধুনিক ফোকলোর চিন্তা’সহ একগুচ্ছ বইয়ের কথা বললেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, প্রতিবছর দেশে আসার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ হয় না। এবার বইমেলার সময়ই সেই সুযোগটি মিলে গেছে। ইচ্ছেমতো পছন্দসহ বই কিনছি। তার ওপর এবারের মেলার পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বুধবার বইমেলায় একদল জাপানী তরুণকে ঘুরতে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা সবাই জাপানের নিহন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালী জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা বাংলার চর্চা শুরু হয়েছে বলে জানালেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশী প্রভাষক মোঃ শাহ আলম। কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা ভাষার শিক্ষার্থী রুকা কুরা হাসিকের সঙ্গে। অনুভূতি জানতে চাইলে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, এই মেলায় ছড়িয়ে আছে ছোট-বড়সহ বিভিন্ন বয়সী পাঠকের গ্রন্থসম্ভার। এগুলো দেখে ভাল লাগার পাশাপাশি বিভিন্ন এদেশের নানা রকম মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হচ্ছে। এর ফলে বাংলা ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহটা আরও বাড়ছে। সেই আগ্রহ থেকেই বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও স্বাধীনতাবিষয়ক কিছু বই সংগ্রহ করলাম। বইমেলায় প্রবাসী ও বিদেশী পাঠকের আগমন প্রসঙ্গে কাকলী প্রকাশনীর প্রকাশক নাছির আহমেদ সেলিম বলেন, সামগ্রিকভাবে এ ধরনের পাঠকের সংখ্যা সামান্য। তবে এখানে সংখ্যার চেয়ে বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসাটাই বড় বিষয়। এতে মাতৃভাষার প্রতি প্রবাসীদের টানটি যেমন বোঝা যায়, তেমনি বাংলার প্রতি বিদেশীদের আগ্রহটাও দৃশ্যমান হয়। নতুন বইয়ের খবর ॥ বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগে তথ্যমতে বুধবার গ্রন্থমেলার চতুর্থ দিনে[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৯৫টি। এর মধ্যে আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসগ্রন্থ ‘আছে তো দেহখানি’ এবং মৌলিখ আজাদের গল্পগন্থ ‘বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে’। বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছে অজয় দাশগুপ্তের ‘বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশল ও হরতাল’। আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে মোনায়েম সরকারের ইতিহাস বিষয়ক বই ‘বঙ্গবন্ধু-জন্মশতবর্ষ ইতিহাসের পুনর্পাঠ’। অনুপম প্রকাশনী থেকে এসেছে সৌমেন সাহার বিজ্ঞানবিষয়ক বই ‘আকাশ দেখা ভারি মজা’, অন্যপ্রকাশ থেকে শিহাব শাহরিয়ারের কবিতার বই ‘অদৃশ্য গুচ্ছ’, অনন্যা থেকে আসিফ নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আওয়ামী আমল’, কথাপ্রকাশ থেকে মুনতাসীর মামুনের ইতাহাসবিষয়ক গ্রন্থ ‘স্মৃতিময় ঢাকা’, অন্যপ্রকাশ থেকে হক ফারুক আহমেদের কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘদরিয়ার মাঝি’, অন্যধারা থেকে এসেছে সাদাত হোসাইনের কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে দেখার অসুখ’, সরলরেখা প্রকাশনা থেকে আল মাহমুদের উপন্যাস ‘রাগিনী এবং সহোদরা’, বিভাস থেকে মহাদেব সাহার ‘মুজিব সমগ্র’, ইকরি মিকরি প্রকাশনা থেকে ধ্রুব এষের শিশুতোষ বই ‘অং বং চং,’ গ্রন্থকুটির থেকে এসেছে মোজাফফর হোসেন সম্পাদিত ‘বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ।’ মেলামঞ্চে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বইয়ের আলোচনা : বুধবার গ্রন্থমেলার চতুর্থ দিনে মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অজয় দাশগুপ্ত রচিত বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশল ও হরতাল শীর্ষক আলোচনা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুভাষ সিংহ রায়। আলোচনায় অংশ নেন নূহ-উল-আলম লেনিন ও আবু সাঈদ খান। লেখকের বক্তব্য দেন অজয় দাশগুপ্ত। সভাপতিত্ব করেন রামেন্দু মজুমদার। প্রাবন্ধিক বলেন, তরুণ বয়সেই শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষ্য স্থির করেছিলেনÑ স্বাধীনতা। পূর্ববঙ্গের বাঙালীর নিজস্ব রাষ্ট্র চাই। এ জন্য সময়োচিত রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করায় তিনি ছিলেন কুশলী ও বিচক্ষণ। লক্ষ্যে পৌঁছাতে আন্দোলনের কর্মসূচী প্রণয়ন করতে গিয়ে সর্বদা নজর ছিল জনগণকে যত বেশি সম্ভব সম্পৃক্ত করা। তিনি আরও বলেন, ভাষা আন্দোলন, পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় নিয়ে আসা, ষাটের দশকে সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ প্রদান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির রূপরেখা তুলে ধরা এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধÑ সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধু সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে চলতে চেয়েছেন। আলোচকবৃন্দ বলেন, বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কাছে স্বাধীনতা মানে ছিল গণমানুষের মুক্তি এবং নিপীড়িত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন। আর এ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার জন্যই তিনি নিবিষ্ট থেকেছেন। অদম্য সাহস, সময়োচিত সিদ্ধান্ত ও ফলপ্রসূ রাজনৈতিক কর্মসূচীই ছিল বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের কৌশল। বাঙালীর জন্য স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরম লক্ষ্য সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন এবং আন্দোলন সংগ্রামের জন্য বাঙালীর চেতনাকে প্রস্তুত করে তুলেছেন। অজয় দাশগুপ্ত বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে নানামুখী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। দিনের পর দিন রাজপথে সংগ্রাম করে তিনি গণমানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। তাঁর আন্দোলন কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মানুষকে সম্পৃক্ত করা। রামেন্দু মজুমদার বলেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সাফল্যকে বুঝতে হলে তাঁর আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসকে গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আজীবন অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালনকারী বঙ্গবন্ধু ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষকে নিয়েই আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর আন্দোলনে গণসম্পৃক্ততা ছিল বলেই চূড়ান্ত সাফল্য হিসেবে আমরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পেয়েছি। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি আলতাফ হোসেন, কবি জাহিদ হায়দার, কবি ফারহান ইশরাক ও কবি রনজু রাইম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী এনামুল হক বাবু, ফয়জুল আলম পাপ্পু ও নায়লা তারান্নুম চৌধুরী। সঙ্গীত পরিবেশন করেন ফাতেমা-তুজ-জোহরা, সুজিত মোস্তফা, এ কে এম শহীদ কবীর পলাশ, সম্পা দাস ও মোঃ মেজবাহ রানা। লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মোহিত কামাল, স. ম. শামসুল আলম, সাকিরা পারভিন সোমা ও রাহেল রাজিব। আজকের মেলা ॥ বৃহস্পতিবার গ্রন্থমেলার পঞ্চম দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেলে মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে নূহ-উল-আলম লেনিন রচিত ‘রাজনীতিতে হাতেখড়ি ও কলকাতায় শেখ মুজিব’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মোহীত উল আলম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন আসাদ মান্নান এবং সাহেদ মন্তাজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ হাসান ইমাম। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×