ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিশেলে একখ- বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:১৪, ৭ জানুয়ারি ২০২০

ইতিহাস-ঐতিহ্যের মিশেলে একখ- বাংলাদেশ

মামুন-অর-রশিদ ॥ নতুন করে গড়ে তোলা অনন্য এক ‘আম্রকানন’। অসংখ্য আমগাছে পরিবেষ্টিত এমনি একটি বাগানের পরতে পরতে গড়ে তোলা হয়েছে আবহমান বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। যেন বাগানের ভেতরে স্থাপিত হয়েছে ‘একখ- বাংলাদেশ’। বাগানজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আধুনিতার ছাপ। দৃষ্টিনন্দন অথচ সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে নানান স্থাপনা। এখানে শুধু গোটা বাংলাদেশ নয়, রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন স্থাপনাও তুলে ধরা হয়েছে সযতেœ। নগরীর উপকণ্ঠে ছোট্ট বাগানের ভেতরে সম্পূর্ণ শৈল্পিক ভঙ্গিতে গড়ে তোলা হয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য্যম-িত এক বিনোদন কেন্দ্র। এর মধ্যে প্রবেশ করলেই মনে হবে দেশের নানা স্থাপত্য শিল্পের পাশাপাশি এক পলকে দেখা হয়ে যাবে গোটা রাজশাহী। সবুজ নগরীকে রঙিন আভায় ছড়িয়ে দিতে শিশু, তরুণ-তরুণীসহ সকল বয়সী লোকজনের কাছে দৃষ্টিনন্দন স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সেই বাগান। বাগানবিলাসী সমাজ সচেতন এক ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন তার শখের এই বাগান। আর সেখানেই ছোট-বড় অসংখ্য আমগাছ পরিবেষ্টিত ছায়ায় থরে থরে স্থাপন করা হয়েছে একখ- রাজশাহী। এর নাম রাখা হয়েছে ‘চৈতির বাগান’। শুধু রাজশাহী নয়, সেই বাগানেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে একখ- বাংলাদেশ, যা মুগ্ধ করেছে দর্শনার্থীদের। বিয়ে, পিকনিক, জন্মদিন, সভা-সমাবেশসহ বিশেষ দিন উদ্যাপনের জন্য স্থানটি এখন সকলের মন জয় করে নিয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে একট ভেতরে। নগরীর জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় মাত্র চার কিলোমিটারের পথ। নগরীর উপকণ্ঠ পবা উপজেলার সিলিন্দায় গেলেই দেখা মিলবে এই ‘চৈতির বাগান’র। সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশের মধ্যে চোখ ধাঁধানো রঙিন বিনোদন কেন্দ্র। সম্প্রতি সেই বাগানে ঢুঁ দিতেই চোখ আটকে গেল। কারণ বাগানের ভেতর রয়েছে ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার’। অবাক হওয়ার মতোই। সেখানে জাতীয় চার নেতার কারাবাসের চিত্র। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মডেল। কারাগারের ভেতর রয়েছে জাতীয় চার নেতা সাবেক উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এর ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবি। আরও আছে কাঠের চৌকি। তার উপরে ছেঁড়া বিছানা, কাঁথা, বালিশ, থালা, বাটি। কারাগারের বাইরের দিকটায় লোহার শিকের সঙ্গে মরিচাপড়া তালা দিয়ে বন্ধ করা। দেখেই মনে হবে যেন সে সময়ের জীবন্ত কারাবাসের চিত্র। মনে হবে ১৯৭৩ সালের ৩ নবেম্বর কলঙ্কিত জেলহত্যার কথা। এ থেকে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে ইতিহাস। সেই ধারণা থেকেই এখানে কারাগারের মডেল তৈরি করা হয়েছে। বাগানের দু’পাশে ছোট-বড় অসংখ্য গাছের ভেতর দিয়ে রাস্তাটি এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে বাগানের প্রধান