ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিকারির ভয়ে আমাদের বকেরা দিশাহারা-উড়াল দেবে কি কোন অভয়ারণ্যের খোঁজে

ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে বগাকে দেখিয়া বগি কান্দেরে...

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে বগাকে দেখিয়া বগি কান্দেরে...

সমুদ্র হক ॥ ধবধবে সাদার উপমায় বলা হয় : বকের পালকের মতো সাদা। সুন্দর পালকের এই বকের বাস নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে। আমাদের নিজ ভুবনের আপন পাখি বকের এখন ক্রান্তিকাল। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে ধরলা নদীরপাড়ের বককে নিয়ে সেই করুণ গান ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’... মতোই অবস্থা আমাদের দেশী পাখি বকের। খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজেই মানুষের খাবার টেবিলে যাচ্ছে। অতি নিরীহ এই বক পাখির কাছে মানুষের শেখার আছে অনেক। বককুলের যে কোন প্রজাতির বিপদে উড়ে এসে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা। এই দুর্বলতা কাজে লাগায় চতুর মানুষ। ঝাউগাছের মতো এক ধরনের ফাঁদ বানিয়ে তার ওপর একটি বন্দী বক রেখে দেয়। উড়ে আসা বক বন্দী বককে উদ্ধার করতে এসে চতুর শিকারির কৌশলে নিজেও বন্দী হয়। বহু যুগ আগে আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখির আগমন শুরু হলে নদী-বিল-জলাশয়ে থাকা আমাদের বক অতিথি পাখিদের বরণ করে থাকার জায়গা করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরিযায়ী পাখি আজও আসে। ওরা নিজ ভূমে ফিরে যাওয়ার পালায় বকেরা সারাক্ষণ অতিথিদের সঙ্গে থেকে বিদায়ের ক্ষণ ধরে রাখে। বোঝা যায়, কতটা বেদনা বিধুর হয়ে যায় বকেরা। নিকট অতীতে নদী, খাল, বিল, ঝিলে জলাশয়ে বকদের সারি মন ভরিয়ে দিত। কখনও গাছের ওপর ওড়াউড়ি, কখনও শাখায় বসে ক্লান্তি কাটিয়ে ফের উড়াল। বিলের ধারে বকের ঝাঁক সারিতে থাকত। মনে হতো বক পাখিদের মিলনমেলা। শীত মৌসুমে চরে যে অতিথি পাখি দেখা যায় তার মধ্যে দেশী কানিবক, গো বক, মঝলা বগা, ধূপানি বকদের দেখা যায়। চলনবিল, হাকালুকির হাওড়, মনপুরার চর, পাতারচর, সোনাদিয়ার চরসহ বড় নদ-নদীর চরে বকেরা অতিথি পাখিদের সঙ্গ দেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে দেখা যায় বকের সারি। নিসর্গের এই দৃশ্য এখন চোখে পড়ে কালেভদ্রে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলাপাড়ে বক পাখিদের ছিল অভয়ারণ্য। শীত-বসন্তে বক পাখিরা কখনও দলবেঁধে ওড়ে, কখনও মাছ শিকারে ব্যস্ত থেকে নদী-খাল-বিল ভরে দিত সৌন্দর্যে। ভাওয়াইয়া গানে যে ধরলা নদীতে ফাঁদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেই ধরলা স্মৃতির নদী। শিকারীদের থাবা এখন সব নদী, বিল ও চরে। বককে ভ্রান্তিতে ফেলতে নানা ধরনের ফাঁদ এঁটে অপেক্ষায় থাকে চতুর শিকারি। দিশাহারা বককুল এখন আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। লুকিয়ে থাকার মতো জায়গা পাচ্ছে না। বৃষ্টি নামলে বকেরা আশ্রয় নিত গাছের শাখায়। খুঁজে বেড়াত কাশবন, বাঁশবাগান। বড় বৃক্ষ। এখন কাশবনের কাঠি ব্যবহৃত হচ্ছে গৃহস্থালি উপকরণ বানানোর কাজে। বকেরা যে বাঁশবাগানে থাকত, সেই ‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর কবিতার পঙক্তির চাঁদ ওঠে না। বাঁশঝাড় কেটে সাফ। নগরায়নের অসামঞ্জস থাবায় উধাও হচ্ছে গাছ। এর ওপর বৈশি^ক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারায় মনুষ্যকুলের সঙ্গে বুকেরও ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বকরা এখন যাবে কোথায়! ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন নেচার (আইইউসিএন) সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ১১ প্রজাতির বকের মধ্যে সাত প্রজাতি দেশী। এর মধ্যে চার প্রজাতিই এখন বিপন্নপ্রায়। এগুলো হলো বাঘা বক, রঙ্গিলা বক, নিশি বক ও কোদালি বক। অতীতে এসব বক মানুষের বাসের মধ্যেই উড়ে বেড়াত। নদী, খাল-বিল-জলাশয়ের ধারে যাদের বাড়ি তারা রাতে নিশিবকের ‘ওয়াক ওয়াক’ ডাক শুনত। ভাবত হুতুমপেঁচা এভাবে ডেকে প্রহর গুনছে কেন! কিছু পরেই ভ্রম কেটে গিয়ে নিশিবকের কথা মনে হতো। নিশিবক এমন ডাকে মাছ খুঁজে বেড়ায়। এই নিশিবক রেহাই পাচ্ছে না। বগুড়া সরকারী আজিজুল হক কলেজের (পূর্বের আযীযুল হক বানান পাল্টে বর্তমানে এই বানানেই কলেজের নাম লেখা হয়) পরিবেশবাদী সংগঠন টিম ফর এনার্জি এনভায়রনমেন্ট এ্যান্ড রিসার্চের (তীর) সদস্যরা মাঝেমধ্যেই নদী-বিল-চর এলাকা থেকে নিশিবক উদ্ধার করে। পরে কোন জলাশয়ে অবমুক্ত করে দেন। আইইউসিএন জানায়, বক আর্ডেইডি গোত্রের মিঠাপানির মৎস্যভোজী জলচর প্রাণী। পৃথিবীতে বক পাখির প্রজাতি অন্তত ৬৪। এর মধ্যে বড় আকৃতির কিছু বক ভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছে বিশে^র দেশে দেশে। বহুজাতিক কিছু কোম্পানি তাদের প্রোডাক্টে কিংস্টর্কের (সারস) ছবি দিয়ে বিপণন করছে, যা বাংলাদেশে ‘বগা’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশে বকের কিছু প্রজাতি বগলা ও বগা নামে পরিচিতি পেয়েছে। এই বকের শরীরে সাদার প্রাধান্য বেশি। দেশে ‘কানিবক’ সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই বককে নিয়ে ছড়া ‘ওই দেখা যায় তালগাছ ওই আমাদের গাঁ, ওইখানেতে বাস করে কানি বকের ছা’... বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোটবেলায় পড়েছে। শিশুরা আজও খুব মজা করে এই ছড়া পড়ে। ছেলেবেলায় দাদি-নানিরা মজা করে বলতেন, কানিবক কানাবক। আসলে ঠিক উল্টো। কানিবকের চোখ সবচেয়ে উজ্জ্বল। বককুলের সব জাতের বকের বৈশিষ্ট্য প্রায় এক। সাদা ধবধবে বকের পাশাপাশি গলায় ছাই রঙের, কিছুটা ধূসর বর্ণের বক আছে। তবে তীক্ষ্ন ঠোঁট, লম্বা গলা, লম্বা পা, মাথায় ঝুলে থাকা সোনালি ঝুঁটি সব বকের মধ্যেই আছে। বক নিয়ে কথাগুলোর ফুলঝুড়িও কম নয়। বক মেরে হাতে নিয়ে নরম পালক নিয়ে নাড়াচাড়া করলে সুযোগ বুঝে বক লম্বা ঠোঁট দিয়ে চোখে ঠোকর দেয়। এর বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ওদের চোখে জ্যোতি বেশি। নদী- বিলের-জলের গভীরে কিংবা ডাঙ্গায় দূরের জিনিস দেখতে পায়। কোন কিছু হারিয়ে খুঁজে পাওয়ার পর উপমা হিসেবে বলা হয় ‘ওরে বাব্বা এ যে দেখছি বকের চোখ’। ছেলেবেলার বাঘ ও বকের সেই গল্পে বলা হয়েছে-বক লম্বা ঠোঁটে বাঘের গলায় ফোটা হাড় বের করে দেয়। পরে বাঘ প্রাণ নেয় উপকারী বকের। নিরীহ বকের গল্প নানাভাবে উঠে এসেছে আমাদের ছড়া-কবিতা-সাহিত্যে। যেমন বককে নেমন্তন্ন করে পানি খেতে দেয়া হয় থালায়। আমাদের এই বক বিপন্ন হওয়ার কয়েকটি কারণের অন্যতম হলো : জলাভূমি ব্যবহারে অসচেতনতা। রাসায়নিক সার প্রয়োগের মাত্রা বেশি। জলাশয়ে কিছু খেতে গিয়ে বকেরা বিষাক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয়ে ওই জলাভূমে না যাওয়া। দেশী বৃক্ষ রোপণ কম ও বট-পাকুর গাছ কেটে ফেলা। বক সাধারণত বিদেশী ইউক্যালিপটাস, আকাশমনির মতো বিশাল গাছে থাকে না- যেন একান্তই আপন ওরা আমাদের। বকের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া। এভাবে গত দশ বছরে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী, খালবিল, পূর্বাঞ্চলের হাওড়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর চর ও সুন্দরবনে বকের সংখ্যা কমেছে। বিশ্বে মরু ও মেরু অঞ্চলে বক থাকতে পারে না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু প্রজাতির বকের বিচরণ ক্ষেত্র। বাংলাদেশে বকের আগমন ঠিক কবে সে হিসাব নেই। তবে মনে করা হয় ছয় ঋতুবৈচিত্র্যের এই দেশে বক পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে শুরু করেছে লাখো বছর আগে। সেই হিসেবে বক বাংলাদেশের আপন ভুবনের পাখি। বককে পাখির তালিকায় প্যেটেন্ট করার বিষয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বক পাখির প্যেটেন্ট কেড়ে নেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। বকেরা কি এখন নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকবে! আগেই প্যেটেন্ট করে ওদেরকে আমাদের করে নেয়ার এখনই সময়! শিকারির ভয়ে চেনা পথ ছেড়ে উড়াল দিয়ে খুঁজে ফিরবে নিরাপদ কোন অভয়ারণ্য...।
×