ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিসিআইসির কাছে ১১ লাখ টন মজুদ

ডিএপি সারের দাম কমায় ইউরিয়ার চাহিদা হ্রাস

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১৪ জানুয়ারি ২০২০

ডিএপি সারের দাম কমায় ইউরিয়ার চাহিদা হ্রাস

কাওসার রহমান ॥ বোরোর ভরা মৌসুমেও মাঠে ইউরিয়া সারের চাহিদা নেই। ডিএপি সারের দাম কমানোর কারণে ইউরিয়া সার বিপণনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মাঠ পর্যায়ে আশঙ্কাজনক হ্রাস পেয়েছে ইউরিয়ার চাহিদা। ফলে এই ভরা মৌসুমেও বিসিআইসির কাছে রেকর্ড ১১ লাখ টন ইউরিয়া সারের মজুদ গড়ে উঠেছে। ইউরিয়ার পাশাপাশি টিএসপি, এমওপি এবং এনপিকেএস সারের বিক্রিও স্থবির হয়ে পড়েছে। বিপরীতে মূল্য কমানোর কারণে ডিএপি সারের চাহিদা হু হু করে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে ডিএপি সারের বরাদ্দ বাড়ানোর জন্যও ব্যবসায়ীরা তাগাদা দিচ্ছেন। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে মূল্যের বড় ধরনের পার্থক্যের কারণে ভারতের ডিএপি সার পাচারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় সীমান্তে কঠোর নজরদারি না করলে ডিএপি সারের দাম কমানোর সুফল থেকে কৃষক বঞ্চিত হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ডিএপি সারের দাম কমিয়ে এনেছে। ফসল আবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ সারের দাম ৯ টাকা কমিয়ে প্রতি কেজি ডাই এ্যামোসিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ টাকা। ডিলার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ টাকা। অর্থাৎ ডিলাররা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও সরকার অনুমোদিত বেসরকারী আমদানিকারক থেকে প্রতি কেজি ডিএপি সার ১৪ টাকায় কিনে কৃষকদের কাছে ১৬ টাকায় বিক্রি করবেন। মূলত ইউরিয়া সারের ওপর চাপ কমানো এবং ফসলের উৎপাদন ব্যয় কমাতে কৃষিমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে ডিএপি সারের দাম কমিয়েছেন। গত ৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কৃষিমন্ত্রী প্রতি কেজি ডিএপি সার ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা নির্ধারণ করার ঘোষণা দেন। এজন্য কৃষিমন্ত্রী অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ এতে শুধু ফসল উৎপাদন খরচই কমবে না, কৃষক মানসম্পন্ন সার ব্যবহারে উৎসাহী হবেন। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ডিএপি সারের দাম কমানোর কারণে প্রত্যাশার চাইতেও বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ইউরিয়া সারের ওপর। বোরোর এই পিক মৌসুমে সার ডিলাররা ইউরিয়া সার বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ফলে ডিলার পর্যায়েও বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সারের মুজদ গড়ে উঠছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ডিলাররা এই ভরা মৌসুমেও বিসিআইসির কারখানা বা বাফার গুদাম থেকে ইউরিয়া সার তুলতেই চাইছে না। বরং ভরা মৌসুমে ইউরিয়া সার উত্তোলনের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা তারা তুলে দেয়ার বা শিথিল করার দাবি জানিয়েছেন। বর্তমানে বছরে দুই মাস ‘লিন পিরিয়ডে’ ইউরিয়া সার উত্তোলনের বাধ্যবাধতা শিথিল করা আছে। অর্থাৎ মাঠে যখন ইউরিয়া সারের চাহিদা থাকে না তখন দুই মাস ডিলাররা চাইলে ইউরিয়া সার উত্তোলন না করার সুযোগ পান। এখন মাঠে ইউরিয়া সারের চাহিদা এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে, ডিলাররা এখন বোরো আবাদের ভরা মৌসুমেও ইউরিয়া সার তুলতে চাইছেন না। অনেক ডিলার তাদের কেন্দ্রীয় সংগঠন ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়ে দিয়েছে যে, জানুয়ারির পর তারা আর ইউরিয়া সার নিবে না। বিপরীতে বিভিন্ন জেলা থেকে ডিলাররা আরও বেশি পরিমাণে ডিএপি সারের বরাদ্দ প্রদানের জন্য দাবি জানাচ্ছে। ফলে বিসিআইসির কাছে ইউরিয়া সারের স্তূপ জমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিসিআইসির কাছে ইউরিয়া সারের মজুদ প্রায় ১১ লাখ টনে গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ কয়েক মাস আগেও এই মজুদ ছিল ৮ লাখ টন। অথচ বোরো মৌসুমের চার মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৫ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। চলতি বোরো মৌসুমের ৪ মাসে ১৪ লাখ ৫০ হাজার টন ইউরিয়ার চাহিদা রয়েছে। সার বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, ডিএপি সারের দাম কমে যাওয়ায় ডিলাররা ইউরিয়া নিচ্ছে না। ফলে বিসিআইসির কাছে ইউরিয়া সারের মজুদ বাড়ছে। এই অবস্থায় জানুয়ারি থেকে ইউরিয়া না নিয়ে মজুদ আরও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে এ বছর শৈত্যপ্রবাহের কারণে বোরো আবাদ বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে ডিলারদের এখন হয়ত পর্যাপ্ত ইউরিয়া মজুদ আছে। কিন্তু বোরোর চারা লাগানো শুরু হলে এবং ধান গাছ বড় হলে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হবে। তখন ইউরিয়ার চাহিদা বেড়ে যাবে। ডিলারদের কাছে যে ইউরিয়া মজুদ আছে তা দিয়ে ওই সময় চাহিদা পূরণ নাও হতে পারে। তখন মাঠে ইউরিয়া সারের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। ফলে এ বছর ইউরিয়া