ফটক পর্র্যন্ত। সেখানে প্রবেশ করতেই পরিবেশ আর রঙিন ঝলকানিতে চোখ আটকে যাবে যে কারও। মনের মাঝেও এনে দেবে প্রশান্তির দোলা। মনে হবে যেন আনন্দের সমাহারে রচিত এক স্বপ্নরাজ্য। প্রবেশদার পার হতেই বাম পাশে সবার আগে চোখে পড়বে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা নামাজ ঘর। তার পরই রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু কর্নার। এখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতির খ-চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্নারের সঙ্গেই রয়েছে পাখিদের আবাসস্থল। সেখানে পাখিরা সারাক্ষণ কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত করছে। এতে আনন্দের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারপরই কারুকার্যখচিত সৌদি আরবের নিদর্শন হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে ‘সৌদি গেট’। গেটটি পার হতেই ডান দিকে রয়েছে ছোট্ট পরিসরে রাজশাহীর ‘শহীদ কামারুজ্জামান স্মৃতি মনুমেন্ট’। এখানে শহীদ কামারুজ্জামানের জন্ম ও শহীদ হওয়ার তারিখসহ সাল সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তারপর দৃষ্টি যাবে চারদিক সবুজে মোড়ানো পুকুরের দিকে। শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে পানি অল্প থাকলেও তার ওপর লাল শাপলা ফুটে আছে। আর শাপলার গোলাকৃতির সবুজ পাতাগুলো পানিতে যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। লাল শাপলাগুলোর পাপড়িতে সূর্যের কিরণ পড়ে রূপার মতো ঝিকমিক করে উঠছে। শাপলা সৌন্দর্য্যরে মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে পুকুরটার। দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করতে অসামান্য অবদান রাখছে এই শাপলা পুকুর। বাগানটির ভেতর এঁকে বেঁকে চলেছে অনেক পথ। পথের দু’পাশে অসংখ্য রঙিন ফুল, বাহারি গাছপালা। হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে, এ পথ যদি না শেষ হয় তবে ভালোই হতো! পথের দু’পাশে রয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন। এখানে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ভাস্কর্য। তাতে রয়েছে ক্রিকেট ব্যাট, বল, প্যাড, স্ট্যাম্প, হেলমেট। পাশেই রয়েছে ‘চৈতির বাগান’র নিজস্ব লোগো ইংরেজীর দুটি অক্ষর ‘সি বি’। ‘সি বি’র চারপাশটা বিভিন্ন ফুলে সংরক্ষিত। তার কিছু দূরেই স্থান পেয়েছে রানী হেমন্ত কুমারীর ঐতিহাসিক ‘ঢোপকল’। যা বিলুপ্ত প্রায় রাজশাহীর ঐতিহ্য। কিন্তু সেখানে ছোট্ট পরিসরে হলেও ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে সেই ঢোপকল। চোখ ফেরাতেই দৃষ্টি আটকে যাবে আরেক জায়গায় তা হলো ‘কুলা’ চত্বর। কালের সাক্ষী হয়ে এটি বাঙালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করছে। মনে করিয়ে দেয় পহেলা বৈশাখের কথা। তারপর রঙিন সাজে সেজে আছে বিশাল মঞ্চ। এটি বাগানটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। যেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য এই স্থানটিই আনন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তার কিছু দূরেই রয়েছে রাজশাহীর ‘স্মৃতি অম্লান’ ভাস্কর্যটি। অম্লানটির চারপাশটা ছোট ছোট গাঢ় খয়েরি রঙের খাঁচকাটা ইটে তৈরি সিঁড়ির মতো উপরের দিকে উঠে গেছে। তার মাথায় আবার গোলবৃত্ত। যা পুরো পৃথিবীর বুকে একখ- বাংলাদেশের মানচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশে দাঁড়িয়ে যে কারোরই মনে হতে পারে যেন নগরীর ভদ্রা মোড়েই দাঁড়িয়ে আছেন। আরও রয়েছে ঢাকার ঐতিহ্য বহনকারী ‘শাপলা চত্বর’। টাইলস্ করা গোল বৃত্তে স্বচ্ছ পানির মধ্যে ছোট-বড় রঙিন পাথর এবং বিভিন্ন প্রজাতির রঙিন সামদ্রিক মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। তার মাঝখানে ফুটে আছে লাল-সাদা শাপলা। দৃষ্টি এবং মন কাড়ছে সকলের। যেন প্রকৃতিরই এক অন্যরূপ। কিছু দূর হাঁটতেই দৃষ্টি আটকে যাবে বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্যের সব কারুকার্যে। এখানে এক প্যান্ডেলেই রয়েছে বাঙালী নারীদের কাজের হাতিয়ার যাঁতা, ঢেঁকি, কুলা, কৃষকের ব্যবহৃত লাঙ্গল, মই, মাথাল, হুকাসহ বিভিন্ন নিদর্শন। যা বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। বয়স্করা এখানে এসে হারিয়ে যাবেন তাদের পুরনো স্মৃতিতে। তার পাশেই রয়েছে বর্তমান সরকার এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা। নৌকাটিতে বৈঠাসহ রঙিন ছাউনিতে আবৃত। এছাড়াও রয়েছে খড়ের ছাউনিবেষ্টিত বাহারি কাপড়ে সজ্জিত ছোট-বড় অসংখ্য টেন্ট। সেখানে বসে আড্ডা দেয়ার সুব্যবস্থা করা রয়েছে। শিশুদের খেলাধুলার জন্য রয়েছে হরেক রকমের দোলনা, ঢেঁকিসহ নানা ধরনের খেলনা সামগ্রী। এছাড়াও তরুণ-তরুণীদের প্রথম পছন্দ ‘লাভ কর্নার’। মাঝারি উচ্চতার স্তম্ভে টকটকে লাল রঙের ‘লাভ’ ভাষ্কর্য এবং লাভের মাঝ বরাবর তীর মারা। এতে তরুণ-তরুণীদের মনের সাগরে ভালবাসার তরঙ্গে জোয়ার এনে দেবে। তাদের মনের স্বপ্নরাজ্য প্লাবিত হবে সেই জোয়ারে। আঁকাবাঁকা রাস্তার দ’পাশে বাহারি ফুল, ফলসহ বিচিত্র প্রজাতির অসংখ্য গাছ। হাঁটতে হাঁটতে এই গাছগুলো আপনাকে ভিন্ন আনন্দ দেবে। হাঁটার ছলে আপনার হাতের ছোঁয়ায় গাছগুলো যেন দোলা দিয়ে উঠবে। যেন এতদিন ধরে ফুল এবং গাছেরা রয়েছে আপনারই অপেক্ষাই। বাগানটির সীমানা প্রাচীরজুড়ে স্থান পেয়েছে দেশের জাতীয় মসজিদ ‘বায়তুল মোকারম’ সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত মসজিদের ছবি। এখানে বিশ্বের অজানা সব বিখ্যাত মসজিদ সম্পর্কে জানা যাবে। এছাড়াও বাগানটির এক কর্নারে ছোট্ট পরিসরে রয়েছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস ও মুরগির খামার। বাগানটির পরিবেশ, ইতিহাস ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। সব মিলিয়ে মনে হবে যেন হাতের মুঠোই দৃষ্টিনন্দন একখ- বাংলাদেশ। দৃষ্টিনন্দন এই ‘চৈতির বাগান’ মালিকের নাম মতিউর রহমান চৈতি। নিজের নামেই রেখেছেন বাগানের নাম। তিনি পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। শৌখিন ও পরিবেশ প্রিয় মতিউর রহমান চৈতি জানান, প্রায় ১২ বিঘা জমির ওপর তার এই বাগান। তার পৈত্রিক সম্পত্তিতে শুধু শখের বশেই এটি গড়ে তুলেছেন। বছরে যা আয় হয় তার প্রায় সবই খরচ করেন এই বাগানে। তার ইচ্ছে, ধীরে ধীরে এখানে ছোট্ট পরিসরে দেশের বিখ্যাত সব ভাস্কর্যের নিদর্শন স্থাপন করবেন। রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থাপনা স্থাপন করে দেশের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করবেন এবং বর্তমান এবং নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবেন। তার বাগানে কেউ ঢুঁ দিলেই যেন একখ- বাংলাদেশ দেখতে পারেন সেভাবে গড়ে তোলার ইচ্ছে চৈতির।
×