সার নিয়ে একটি জটিল অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। লিন পিরিয়ডে বা আরও অন্তত এক মাস আগে ডিএপি সারের দাম কমানো হলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না বলে তারা মনে করছেন। ডিএপি একটি সুষম সার। এই সারের মধ্যে ফসফেট, এ্যামোনিয়া এবং পটাশ রয়েছে। অর্থাৎ ডিএপি সার একাধারে ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) এবং ইউরিয়া সারের কাজ করে। ফলে ডিএপি সার জমিতে প্রয়োগ করলে আর আলাদাভাবে ফসলে এই তিনটি সার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। আর এমওপি সারটি প্রয়োগ করতে হয় জমি প্রস্তুতের সময়। এই সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করে ধান ্আবাদ করা হলে ধানের গাছ পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে তার প্রয়োজানীয় পুষ্টি জমি থেকে গ্রহণ করে নেয়। আর এই সার জমিতে প্রদানের ব্যাপারে কৃষকদের উৎসাহিত করার কারণ হচ্ছে, কৃষক শুধু ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকে কিন্তু এমওপি ও টিএসপি সার সেভাবে প্রয়োগ করে না। বা করলেও কম করে। ফলে পুষ্টির ঘাটতির কারণে ফসল উৎপাদন কাক্সিক্ষত পরিমাণে হয় না। এ কারণেই বাংলাদেশে ভর্তুকি দিয়ে ডিএপি সার ব্যবহারের প্রচলন শুরু করা হয়। কিন্তু সব ফসলের ক্ষেত্রেই ডিএপি সারের প্রয়োজন হয় না। আলাদাভাবে এমওপি ও টিএসপি সারের প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ডিএপি সারের দাম কমানোয় এসব সারের ওপরও প্রচ- ধাক্কা পড়েছে। এমনকি সরকার এতদিন ভর্তুকি কার্যক্রমের আওতায় স্থানীয়ভাবে এনপিকেএস সার উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের উদ্ভুত করে আসছিল মাটির পুষ্টি ঘাটতি পূরণে। এখন সেই এনপিকেএস সারের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ডিএপি সারের মূল্যের। মাঠ পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, টিএসপি, এমওপি এবং এনপিকেএস সার বিক্রি এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত টিএসপি সার ডিএপি সারের চেয়ে কম গুণগত মানসম্পন্ন। কিন্তু টিএসপির চেয়ে ডিএপি সারের দাম কম হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে টিএসপি সার বিক্রি হচ্ছে না। ফলে আমদানিকারকদের কাছে বিপুল পরিমাণ মজুদ টিএসপি সার অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। একই অবস্থা এমওপি সারের ক্ষেত্রে। ডিলাররা এখন এই সারও নিতে চাচ্ছে না। ফলে এমওপি সারের বিক্রিও স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকারের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচীর আওতায় এতদিন ভর্তুকির আওতায় এমওপি সার আমদানির মাধ্যমে এনপিকেএস সার উৎপাদন করে আসছিল স্থানীয় উদ্যোক্তারা। কিন্তু ডিএপি সারের দাম হ্রাস করায় এনপিকেএস উৎপাদনকারীদের কেজি প্রতি ৭ টাকা করে লোকসান দিতে হচ্ছে। ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় এনপিকেএস সার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিএপি সারের দাম কমিয়ে কৃষকের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। এটি দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে। কারণ সার হচ্ছে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম উপকরণ। একটি গাছ তার প্রয়োজনীয় ১৭ পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ১৪টিই মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। এক হেক্টর জমি থেকে ৬ টন ধান উৎপাদনের জন্য ১০৮ কেজি নাইট্রোজেন, ১৮ কেজি ফসফরাস, ১০২ কেজি পটাশিয়াম এবং ১১ কেজি সালফার গ্রহণ করে থাকে। এজন্য প্রতি বছর জমি প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি হারায়। এই পুষ্টি পূরণে প্রয়োজনীয় পরিমাণে সুষম সার প্রয়োগ করা দরকার। এজন্য জমিতে সব সারই পরিমাণ মতো দিতে হবে। এতে কৃষক শুধু ডিএপি দিলে অন্য সারের ঘাটতি থেকে যাবে। তাই ডিএপি সারের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নন-ইউরিয়া সারের দামও আনুপাতিক হারে সরকারের কমানো উচিত। অন্যথায় কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রতি কেজি টিএসপি ২২ টাকা এবং এমওপি সার ১৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ভর্তুকি দিয়ে সরকার এই দাম এসব সার বিক্রি করছে। এদিকে, দাম কমানোর কারণে দেশের সীমান্ত জেলাগুলোই ডিএপি সারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেছে। ফলে ডিএপি সার পাচারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে বেশি বরাদ্দের দাবি আসায় সন্দেহ আরও ঘণীভূত হচ্ছে। ডিলার পর্যায়ে এখন প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ডিএপি সারের দাম ৭০০ টাকা। ভারতে তথা পশ্চিম বাংলায় এই সারের দাম ১৩০০ টাকা বস্তা। ফলে পশ্চিম বাংলায় সঙ্গে বাংলাদেশের ডিএপি সারের দামে পার্থক্য ৬০০ টাকা। ফলে সরকারের ভর্তুকি দেয়া ডিএপি সার ১০০ টাকা লাভে দেশে বিক্রি করার চেয়ে ৬০০ টাকা লাভে ভারতে পাঁচার অনেক লাভজনক। এজন্য কঠোর নজরদারির সঙ্গে দেশপ্রেমও দরকার। যদিও আমাদের যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাতে এই মূল্যের পার্থক্যের কারণে কতটা পাচার ঠেকানো যাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
×